“বাংলার সৌরভের এটি ছিল শেষবারের মতো অপরিশোধিত তেল পরিবহন,” বলেন তিনি।
Published : 05 Oct 2024, 07:37 PM
সতকর্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও পাঁচ দিনের ব্যবধানে বহির্নোঙ্গরে দ্বিতীয় তেলবাহী জাহাজ ‘বাংলার সৌরভে’ আগুন লাগাকে ‘নাশকতা’ বলে সন্দেহ করছে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)।
শনিবার সকালে চট্টগ্রাম নগরীতে বিএসসির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক এমন মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, মধ্যরাতে ওই জাহাজে কোনো ‘অপারেশনাল’ কার্যক্রম ছিল না, সকলপ্রকার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া পরও সেটিতে চার জায়গায় আগুন লেগেছে।
“জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা ইস্যুতে এটি নাশকতা কি না আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে।“
তবে আগুন লাগার ঘটনায় বিএসসি‘র পক্ষ থেকে করা আট সদস্যের তদন্ত কমিটি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে বলে তুলে ধরেন তিনি।
শুক্রবার মধ্যরাত পৌনে ১টার দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরের চার্লি অ্যাংকরেজের কাছে নোঙ্গর করা বিএসসির মালিকানাধীন এমটি বাংলার সৌরভে আগুন লাগে। জাহাজটিতে ১১ হাজার ৫৫ টন ক্রুড অয়েল ছিল।
রাত আড়াইটা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। দুর্ঘটনার সময় জাহাজ থেকে নামতে গিয়ে পানিতে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়।
আগুন লাগার পর জাহাজের ক্যাপ্টেনসহ ৪৭ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। আগুন নেভার পর বাংলার সৌরভ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএসসির কর্মকর্তারা বলেন, বাংলার সৌরভ বহির্নোঙ্গরে ‘ওমেরা লিগ্যাসি‘ নামের একটি মাদার ভ্যাসেল থেকে এসব ক্রুড অয়েল বোঝাই করেছিল। এসব তেল বন্দরের ডলফিন জেটিতে নিয়ে যাবার পর শনিবার সকাল থেকে খালাসের কথা ছিল।
পাঁচ দিনের ব্যবধানে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী দুটি তেলবাহী জাহাজে আগুন লাগার ঘটনার বিষয়ে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুল মালেক শনিবার সকালে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন।
বাংলার সৌরভে আগুন লাগার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাত সাড়ে ১২টার পর জাহাজটিতে কোনো ধরনের কার্যক্রম ছিল না। জাহাজের চারটি পয়েন্টে একসঙ্গে আগুন দেখা যায়। একসঙ্গে এতগুলো জায়গায় আগুন লাগার কথা না। দুর্ঘটনার আগে পাশ দিয়ে একটি নৌযান ছুটে যায়।
‘‘অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত যেভাবে হয়েছে তাতে নাশকতার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে।‘‘
এটিকে দেশের জ্বালানি ’নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ’ মন্তব্য করে মাহমুদুল মালেক বলেন, বিএসসির পক্ষ থেকে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তারা এটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্ত করে প্রকৃত কারণ বের করবে।
তিনি বলেন, এর আগে বাংলার জ্যোতিতে আগুন লেগেছিল সামনের অংশে। জমে থাকা গ্যাস থেকে এটা ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু সৌরভের ক্ষেত্রে আগে থেকেই অনেক সর্তকর্তা নেওয়া হয়েছিল।
“জাহাজটি পুরনো হওয়ায় গ্যাস জমে থাকাসহ অন্যান্য সমস্যাগুলো যাতে না হয় তা নিয়ে আমরা সচেতন ছিলাম।”
এমডি মাহমুদুল বলেন, পুরনো হওয়ায় বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি জাহাজ দুটিকে অপারেশনাল কাজ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা ছিল। বাংলার সৌরভের এটি ছিল শেষবারের মতো অপরিশোধিত তেল পরিবহন।
আগুন লাগার পর কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও বন্দরের ফায়ার ফাইটার টিম রাত আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে ভোর সাড়ে চারটার দিকে আগুন নিভে আসে।
আগুন লাগার পর ক্যাপ্টেনসহ অন্যান্য ক্রুরা জাহাজ ত্যাগ করে সেটিকে পরিত্যক্ত (এবানডেন্ড) ঘোষণা করে।
বিএসসির এমডি বলেন, সৌরভে মোট ৪৮ জন কাজ করছিলেন। তার মধ্যে ক্রু ছিলেন ৪২ জন, ইস্টার্ন রিফাইনারির দুইজন, ওয়াচম্যান তিনজন এবং সাপ্লাইয়ারদের একজন লোক ছিলেন। জাহাজ থেকে নামার সময় সাদেক আলী নামে একজন নদীতে পড়ে গেলে সাঁতড়ে তীরে ওঠার পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার মৃত্যু হয়।
এর আগে গত সোমবার সকালে বন্দরের ডলফিন জেটিতে ইস্টার্ন রিফাইনারির জন্য অপরিশোধিত তেল খালাসের সময় বিস্ফোরণের পর আগুন লাগে এমটি বাংলার জ্যোতিতে। আগুনে একজন ক্যাডেটসহ তিনজন নিহত হয়।
বিএসসির মালিকানাধীন সচল সাতটি জাহাজের মধ্যে বাংলার সৌরভ ও বাংলার জ্যোতি বন্দরের বহির্নোঙ্গর থেকে তেল লাইটারের কাজ করত। অপর পাঁচটি জাহাজ বিভিন্ন দেশে পণ্য পরিবহনের কাজে নিয়োজিত আছে।
১৯৮৭ সালে নির্মিত জাহাজ দুটি ডেনমার্ক থেকে কেনার পর বিএসসির বহরে যুক্ত হয়।
জাহাজ নির্মাণের সঙ্গে যুক্তরা বলেন, এ ধরনের জাহাজের লাইফটাইম ২০ থেকে ২৫ বছর হলেও ৩৬ বছরের বেশি সময় ধরে জাহাজ দুটি দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে।
বিএসসির এমডি বলেন, এ দুটি জাহাজ ৩৭ বছর ধরে চলাচল করছে। এ দুটির বিকল্প হিসেবে বর্হিনোঙ্গর থেকে ক্রুড অয়েল লাইটারের জন্য ৩০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি জাহাজ ভাড়া করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সেটি দিয়ে লাইটার করা হবে।
তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ
চট্টগ্রাম বন্দরে তেলবাহী জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান ও সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বলে উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়।
একইসঙ্গে জাহাজে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন উপদেষ্টা। পরিবারের সদস্যদের সার্বিক বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।