তারার মেলায় স্মৃতির ভেলায় শেবাগ-ডি সিলভা-এডুলজি

আইসিসি হল অব ফেম-এ তিন গ্রেট ক্রিকেটারের অন্তর্ভুক্তির ঝলমলে আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন ভিভ রিচার্ডস, রিকি পন্টিং, ম্যাথু হেইডেনসহ আরও অনেক তারকা, সবাই মিলে ডুব দিলেন তাদের গৌরবময় অতীতে।

আরিফুল ইসলাম রনিআরিফুল ইসলাম রনিমুম্বাই থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Nov 2023, 07:25 AM
Updated : 15 Nov 2023, 07:25 AM

“দেড়শ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাস, কত শত ক্রিকেটার খেলেছেন, এখনও পর্যন্ত মাত্র ১১২ জন হল অব ফেম-এ জায়গা পেয়েছেন, আপনি তাদের মধ্যে সাম্প্রতিকতম, কেমন লাগছে?”- বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতেই প্রশ্নটি করলেন সঞ্চালক ইয়ান বিশপ। প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ভিরেন্দার শেবাগের ত্বরিত উত্তর, “আমার তো মনে হয়, আমাকে একটু দেরিতেই নেওয়া হলো…!” 

মুহূর্তেই হাসি আর করতালিতে ফেটে পড়ল গোটা হলরুম। ইয়ান বিশপ নিজেও বুঝে উঠতে পারছিলেন না, কী বলবেন। পরে আইসিসির এক কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “টেক নোট…।” সেই কর্মকর্তাও হেসেই খুন! পাশ থেকে কেউ একজন বললেন, “টিপিক্যাল শেবাগ…।” 

হ্যাঁ, শেবাগ এরকমই। ব্যাট হাতে যেমন তিনি দুনিয়ার কোনো বোলারকে পাত্তা দিতেন না, মাইক্রোফোন হাতেও তেমনি নিজের মনের কথা বলে দিতে পিছপা হন না। একটু পার্থক্য অবশ্য আছে। ২২ গজে তিনি বিনোদনের পসরা সাজাতেন। মাইক্রোফোনের সামনে তার কথা কখনও আনন্দদায়ী, কখনও আবার তা উসকে দেয় বিতর্ক, চোট লাগে অনেকের। তবে তিনি সেসব নিয়ে ভাবলে তো! 

আইসিসি হল অব ফেম-এ নতুন তিনজনের অন্তর্ভুক্তির এই অনুষ্ঠানেও সেই চেনা শেবাগকেই দেখা গেল। 

ভারতীয় এই গ্রেটের সঙ্গে এই দফায় হল অব ফেম-এ জায়গা পেয়েছেন শ্রীলঙ্কান কিংবদন্তি আরাভিন্দা ডি সিলভা ও ভারতের নারী ক্রিকেটের অগ্রদূত ডায়না এডুলজি। মুম্বাইয়ের এক পাঁচ তারকা হোটেলে নান্দনিক এক আয়োজনে বরণ করে নেওয়া হয় এই তিনজনকে। আলো ঝলমলে রাতে যেন তারার মেলা বসেছিল ওই হলরুমে। বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছিলেন সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের একজন স্যার ভিভি রিচার্ডস। বিশ্বকাপে ধারাভাষ্য দিতে আসা রিকি পন্টিং, শন পোলক, ম্যাথু হেইডেন, শেন ওয়াটসন, জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলে ও আরও অনেকের আনন্দময় উপস্থিতি ছিল সেখানে। সব মিলিয়ে হলরুমের নানা প্রান্তে ঝিকমিক করছিল কত যে তারা! 

তবে সবচেয়ে মাতিয়ে রাখলেন শেবাগই। হল অব ফেম-এ জায়গা পাওয়া তিন নায়কের আলাদা করে আলোচনা পর্ব ছিল সঞ্চালক বিশপের সঙ্গে। তিনজনই ডুব দিলেন স্মৃতিময় অতীতে। সেখানে শেবাগের সঙ্গে পর্বটি হলো তার ব্যাটিংয়ের মতোই ‘ব্লকবাস্টার।’ দারুণ সব গল্প শোনালেন, মজা করলেন, সুযোগ পেলেই খোঁচা মারলেন পন্টিং-পোলকদের, আরও যে কত খুনসুটি! 

