বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ১২ বৈশাখ মঙ্গলবার বলী খেলা হবে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে; তিন দিনের মেলা শুরু সোমবার।
Published : 23 Apr 2023, 10:13 PM
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক আব্দুল জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে তিন দিনের বৈশাখী মেলা সোমবার শুরু হচ্ছে। ইতোমেধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে থেকে দোকানিরা উৎসবস্থলে আসা শুরু করেছেন।
সোমবার থেকে মেলা শুরু হলেও মূল আকর্ষণ জব্বারের বলী খেলা হবে মঙ্গলবার বিকালে। এ বছর খেলার ১১৪তম আসর বসছে।
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী ১২ বৈশাখ নগরীর লালদিঘী মাঠে প্রতিবছর এই বলী খেলা হয়। আর মেলায় রেওয়াজ অনুযায়ী দোকানিরা প্রতিবছর বসেন একই স্থানে।
কোতোয়ালি থানা মোড় থেকে জেল রোড, লালদিঘী হয়ে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল ও সিনেমাপ্যালেস মোড় পর্যন্ত মাঠের আশেপাশের প্রায় দেড় বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ঐতিহ্যবাহী এই মেলা বসে।
চট্টগ্রামবাসীও তাই অপেক্ষায় থাকে এই মেলার জন্য। যেখান থেকে তারা সংগ্রহ করেন গৃহস্থালি সামগ্রী, ঘর সাজানোর পণ্য।
মাটির তৈরি তৈজসপত্র, খেলনা, ফুলদানি ও পুতুল, বেত-কাঠ ও বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র, হাতপাখা, মাছ ধরার পলো, ডালা, কুলো, গাছের চারা, মুড়ি মুড়কি, পাটি, দা-বটি, ছুরিসহ হেন পণ্য নেই যা মেলায় পাওয়া যায় না। মেলা ঘিরে শিশুরাও আনন্দে মেতে ওঠে।
এ নিয়ে কথা হয় মেলা কমিটির আহ্বায়ক, ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারীর সঙ্গে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল নিয়ে মেলায় আসা দোকানিদের মেলায় নিরাপত্তা বজায় রাখতে বলা হয়েছে। দোকানিদের পুলিশ প্রশাসন ও মেলা কমিটি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী যুগযুগ ধরে বংশপরম্পরায় এ মেলায় আসেন। যারা যেখানে আগে বসতেন, সেখানেই সবাই বসে পড়েন। এটাই মেলার একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে রোববার লালদিঘী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বলী খেলার মূল মঞ্চের সাজসজ্জার কাজ চলছে মূল মাঠে। আর বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দোকানিরা রাস্তায় তাদের দোকানের মালামাল সাজাতে ব্যস্ত।
ঢাকা থেকে টব, শো-পিসসহ মাটির নানা রকমের জিনিস নিয়ে এসেছেন মো. রুবেল ও দীপু শেখ নামে দুই দোকানি। তাদের মধ্যে রুবেল টবে রঙ করতে আর দীপুকে মাটিতে আয়না বসানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে।
কাজের ফাঁকে রুবেল জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বরে তাদের দোকান। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা বলী খেলার বৈশাখী মেলায় দোকান বসান। যার জন্য আগে থেকেই তারা প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
“দুই বছর মেলা বন্ধ ছিল। গত বছর এসেছিলাম, বিকিকিনি ভালো হয়েছে। তাই এ বছরও এসেছি, আশা করছি ভালোই হবে।”
তার অংশীদার দীপু শেখ বলেন, এ মেলায় মাটির জিনিসের ভালোই চাহিদা থাকে। সারা বছর ঢাকায় ব্যবসা করলেও চট্টগ্রামের বলী খেলার মেলার জন্য তাদের আগাম প্রস্তুতি থাকে।
“এ মেলার আগে আমরা বিভিন্ন ধরনের মাটির জিনিস সংগ্রহ করে থাকি। তবে এ বছর চাহিদা অনুযায়ী কম জিনিস সংগ্রহ করতে পেরেছি। এসব মৃৎশিল্প বিক্রির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বেশির ভাগ পেশা ছিড়ে দিচ্ছে। যারা আছে তারা আবার এর পাশাপাশি অন্যান্য কাজে জড়াচ্ছে। এ জন্য যতটুকু মালামাল আমরা আশা করেছিলাম তা সংগ্রহ করতে পারিনি।”
এদিকে মেলায় চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে বেশি নজর ফুলের ঝাড়ু, বেতের গৃহস্থালীসহ নানা সরঞ্জামের দিকে। নগরীর পাশাপাশি বিভিন্ন উপজেলার মানুষ মেলায় আসেন বেতের তৈরি কুলা, চালুনি, মাছ ধরার চাঁইসহ নানা ধরনের গৃহস্থালির মালামাল কিনতে।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়াসহ নানা জায়গা থেকে এসব ফুল ঝাড়ু নিয়ে মেলায় আসেন দোকানিরা।
সিটি করপোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির বিপরীতে লালদিঘী মাঠের সীমানা প্রাচীরের সঙ্গে ফুটপাথে দোকান নিয়ে বসেছেন আব্দুল মান্নান নামে এক যুবক।
তার ভাষ্য, “বাপ-দাদারাও প্রতিবছর মেলায় আসতেন, এখন আমরা আসি। সারা বছর বিভিন্ন দোকানে ও খুচরা যা বিক্রি হয়, তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয় বলী খেলার মেলায়।”
