১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ হয়। নানা ঘটনার পর ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি এই বিপ্লবীর ফাঁসি কার্যকর হয়।
Published : 12 Jan 2024, 07:27 PM
ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের নায়ক মাস্টারদা সূর্য কুমার সেনের ফাঁসি কার্যকরের দিনটি জাতীয়ভাবে পালন এবং পাঠ্যবইয়ে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে।
শুক্রবার এই বিপ্লবীর ফাঁসি কার্যকরের ৯১ তম বার্ষিকীতে এই দাবি জানায় কয়েকটি সংগঠন।
এদিন নগরীর জে এম সেন হল প্রাঙ্গনে সূর্যসেনের আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
পরে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদের সভাপতি অঞ্জন কান্তি চৌধুরী বলেন, "ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে একই সূত্রে গাঁথা।"
পরিষদের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী সিঞ্চন ভৌমিক বলেন, "বিপ্লবীদের পথ ধরে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ উপহার দিয়ে যান। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপ্লবীদের কোনো দিবস পালন না করায় আমাদের ছেলেমেয়েরা বিপ্লবীদের গৌরবগাঁথা সোনালি দিনগুলোর কথা তেমন কিছুই জানে না।
"তাই এই দুই মহান বিপ্লবীর ফাঁসি দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই।”
বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদারের বাড়ি-ঘর জায়গা-জমিগুলো রক্ষা করারও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলেও আক্ষেপ করেন তিনি।
পরিষদের অর্থ সম্পাদক তপন ভট্টাচার্য্যের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা বেলাল হোসেন, সাবেক ইউপি সদস্য সুনীল দাশ, মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ, শিক্ষক লিটন চৌধুরী, সজল শিকদার।
পরে সূর্যসেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল - বাসদের চট্টগ্রাম জেলা শাখা।
বাসদ নেতা আহমদ জসীম বলেন, "মাস্টারদারা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের সূর্যও অস্ত যায়। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা সহ অসংখ্য বিপ্লবীদের সঠিক ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে তুলে ধরার দাবি জানাচ্ছি।"
বিকালে ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি ইমরান চৌধুরী বলেন, "মাস্টারদার দেখানো পথে বিপ্লবী তৎপরতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পরাজিত হয়েছে। যুদ্ধ করে পাকিস্তানি শাসকদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করেছে এদেশের মুক্তিকামী জনগণ। কিন্তু আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ও শোষণ-বৈষম্যহীন রাষ্ট্র আজও আমরা পাইনি। বরং ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা করছে লুটেরা-দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী।"
বিকেলে নগরীর আন্দরকিল্লায় সংগঠনের অস্থায়ী কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম- বৃহত্তর চট্টগ্রামের উদ্যোগে হয় আরেকটি স্মরণ সভা।
সেই আলোচনায় সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক বেদারুল আলম চৌধুরী বেদার বলেন, "বাঙালি জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে শহীদ সূর্যসেন অমর, অক্ষয় নাম। অবিভক্ত বাংলার মুক্তির বিপ্লবের ইতিহাসে আজও তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী বীর।
"১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ব্রিটিশ শাসকেরা সূর্যসেনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। সে সময় জেল গেটের বাইরে তার সহযোদ্ধারা অপেক্ষা করছিলেন, তাদের প্রিয় সহকর্মী, নেতাকে স্যালুটের মাধ্যমে বিদায় জানাবেন, তাকে সামনে রেখে স্বাধীনতার জন্য আরেকবার জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেবেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকেরা জীবিত সূর্যসেনকে যেমন ভয় পেত, তেমনি ভয় পেত সূর্যসেনের মৃতদেহকেও। সেই রাতে ফাঁসি কার্যকরের পর তার মরদেহ লোহার খাঁচায় ভরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।”
সংগঠনের সভাপতি আবদুল মালেক খানের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী।
বক্তব্য রাখেন সহসভাপতি কামাল উদ্দিন, রাজীব চন্দ, আশেক মাহমুদ মামুন, যুগ্ম সম্পাদক ইমরান মুন্না, মুস্তাফিজুর রহমান বিপ্লব, মাহি আল জিসা, ইলিয়াস হায়দার, সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য নবী হোসেন সালাউদ্দিন, এম এ খালেক, রায়হান উদ্দিন, এস এম রাফি, খোরশেদ আলম হিরু, কোহিনুর আকতার মুন্নী, সুমন দাশ।
সংক্ষেপে সূর্যসেন
১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নে জন্ম হয় সূর্যসেনের। ১৯২১ সালে কিছু তরুণ চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন। ‘ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী, চট্টগ্রাম শাখা’ গঠন করে সশস্ত্র এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন সূর্যসেন।
১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে মাস্টারদার নির্দেশে ও অনন্ত সিংহের নেতৃত্বে প্রকাশ্য দিবালোকে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের কোষাগার লুট করা হয়।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ হয়। নগরীর দামপাড়া এলাকায় তৎকালীন পুলিশ ব্যারাকের অস্ত্রাগার দখল করে নেন বিপ্লবীরা। সেখানেই অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এরপর চার দিন ‘স্বাধীন’ ছিল চট্টগ্রাম। পরে ২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তিন ঘণ্টার সেই যুদ্ধে ৮২ জন ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয় এবং ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন, জালালাবাদ যুদ্ধ ও ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেওয়া এ বিপ্লবীকে ১৯৩৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক বিশ্বাসঘাতক গ্রামবাসীর সহায়তায় গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশরা।
ওই বছর অগাস্টে সূর্যসেনের ফাঁসির রায় হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে মাস্টারদা সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
ফাঁসির আগে দুইজনকেই নির্যাতন করার বিবরণ ইতিহাসের বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। সূর্যসেনের মরদেহ বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরের মাঝামাঝি অংশে নিমজ্জিত করা হয় বলেও দাবি করা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত সেই অস্ত্রাগার হচ্ছে জাদুঘর