ক্রিকেট কোচরা শেখাতেন ‘ভি’-তে খেলতে। অর্থাৎ, সোজা ব্যাটে খেলতে হবে। মিড অন ও মিড অফ ফিল্ডারের মাঝখান দিয়ে ফাঁক খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু শেবাগ কোচকে বলেছিলেন, “আমার মাথা আর আকাশের মধ্যে তো ফাঁক আরও বেশি!” মানে, তিনি উড়িয়ে মারতে চান। এটাই তার নিজস্ব ক্রিকেট ব্যাকরণ। গল্পটি বলছিলেন হার্শা ভোগলে। শেবাগ হাসিমুখে সায় দিলেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি।’

নিজের ব্যাটিং দর্শন নিয়ে পুরোনো কথাটি আবার শোনালেন নতুন করে, “বল দেখো আর মারো, ব্যস! বল জিনিসটা পেটানোর জন্যই…।” 

বরাবরই তিনি মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান ছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলেন সেখানেই। তবে খুব সুবিধা করতে পারছিলেন না। ২০০১ সালে শ্রীলঙ্কায় ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে সাচিন টেন্ডুলকার না থাকায় তাকে ওপেনিংয়ে তুলে আনেন সেই সময়ের অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। প্রথম দুই ম্যাচে করেন ৩৩ ও ২৭। পরের ম্যাচেই ৬৯ বলে সেঞ্চুরি! ব্যস, ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান ক্রমে। 

তার শারীরিক গড়নে অনেকটাই মিল ছিল টেন্ডুলকারের সঙ্গে। হেলমেটের ভেতর তার মুখায়বেও পাওয়া যেত মিল। এসব নিয়ে তখন অনেক আলোচনা হচ্ছিল। কিন্তু শেবাগ বললেন, তিনি তখনই নিজের পথ খুঁজে নেওয়ার কথা ভেবেছেন। 

“টেন্ডুলকারের সঙ্গে তুলনা তো অসাধারণ। তবে আমি বুঝে গিয়েছিলাম, আমাকে টেন্ডুলকারের মতো লাগতে পারে, আমি তার মতো খেলতে পারি, কিন্তু তার মতো পারফর্ম করা সম্ভব নয়। এজন্য ভেবেছি, আমাকে শেবাগই হতে হবে।” 

যেভাবে তিনি ক্রিকেটের ব্যাকরণ আর চিরায়ত ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যাটিং করেছেন, তার ক্যারিয়ারের শুরুতে অনেকেই ভাবতে পারেননি যে তিনি ভালো টেস্ট ব্যাটসম্যানও হতে পারেন। সেই তিনি সাদা পোশাকেও দারুণ সফল, সবচেয়ে ভালো রেকর্ড তার ক্রিকেটের আদি সংস্করণেই। 

টেস্ট ক্রিকেটে তার যাত্রাই শুরু হয়েছিল সেঞ্চুরি দিয়ে। সেটিও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো চ্যালেঞ্জিং কন্ডিশনে, প্রতিপক্ষের পেস আক্রমণে সেই ম্যাচে পাঁচ পেসার- শন পোলক, ন্যান্টি হেওয়ার্ড, মাখায়া এনটিনি, ল্যান্স ক্লুজনার ও জ্যাক ক্যালিস। ভারত ৬৮ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর উইকেটে গিয়ে তিনি করেছিলেন সেঞ্চুরি। সাচিন টেন্ডুলকারের সঙ্গে গড়েছিলেন ২২০ রানের জুটি।

সেই সেঞ্চুরির গল্প শোনাতে গিয়ে বেশ এক চোট মজা করলেন শন পোলককে নিয়ে। 

“অভিষেক সেঞ্চুরি শন পোলকের দলের বিপক্ষে। ওর সঙ্গে এখন আমি বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করি, আমাকে নিয়ে ভালো ভালো কথা বলে। সেদিন যখন আমি গেলাম, স্লেজিংয়ের তোপ ছুড়ছিল শুধু। আমি ভড়কে যাইনি, কারণ আমার সঙ্গে ক্রিজে ছিলেন টেন্ডুলকার। তিনি আমাকে বললেন, ‘ওরা স্লেজিং করবে বটে, তবে বেশ নরমও আছে। তুমি কিছু শট খেললেই দেখতে ওরা চোক করবে, ঢিল দিয়ে দেবে।’  আমি তাই ওদের কথায় কান না দিয়ে বলে চোখ রাখলাম।” 

