প্রাইভেট কারে চালকের পাশে বসা ছিলেন সরোয়ার হোসেন বাবলা। গুলিতে দুজন নিহত এবং দুজন আহত হয়েছেন। কিন্তু সরোয়ার এখন কোথায়, সে বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
Published : 30 Mar 2025, 08:29 PM
চট্টগ্রামে যে গাড়িকে ধাওয়া করে গুলি করে দুই জনকে খুন করা হয়, সে গাড়িতে ছিলেন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা।
তাকে ‘নিশানা’ করেই প্রতিপক্ষ সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের অনুসারীরা ওই গাড়িতে হামলা চালিয়েছে বলে সন্দেহ করছেন গুলিতে আহত এক যুবক ও নিহতের স্বজনরা।
রোববার ভোর রাতে নগরীর চকবাজার চন্দনপুরা এলাকায় ধাওয়া করে প্রাইভেট কারে গুলি করে দুই জনকে হত্যা করা হয়। আহত হন আরও দুই জন।
নিহতরা হলেন- বখতেয়ার হোসেন মানিক ও মো. আব্দুল্লাহ। তাদের বয়স ৩০ থেকে ৩৬ এর মধ্যে। আহতরা হলেন- রবিন ও হৃদয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মো. রবিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, প্রাইভেট কারে চালকসহ মোট ছয় জন ছিলেন। নিহত মানিক গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তার পাশে বসা ছিলেন সরোয়ার হোসেন বাবলা।
“শাহ আমানত ব্রিজ সংলগ্ন বালুর মহাল থেকে বের হওয়ার কিছু সময় পর কয়েকটা মোটর সাইকেলে কয়েকজন এসে গাড়ির দিকে করে গুলি চালাতে থাকে। বহদ্দারহাটের দিকে যাবার কথা থাকলেও ‘জীবন বাঁচাতে’ আমাদের গাড়ি বাকলিয়া এক্সেস রোডের দিকে চলে যায়। গাড়িতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ।”
রবিনের ভাষ্য, এক জায়গায় পুলিশের গাড়ি দেখে তারা সহযোগিতা নিতে গাড়ি থামিয়েছিলেন। এসময় হেলমেটধারী মোটর সাইকেল আরোহীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। গাড়ি থেকে নেমে দিগ্বিদিক ছোটার সময় তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন।
রবিনের সন্দেহ, ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হওয়ার পেছনে সরোয়ারের হাত থাকতে পারে–এমন সন্দেহ থেকে তাকে খুন করতে সাজ্জাদের অনুসারীরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
আগে থেকেই বালু মহালে ছিলেন সরোয়ার
রবিনের ভাষ্য, তিনি আব্দুল্লাহর বন্ধু। আর আব্দুল্লাহ ছিলেন সরোয়ারের অনুসারী। রোববার রাতে ঈদের বাজার করতে বাসা থেকে বের হয়ে তারা আব্দুল্লাহর কথায় বাকলিয়া এলাকায় শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন বালু মহালে গিয়েছিলেন। যেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন সরোয়ার ও হৃদয়।
“আমার বাসা বায়েজিদ থানার শেরশাহ বাংলাবাজার এলাকায়। কথা ছিল, আমি, আব্দুল্লাহ, ইমন ও মানিক মিলে ঈদের বাজার করতে যাব। সেজন্য রাত ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে আব্দুল্লাহর সাথে দেখা করি। ওই সময় সরোয়ার ভাইয়ের ফোন পেয়ে আব্দুল্লাহ বালু মহালে যায়। আমাদেরও নিয়ে যায়।”
চট্টগ্রামের 'শীর্ষ সন্ত্রাসী' সরোয়ার গ্রেপ্তার.
চট্টগ্রামে প্রাইভেট কার থামিয়ে গুলি করে ২ জনকে হত্যা
বালু মহালে ঘণ্টা দেড়েক ছিলেন জানিয়ে রবিন বলেন, সেখান থেকে রওনা করার পরপরই তাদের গাড়ির দিকে গুলি ছোড়া হয়।
তার ধারণা হামলাকারীরা আগে থেকেই বালু মহালের আশপাশে অবস্থান নিয়েছিল।
ঘটনার পর সরোয়ার ও ইমন কোথায়, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি রবিন। পুলিশও তাদের হদিস পায়নি।
আগেও ‘সাজ্জাদের অনুসারীদের’ হামলার শিকার হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশ ঘরের সামনে দেখা হয় নিহত আব্দুল্লাহর স্ত্রী, মাসহ স্বজনদের সঙ্গে।
আব্দুল্লাহর মা রাশেদা বেগম বলেন, কয়েক মাস আগে তার ছেলের পায়ে গুলি করেছিল ‘সাজ্জাদের অনুসারীরা’। তখনও সরোয়ারকে ‘বাঁচাতে গিয়ে’ আব্দুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন।
কাঁদতে কাঁদতে রাশেদা বলেন, “আহত ছিল আব্দুল্লাহ, রোজার আগে থেকে বাসায় ছিল, বের হত না। কাল সকালে বাসা থেকে বের হয়েই আমার ছেলেটা মারা গেল।”
আব্দুল্লাহর স্ত্রী প্রিয়া মনি বলেন, যে প্রাইভেট কারে হামলা হয়েছে আব্দুল্লাহই সেটির মালিক। গাড়িটি চালাতেন মানিক। সকাল ৭টার দিকে মানিককে নিয়ে বায়েজিদ শেরশাহর বাসা থেকে বের হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ। বের হবার সময় বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হবে বলে গিয়েছিলেন।
চট্টগ্রামে চায়ের দোকানে যুবককে গুলি করে হত্যা
গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী সরোয়ারের বাড়িতে মিললো একে-২২
“সন্ধ্যায় ইফতারের পর ফোন দিয়ে টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হতে বললো। আমার শ্বাশুড়িসহ এক লাখ ৩০ হাজার টাকা নিয়ে নিউ মার্কেট গেলাম। সেখানে রাত ১০টার দিকে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বললো, রাত ১২টার দিকে বাসায় ফিরবে। রাত দেড়টার দিকে আমি যখন ফোন দিলাম, তখন আমাকে বললো সরোয়ার ভাইয়ার সাথে আছে।”
প্রিয়া মনির ভাষ্য, রাত দেড়টার দিকে তিনি যখন আব্দুল্লাহকে ভিডিও কল করেছিলেন, সেখানে বালুর স্তূপ দেখেছিলেন। পাঞ্জাবি পরা সরোয়ারকেও টেলিফোনে কথা বলতেও দেখেছিলেন।
কে এই সরোয়ার?
