অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে করা সেই টাইমড আউট নিয়ে নিজেদের মতামত জানালেন ক্রিকেট ইতিহাসের দুই যুগের দুই কিংবদন্তি স্যার ভিভ রিচার্ডস ও আরাভিন্দা ডি সিলভা।
Published : 16 Nov 2023, 03:55 PM
মঞ্চের ঠিক সামনের টেবিলেই বসেছিলেন স্যার ভিভ রিচার্ডস। তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজনের জটলা। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর তার সঙ্গে কথা বলার ফুরসত মিলল। বাংলাদেশের সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে সৌজন্য বিনিময়ের পর অবধারিত প্রশ্নটাই ছুটে গেল তার দিকে, ‘বাংলাদেশের খেলা দেখার সুযোগ হয়েছে? কেন এতটা খারাপ হলো বলে মনে হয়?’ রিচার্ডস খুব বিস্মিত হওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “আমি কীভাবে বলব! তুমি বাংলাদেশের সাংবাদিক, আমিই তো তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই। বলো তো, কেন এরকম হলো বাংলাদেশের?”
পাল্টা প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে খেই হারানোর দশা তখন। নিরীহ একটা লেংথ ডেলিভারিই ছিল। রিচার্ডস সেটিতেই যেন চাবুকের মতো ব্যাট চালিয়ে পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারিতে!
বাংলাদেশের বিপর্যয়ের কারণ দু-এক লাইন শুনলেন তিনি। তারপর মনোযোগ দিলেন অন্য দিকে। বাংলাদেশের খেলা খুব বেশি দেখেননি। তাই মন্তব্য করতে চান না। তবে অনুষ্ঠান শেষে আরেক দফা ছোট্ট আলোচনায় তিনি নিজে থেকেই বলে উঠলেন, “শোনো, সাকিব সেদিন যা করেছে, তা আমি একদমই পছন্দ করিনি। আমার ভালো লাগেনি তা।”
‘যা করেছে’ মানে কোনটি বোঝাচ্ছেন, বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে ‘টাইমড আউট’ করার রেশ আছে এখনও!
ব্যস, তার কাছ থেকে আশকারা পেয়ে আরেকটু গল্প করার সুযোগ হয়ে গেল!
আয়োজনটি ছিল আইসিসি হল অব ফেম-এ তিন ক্রিকেটারের অন্তর্ভুক্তি। এই দফায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আরাভিন্দা ডি সিলভা, ভিরেন্দার শেবাগ ও ডায়না এডুলজিকে। মুম্বাইয়ের একটি পাঁচ তারকা হোটেলে দারুণ এক আয়োজনে বরণ করে নেওয়া হয় তাদের। তারার মেলা বসেছিল সেদিন। ইয়ান বিশপের সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে ছিলেন রিকি পন্টিং, শন পোলক, ম্যাথু হেইডেন, শেন ওয়াটসন, হার্শা ভোগলেসহ আরও অনেক তারকা। তবে ধ্রুবতারা ছিলেন যেন ভিভ রিচার্ডস!
তারকাদেরও তারকা তিনি। সবাই গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছেন, তাকে ঘিরে জটলা পাকাচ্ছেন। স্বয়ং আরাভিন্দা ডি সিলভা, যিনি নিজেই এক কিংবদন্তি ও হল অব ফেম-এ জায়গা পেলেন এবার, তিনিও বললেন যে, এই আয়োজনে এসে তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগছে তার নায়ক ও আদর্শ ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে দেখা হয়ে এবং এক টেবিলে বসে আড্ডা দিতে পেরে।
রিচার্ডসের আবেদন এমনই। সর্বকালের সেরাদের ছোট্ট তালিকাতেও তাকে রাখতে হয়। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে দাগ কেটে আছেন তিনি মূলত তার ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণে। এই যে ডি সিলভা বা শেবাগ, কিংবা নব্বই দশক বা এরপরের যত আগ্রাসী ব্যাটসম্যান, প্রায় সবার কাছেই আদর্শ এবং আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের শেষ কথা ভিভ রিচার্ডস।
তার যে রেকর্ড ও সত্তর-আশির দশকেও যে স্ট্রাইক রেট, তাতেই আসলে অনেকটা ফুটে ওঠে তিনি কেমন ছিলেন। তবে স্রেফ পরিসংখ্যানের সাধ্য নেই তার বিশালত্বকে ফুটিয়ে তোলার। ব্যাটিং দিয়ে তিনি গুঁড়িয়ে দিতেন প্রতিপক্ষের বোলিং, শরীরী ভাষা দিয়ে ধ্বংস করে দিতেন প্রতিপক্ষের মনোবল।
বলা হয়, চুইংগাম চিবুতে চিবুতে যখন তিনি মাঠে ঢুকতেন, বোলারদের শিরদাড়া বেয়ে নাকি শীতল স্রোত বয়ে যেত। বৃত্তের ভেতরে থাকা ফিল্ডাররা নাকি এক পা-দু পা করে পেছাতে থাকতেন। তারা তো জানতেন, রিচার্ডসের ব্যাট থেকে বল কত জোরে তাদের দিক আসবে!