“টেন্ডুলকার আমাকে একটি কথা বলেছিলেন যে, ‘ওরা তিন স্লিপ, এক গালি রেখেছে। কাভার ফাঁকা। আরও অনেক ফাঁকা জায়গা। তুমি মারার জায়গা পাবে। ওয়ানডেতে যেভাবে খেলো, সেভাবেই খেলে যাও।’ ব্যস, আমিও সেভাবেই খেললাম এবং সেঞ্চুরি হয়ে গেল। সেঞ্চুরির পর আমার উইকেট নিতে দিলাম পোলককে…।”

অভিষেক সেঞ্চুরির পর তৃতীয় ও চতুর্থ টেস্টেও ফিফটি করেন তিনি মিডল অর্ডারে। তবে তখন তারকায় ঠাসা ভারতের মিডল অর্ডারে তাকে জায়গা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। ২০০২ সালের ইংল্যান্ড সফরে টেস্টেও তাকে ওপেনিংয়ে তুলে আনা হয়। ব্যাটিং পজিশন বদলের প্রেক্ষাপটও ছিল চমকপ্রদ। শেবাগ সেই গল্প শোনালেন বিস্তারিত। 

“ইংল্যান্ডে গিয়ে দাদা (সৌরভ) আমাকে বললেন, ওপেন করতে হবে। আমি বললাম, ‘দাদা, তুমি তো ওয়ানডেতে ওপেন করো। তুমি টেস্টেও করতে পারো ওপেন! আমি কেন করব?’ তখন দাদা বললেন, ‘আমি অধিনায়ক, আমাকে সরতে বলিস!’ তখন আমি বললাম যে, ‘তাহলে টেন্ডুলকার তো ওয়ানডেতে ওপেন করে এত সফল, তাকে বলো টেস্টে ওপেন করতে!” দাদা বললেন, ‘তুই গিয়ে টেন্ডুলকারকে বল। সে রাজি হলে ওপেন করবে, তুই চারে খেলবি..।’ আমি পড়ে গেলাম বিপদে! টেন্ডুলকারকে আর বলিনি।” 

“পরে আমি একটি কাগজ এনে দাদাকে বললাম, ‘তুমি এখানে লিখে দাও যে আমি যদি ওপেনিংয়ে ৫-৬ ইনিংস ব্যর্থ হই, তাহলে দল থেকে বাদ দেবে না। আবার মিডল অর্ডারে খেলাবে। তুমি কথা ঘুরিয়ে ফেলো, কাজেই লিখে দিতে হবে, আমি প্রমাণ রাখব।’ দাদা তখন সত্যিই এটা লিখে দিয়েছিল।”

প্রথমবার ওপেন করতেই নেমেই লর্ডসে খেলেন ৯৬ বলে ৮৪ রানের ইনিংস। পরের টেস্টে ট্রেন্ট ব্রিজে সেঞ্চুরি। ব্যস, সৌরভের লিখে দেওয়া সেই কাগজের প্রয়োজন আর হয়নি! 

তবে তাকে ওপেনিংয়ে আনার পেছনে আরেকজনের ভূমিকার কথাও বললেন শেবাগ, যেটা আগে খুব বেশি লোকের জানা ছিল না।

"অনেকেই এটা জানেন না, আজকেই সম্ভবত প্রথম বলছি, আমাকে ওপেনিংয়ে তুলে আনার পেছনে জাহির খানের বড় ভূমিকা আছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে জাহির, আজিত আগারকারদের বোলিংয়ের বিপক্ষে সবুজ উইকেটে একটি ম্যাচে ওপেন করে ১৮০ করেছিলাম। সেটা দেখেই তার মনে হয়েছিল, আমি ওপেনিংয়ে ভালো করব। দাদাকে (সৌরভ) সেটাই বলেছিল সে।"