সরোয়ার ছিলেন চট্টগ্রামে আট ছাত্রলীগ নেতা খুনের অন্যতম আসামি সাজ্জাদ হোসেনের অন্যতম সহযোগী। পরে বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে আলাদা দল গড়েন সরোয়ার। তখন সাজ্জাদের ডান হাত হয়ে ওঠেন ছোট সাজ্জাদ ওরফে বুড়ির নাতি সাজ্জাদ।
চট্টগ্রামে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রায় দেড় দশক আগে আলোচনায় আসে সরোয়ার হোসন বাবলা ও তার বন্ধু নুরুন্নবী ম্যাক্সনের নাম। সে সময় তারা পরিচিত ছিলেন সাজ্জাদ হোসেন খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে। সাজ্জাদ চট্টগ্রামের আট খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে বিদেশে পালিয়ে আছেন।
২০১১ সালের জুলাইয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিঙ্গারবিল এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন ম্যাক্সন। তার দেওয়া তথ্যে চট্টগ্রামের বায়েজিদ এলাকা থেকে সরোয়ারকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
তখন সরোয়ার-ম্যাক্সনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি একে-৪৭ রাইফেল, দুটি পিস্তল, একটি এলজি, একে-৪৭ রাইফেলের দুটি ম্যাগাজিন ও গুলি।
২০১৭ সালে কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে কাতারে চলে গিয়েছিলেন সরোয়ার ও ম্যাক্সন। সেখানে বসেই তারা দেশে চাঁদাবাজি চালাচ্ছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।
প্রায় তিন বছর কাতারে ছিলেন সরোয়ার। সেখানে মারামারির এক ঘটনায় পুলিশ তাকে আটক করে এক মাসের সাজা দেয়। সাজা শেষে সরোয়ারকে তারা দেশে পাঠিয়ে দিলে ২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিমানবন্দরে পুলিশ তাকে আটক করে।
'মধ্যপ্রাচ্যে বসেই চট্টগ্রামে চাঁদাবাজি' পলাতক ৩ সন্ত্রাসীর
তাকে চট্টগ্রাম এনে পরদিন ভোরে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার খন্দকীয়া পাড়ায় সরোয়ারের বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩০ রাউন্ড গুলিসহ একটি একে-২২ রাইফেল, চার রাউন্ড গুলিসহ একটি এলজি উদ্ধার করার কথা জানায় পুলিশ।
প্রায় চার বছর কারাগারে থেকে জামিনে বের হওয়ার পর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ২৭ জুলাই সরোয়ারকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৫ অগাস্ট পরবর্তী সময়ে তিনি জামিনে ছাড়া পান।
আর সাজ্জাদ এলাকায় এবং তার অনুসারীদের কাছে এখন ‘বিএনপি সমর্থক’ হিসেবে পরিচিত।
সরোয়ার ও ছোট সাজ্জাদের পুরানো দ্বন্দ্ব
বায়েজিদ, চান্দগাঁও এলাকার একটি বড় অংশে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কাজের জন্য বিভিন্ন সময়ে ছোট সাজ্জাদ ও সরোয়ারের অনুসারীদের মধ্যে বিরোধ ও সংঘর্ষের খবর শোনা যায়। ছোট সাজ্জাদ বড় সাজ্জাদের হয়ে এবং সরোয়ার নিজেই তার অনুসারীদের দিয়ে চাঁদাবাজি করতেন।
চট্টগ্রামে ৩ শিবিরকর্মী গ্রেপ্তার
গত বছরের ২১ অক্টোবর বিকালে চান্দগাঁও থানার অদূরপাড়া এলাকায় দোকানে বসে চা পানের সময় তাহসিন নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে কালো রঙের একটি গাড়িতে করে আসা লোকজন। সে ঘটনায় প্রধান সন্দেহভাজন ছোট সাজ্জাদ।
নিহত তাহসিন ছিলেন সন্ত্রাসী সরোয়ারের অনুসারী। ওই ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় মামলা করেন তাহসিনের বাবা। তাতে পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে প্রধান আসামি করা হয়।
গত ১৫ মার্চ ঢাকার বসুন্ধরা শপিং মল থেকে গ্রেপ্তার হন ছোট সাজ্জাদ। এর পেছনে সরোয়ারের অনুসারীদের হাত ছিল বলে সাজ্জাদের পক্ষের লোকজনের সন্দেহ।
রোববারের জোড়া খুনের পর চকবাজার থানার ওসি জাহিদুল কবিরকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ছোট সাজ্জাদের লোকজন প্রতিশোধ নিতে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে কিনা, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।