নরসিংদীর শিবপুর থেকে এসব নানা ধরনের বেতের তৈরি গৃহস্থালি জিনিস নিয়ে মেলায় এসেছেন মজনু মিয়া নামে এ ব্যক্তি। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশেই তাদের দোকান।
মজনু নামে পঞ্চাশোর্ধ আরেক দোকানি বলেন, “ছোট বেলা থেকে বাবা, চাচাদের সঙ্গে এ মেলায় আসতাম। বলী খেলায় লোকজনের অনেক চাহিদা থেকে। প্রতিবছর ভালোই বেচাকেনা হয় মেলায়।”
গৃহস্থালি পণ্যের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও এ মেলায় অন্যরকম আকর্ষণ রয়েছে। কেরানীগঞ্জ থেকে ছোটদের বিভিন্ন খেলনা নিয়ে এসেছেন মিজান গাজী ও আলমগীর নামে দু্ই ব্যক্তি।
তারা জানান, প্রতিবছর তারা আগে থেকেই প্রস্ততি নিতে থাকেন মেলার জন্য। এ মেলায় ভালোই বিক্রি হয়। শিশুদের অনেক আগ্রহ থেকে এ মেলায়।
পাশাপাশি এ মেলায় মুড়ি, মুড়কি, ভাজা পোড়া, নিমকিসহ নানা রকমের খাদ্য পণ্য পাওয়া যায়; আর তাই নিয়ে এসেছেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর গণেশ বৈরাগী।
তিনি বলেন, বংশ পরম্পরায় তারা প্রতিবছর এ মেলায় দোকান বসান। আসার সময় তারা কিছু মালামাল নিয়ে আসেন, আবার মেলায় বসেও তৈরি করেন।
আব্দুল জব্বার স্মৃতি বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা আয়োজন কমিটির সদস্য সচিব ও আব্দুল জব্বারের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল জানান, বলী খেলার সার্বিক প্রস্তুতি তাদের শেষ হয়েছে।
“গতকাল রাত থেকেই বিভিন্ন মালামাল নিয়ে দোকানিরা আসা শুরু করেছেন। দুই বছর মেলা বন্ধ থাকায় গতবছর অনেকেই আসেননি। এ বছর দোকানের পরিমাণ বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।”
বাদল বলেন, অন্যান্য বছর রাস্তায় যানজটের একটা বিষয় থাকে। তবে এবার সেটা হবে না। ঈদের ছুটিতে মেলায় হওয়ায় যানজট হবে না।
কাউকে টাকা না দিতে দোকানিদের সতর্ক করে মাইকিং
মেলা কমিটির সদস্য সচিব শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এ মেলায় দোকানিরা আসেন। তাদের কারও কাছ থেকে মেলা কমিটি কোনো টাকা সংগ্রহ করে না। তারা বিনা পয়সায় এখানে ব্যবসা করবে।
“যার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। আবার পুলিশের পক্ষ থেকেও পোস্টারিং করা হয়েছে যাতে কাউকে কোনো টাকা দেওয়া না হয় দোকানের জন্য।”
তবে অনেকে দোকানির অভিযোগ, মেলা কমিটিকে টাকা দিতে না হলেও অনেকেই নানা অজুহাতে দোকানগুলো থেকে টাকা নিয়ে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে কোনো দোকানি নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
শনিবার বিকালে জেলা পরিষদ মার্কেটের উপর থেকে এক ব্যক্তিকে মার্কেটের সামনে কোনো মালামাল না রাখতে দোকানিদের বলতে দেখা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকানি জানান, ওই ব্যক্তি মূলত টাকার জন্যই সেখানে দোকান বসাতে দিতে নিষেধ করছেন। টাকা দিলে তিনি সেখানে বসতে দেবেন।
তবে দোকানির সঙ্গে কথা বলতে দেখে ওই ব্যক্তি মার্কেটের উপর থেকে দ্রুত সরে যান।
বলী খেলা মঙ্গলবার
২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল তিন দিনের বৈশাখী মেলার দ্বিতীয় দিন ২৫ এপ্রিল বসবে বলী খেলার ১১৪তম আসর।
শতবর্ষী এ খেলার আসর শুরু থেকেই বসতো লালদিঘী মাঠে। কিন্তু মাঠের সংস্কারের কারণে গতবার বলী খেলা হয়েছিল সড়কে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে। এ বছর পুনরায় মাঠে ফিরেছে বলী খেলা।
এর আগে কোভিড মহামারীর কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে খেলা ও মেলা বন্ধ ছিল।
শওকত আনোয়ার বাদল জানান, মাঠে তৈরি করা মঞ্চে খেলা হবে। কিন্তু মেলা বসতে পারবে না। মেলা থাকবে সড়কে। মাঠে বলী খেলার মঞ্চের পাশাপাশি শুধু দেশীয় ঐতিহ্য হিসেবে নাগরদোলা থাকবে।
আর কোনো আলাদা মঞ্চ তৈরি করা হবে না। মাঠে যে মঞ্চ তৈরি হয়েছে অতিথিরা সেখানেই বসবেন বলে জানান বাদল।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ‘বলীরা’ যোগাযোগ শুরু করেছেন। মঙ্গলবার বিকালে সবাই আসবেন।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলী খেলার উদ্বোধন করবেন; পুরস্কার বিতরণ করবেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম।
ব্রিটিশ শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯০৯ সালে স্থানীয় আব্দুল জব্বার সওদাগর লালদিঘী মাঠে কুস্তি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রামবাসীসহ সারা দেশের মানুষের কাছে এটি আব্দুল জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি পায়।
বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে ১২ বৈশাখ নগরীর লালদিঘী মাঠে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় এই খেলা।
আরও পড়ুন