সেই শেবাগ আরও রাঙিয়েছেন টেস্ট ক্রিকেট। পরে প্রথম ভারতীয় হিসেবে শুধু ট্রিপল সেঞ্চুরিই করেননি, টেস্ট ইতিহাসে একাধিক ট্রিপল সেঞ্চুরি করা স্রেফ চার ব্যাটসম্যানের একজন তিনি। 

সেই ট্রিপল সেঞ্চুরি নিয়েও মজার একটি গল্প শোনালেন শেবাগ। 

“ভিভিএস লাক্সমান যখন ২৮১ রানের রেকর্ড গড়েন, এর কিছুদিন পরই তাকে আমি বলেছিলেন, এই রেকর্ড আমি ভেঙে ফেলব। ট্রিপল সেঞ্চুরি করব। লাক্সমান তো হেসেই অস্থির। আমাকে বললেন যে, ‘তুমি তো টেস্ট ক্রিকেটই খেলো না!’ আমি বলেছিলাম, ‘আমি টেস্ট খেলব এবং ট্রিপল করব।’ 

“এরপর যখন সত্যিই ট্রিপল করলাম, সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলেন তিনিই। আমি তো সেই ঘটনা ভুলেই গিয়েছিলাম। কোনো কিছু ৮ মিনিটের বেশি মনে রাখতে পারি না আমি। পরে ভিভিএস এসেই আমাকে মনে করিয়ে দিল যে আমি বলেছিলাম ট্রিপল করব।” 

দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি, একটি ২৯৩, আরেকবার ২৫৪ ও আরও দুটি ডাবল সেঞ্চুরি থাকলেও তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস অনেকেই মনে করেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নের ১৯৫। বক্সিং ডে টেস্টের প্রথম দিনেই অস্ট্রেলিয়ান বোলিং গুঁড়িয়ে ২৫ চার ও ৫ ছক্কায় ইনিংসটি খেলেছিলেন তিনি। যথারীতি অমন বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের পেছনেও গল্প আছে তার। 

“সেঞ্চুরি আমি যতোই করি, দেখি যে খবরের শিরোনামে থাকে সাচিন, রাহুল দ্রাবিড়, লাক্সমানদের নাম। তারা বড় তারকা, তাদের সেঞ্চুরি প্রাধান্য পায়। আমি ঠিক করলাম, আমাকে এমনভাবে সেঞ্চুরি করতে হবে যে আমার দিকে সবার চোখ পড়ে। ব্যস, বক্সিং ডেতে চা বিরতির আগে ১৯৫ করে ফেললাম। শিরোনামেও আমাকে আনা হলো!” 

তার বোলিংয়ের প্রসঙ্গও এলো। ক্যারিয়ারের শুরুতে তো অফ স্পিনিং অলরাউন্ডারই ছিলেন। পরেও তার বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং ছিল বেশ কার্যকর। মজা করেই তাকে প্রশ্ন করা হলো, “অধিনায়করা কি তাকে বোলিং কম দিয়েছেন? আরেকটু বেশি ব্যবহার করা যেত তাকে?” তার উত্তরে মিশে থাকল মজা।

“নাহ, ঠিক আছে। আমার কাঁধের অস্ত্রোপচার হলো। এরপর বোলিং করাটা কঠিনই ছিল। তবে যা করেছি, তা তো কম নয়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে ৫ উইকেট নিয়েছি! এই যে এখানে রিকি (পন্টিং), ম্যাটি (হেইডেন) বসে আছে, (শেন) ওয়াটসন আছে, ওদের সবাইকে আউট করেছি। অস্ট্রেলিয়ার সেরা ব্যাটসম্যানদের আউট করেছি, ফাজলামো নাকি!” 