সেই রিচার্ডসের ভক্ত যে তারকারাও, এতে আসলে অবাক হওয়ার খুব বেশি কিছু নেই। তার সঙ্গে টুকটাক কথার ফাঁকে মনে হলো, ভালোবাসাটা জানিয়ে রাখার সুযোগ তো এই!
“আমরা আপনাকে ‘কিং’ বলে ডাকি, ‘কিং ভিভ’…” এটুকু শুনে আবার তিনি মুখের দিকে তাকালেন। একটু ক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “কিং তো এখন কোহলি, তাকেই এখন এই নামে ডাকতে পারো।”
কোহলির ৫০তম ওয়ানডে সেঞ্চুরির আগের রাত সেটি। পরে সেঞ্চুরির সময়ও ধারাভাষ্যে রিচার্ডস বলেছেন, কোহলিকে তিনি কতটা পছন্দ করেন। অবশ্য আগেও বলেছেন নানা সময়ে।
সেই সময়ের আলোচনা পর্ব অল্পতেই। পরে অনুষ্ঠান শেষে আরেক দফা তার কাছে যাওয়ার পর তো নিজ থেকেই সাকিবের টাইমড আউটের কথা বললেন।
সাকিব যে নিয়ম ভেঙেছেন, সেটা অবশ্য বললেন তিনি। তবে তার আপত্তি অন্য জায়গায়, “হ্যাঁ, এটা নিয়মের মধ্যে আছে। সেদিক থেকে সে ঠিক আছে। তবে স্পিরিট বা এই ধরনের ভাবনা থেকে কাজটা ঠিক করেনি…।”
‘আপনার সুযোগ এলে আপনি কী করতেন?”- এই প্রশ্নটিও করা হলো তাকে। তিনি আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বললে?’
তার কথার ধরনে একটু ভড়কে যেতেই হলো। তারপরও আরেকবার বলতেই হলো। তিনি হাঁটা দিলেন উল্টো দিকে, স্রেফ বলে গেলেন, “নাহ, প্রশ্নই আসে না…!”
রিচার্ডসের কথা শোনার পর খানিকটা ভিন্ন ভাবনার খোরাক পাওয়া গেল আরাভিন্দা ডি সিলভার কাছ থেকে। ম্যাথিউসের দেশেরই সাবেক ক্রিকেটার তিনি, সাবেক অধিনায়কও। এই আউট নিয়ে তার বক্তব্যের তো বাড়তি একটু গুরুত্ব থাকেই।
এই আউট করায় সাকিবের সমালোচনা কম হয়নি। শ্রীলঙ্কায় তো তুমুল আলোড়ন তুলেছে তা। ম্যাথিউসের ভাই এমনকি হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন যে শ্রীলঙ্কায় খেলতে গেলে সাকিবকে পাথর ছুড়ে মারা হবে।
তবে শ্রীলঙ্কারই কিংবদন্তি ডি সিলভা বরং সাকিবের দারুণ প্রশংসাই করলেন।
“এটা তো নিয়মের মধ্যেই আছে এবং আমার মনে হয়, আমাদের বরং ওকে কৃতিত্ব দেওয়া উচিত যে সে পরিস্থিতি বুঝতে পেরেছে এবং আবেদনও করেছে। পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন ছিল সে। সেদিক থেকে কৃতিত্ব তার প্রাপ্য।”
তবে খেলার চেতনা বা মূল্যবোধ নিয়ে ডি সিলভা অবশ্য রিচার্ডসের সঙ্গে অনেকটা একমত। তিনি আঙুল তুললেন আম্পায়ারদের দিকেও।
“স্পোর্টিং ম্যানারের দিক থেকে, আমার মনে হয় এসব ক্ষেত্রে দুবার ভাবা উচিত। আর আম্পায়ারের উচিত ছিল ব্যাপারটা সামলানো, সত্যিকারের পরিস্থিতিটা বোঝা এবং আরেকটু বেশি প্র্যাকটিক্যাল হওয়া।”
আউটের ধরনটাই এমন। এটা নিয়ে আলোচনা-হইচই চলবেই। নানা মত আসবেই। সেখানে সাধারণ ক্রিকেট অনুসারীদের নানা মতের স্রোত যেমন থাকবে, তেমনি কিংবদন্তিদের মতামতের ভেদাভেদও থাকবে। তবে সাকিব নিশ্চিত করে ফেলেছেন, তাকে নিয়ে আলোচনা হবে অনেক অনেক দিন।