ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই অস্ত্রাগারের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনসে তৎকালীন ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার ও ব্যারাক সংরক্ষণ করে তৈরি হচ্ছে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, চট্টগ্রাম’। যেখানে স্থান পাবে ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস।
আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে এ জাদুঘর সবার জন্য উন্মুক্ত করার আশা প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর।
“চট্টগ্রামের মানুষ হয়েও মাস্টারদা সূর্য সেন এখানে ততটা আলোচিত নন, যতটা কলকাতায়। আমরা চাই নতুন প্রজন্ম জানুক- আমাদের গর্ব করার মত একটা ইতিহাস ঐতিহ্য আছে।”
মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, পুরনো অস্ত্রাগারের আদল ঠিক রেখেই সংস্কার করা হচ্ছে। এর সাথে যুক্ত করা হচ্ছে তৎকালীন পুলিশ ব্যারাকটিও।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবীদের ভূমিকা জনগণের কাছে তুলে ধরতে সে জাদুঘরে মাস্টারদার ফাঁসির মঞ্চের আদলে একটি রেপ্লিকা তৈরি করা হবে; রাখা হবে বিপ্লবীদের ছবি।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদ্যদের ভূমিকার কথাও সংরক্ষণ করা হবে এ জাদুঘরে।
জাদুঘরের সীমানা প্রাচীরে ৮১ পুলিশ সদস্যের নাম লেখা থাকবে। পাশাপাশি নতুন করে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির পরিকল্পনাও আছে।
এ জাদুঘরে একটি বঙ্গবন্ধু কর্নার থাকবে, যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চট্টগ্রামের অংশটির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক ও তথ্য ও চিত্র থাকবে।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ প্রধান তানভীর এ জাদুঘরে ভিডিও গ্যালারি রাখার পরিকল্পনার কথাও জানান।
তিনি বলেন, “এখানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রদশর্নী করার ইচ্ছে আছে আমাদের। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত আমন্ত্রণ জানানো হবে।”
১৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা এ জাদুঘরে তৎকালীন বৃটিশ স্থাপত্য ঠিক রেখেই সংস্কারের কাজ চলছে। তবে পুলিশ ব্যারাকের পেছনে একটি স্থাপনা তৈরি করে এর আকার বাড়ানো হচ্ছে।
জাদুঘরটি উন্মুক্ত থাকবে সবার জন্য। তবে প্রবেশ ফি দিয়ে ঢুকতে হবে। পুলিশ লাইনসের ফটকের পাশে আলাদা একটি ফটক তৈরি করা হচ্ছে দর্শনার্থীদের জন্য।
তিনি লিখেছেন- “দামপাড়ার ঐ পুলিশ রিজার্ভ ব্যারাক তখন সর্বাধিনায়ক সূর্য সেনের প্রধান দফতর করা হল। গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ প্রভৃতি নেতারা সেখানেই বিপ্লবীদের রাইফেল শিক্ষা দিতে থাকেন। এর পূর্বে বিপ্লবীদের কোনো রাইফেল ছিল না। তারা কেবল রিভলভার, পিস্তল আর সাধারণ বন্দুকের ব্যবহার শিখতে পেরেছিল। পাহাড়তলী অস্ত্রাগার ও রিজার্ভ ফোর্স থেকে সংগৃহীত রাইফেল ও আর গুলি প্রচুর পেয়ে আগের কার্টিজান, পুরনো রিভলবার, পিস্তল সব ফেলে দিয়ে ওয়াবলি ও কোলট রিভলবার সবার হাতে আর কোমরে উঠেছে।”
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদার নেতৃত্বে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ দামপাড়ার এই অস্ত্রাগার, পাহাড়তলীর রেলওয়ে অস্ত্রাগার, নন্দনকান টিঅ্যান্ডটি অফিসসহ একযোগে একাধিক স্থানে হামলা চালায়।
২২ এপ্রিল জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের সাথে ব্রিটিশ সৈন্যদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এতে ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন। নিহত হয় ৮২ জন ব্রিটিশ সেনা।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ঘটনায় করা মামলায় মাস্টারদার সন্ধান চেয়ে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। পরে ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা ও তারকেশ্বর দস্তিাদারকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের ঘটনায় ফাঁসি, পুলিশের গুলি, গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতন ও গ্রেপ্তার পরবর্তী অসুস্থতায় মোট ৫৪ জন বিপ্লবী শহীদ হন। চট্টগ্রামে যুব বিদ্রোহের স্মৃতি বিজড়িত কোনো জাদুঘর এখনো নেই।
‘ইতিহাসের খসড়া’র সম্পাদক ও গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন যারা, তাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ সুপার এম শামসুল হক, দুর্নীতি দমন বিভাগের উপ-পরিচালক নাজমুল হক, দামপাড়া পুলিশ লাইন্সের রেঞ্জ ইন্সপেক্টর আকরাম হোসেন ও কোতোয়ালি থানার ওসি আব্দুল খালেক।
“দামপাড়া পুলিশ লাইনসে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এই কর্মকর্তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়।”