আক্রমণাত্মক ওপেনারদের প্রসঙ্গো ডেভিড ওয়ার্নারের কথা। শেবাগ জানালেন, অস্ট্রেলিয়ান নির্বাচকদের অনেক আগেই ওয়ার্নারকে টেস্টে ওপেন করার কথা বলেছিলেন তিনি।

"২০০৯ সালে আইপিএলের সময় আমি ওকে বলেছি, 'তুমি খুব ভালো টেস্ট ব্যাটসম্যান হবে।' সে তো শুনে আকাশ থেকে পড়ল। তখনও পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে স্রেফ একটি, সেটিও মিডল অর্ডারে। টেস্ট দলের ধারে কাছে নেই। আমি তবু বলেছিলাম যে, 'দেখে নিও। তুমি টেস্টেও ভালো করবে। শুধু খেলার ধরন বদলানো যাবে না। এভাবেই খেলতে হবে।' সে ঠিকই তা করেছে পরে।"

তার গল্পের ঝুলি যেন ফুরোয় না! আরও কত যে গল্প শোনালেন!

ডায়না এডুলজি ও আরাভিন্দা ডি সিলভার কথাও শোনা হলো অনেক। সেই সত্তর-আশির দশকে, ভারতে মেয়েদের ক্রিকেট যখন চরম অবহেলিত, সেই সময়টায় এডুলজির শুরু। কতটা লড়াই তাদেরকে করতে হয়েছে, এমনকি টাকা দিয়ে খেলতে হয়েছে, বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছেন ক্রিকেটাররাই টাকা দিয়ে, সফরে গিয়ে অর্থাভাবে ট্রেনে ভ্রমণ করতে হয়েছে, প্রবাসীদের বাড়িতে দাওয়াত খেয়েছেন… সংগ্রামের কত গল্প! পরে প্রশাসক হিসেবেও তিনি এগিয়ে নিয়েছেন ভারতের নারী ক্রিকেটকে। 

তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার ২০ টেস্ট আর ৩৪ ওয়ানডের। তবে ভারতীয় ক্রিকেটে তার প্রভাব আরও অনেক বেশি। ঘরোয়া ক্রিকেটে নারীদের আলাদা দল গড়ার ভূমিকা থেকে শুরু করে বেতন বাড়ানো, আর্থিক ভিত শক্ত করা, সবকিছুতেই তার ভূমিকা বিশাল। ভারতের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে হল অব ফেম-এ জায়গা পাওয়া সেটিরই স্বীকৃতি। 

আরাভিন্দা ডি সিলভাও ফিরে গেলেন তার ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোয়। কীভাবে ভিভ রিচার্ডসকে দেখে ক্রিকেটার হওার স্বপ্ন দেখেছিলেন, ইমরান খানসহ আরও অনেকের কাছ থেকে কীভাবে প্রেরণা পেয়েছেন, গৃহযুদ্ধের দেশে কতটা লড়াই করে তাদেরকে ক্রিকেট খেলতে হয়েছে, সবই তুলে ধরলেন। 

রান-পরিসংখ্যানে কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জায়াওয়ার্দেনারা অনেক এগিয়ে। তবে এখনও অনেকের চোখে শ্রীলঙ্কার সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান ডি সিলভাই। যে সময়টায় তিনি খেলেছেন, যেভাবে খেলেছেন, এসবকে আসলে কোনো পরিসংখ্যানে আটকে রাখা যাবে না।

ক্যারিয়ারে অনেক স্মরণীয় ইনিংস তিনি খেলেছেন। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে বল হাতে ৩ উইকেট নেওয়ার পর ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরিটি যেমন। তবে সেমি-ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে যে ফিফটি করেছিলেন, অনেকের চোখেই সেটি তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলির একটি। 

সেই বিশ্বকাপের চমক দুই ওপেনার সানাৎ জায়াসুরিয়া ও রমেশ কালুউইথারানা ফিরে যান শুরুতেই। ১ রানে ২ উইকেট হারানোর পর ক্রিজে গিয়ে চোখধাঁধানো সব ক্রিকেট শটের পসরা সাজান ডি সিলভা। ইডেন গার্ডেন্সের লাখো দর্শককে স্তব্ধ করে দেন তিনি দুর্দান্ত স্ট্রোক প্লে দিয়ে। শেষ পর্যন্ত আউট হন ১৪ চারে ৪৭ বলে ৬৬ রান করে। 

সেই ইনিংসের সময় মাথায় কি খেলা করছিল? ডি সিলভার উত্তরে মিশে থাকল তার ব্যাটিং দর্শন। 

“আমি কখনও পরিস্থিতি বা চাপকে পাত্তা দেইনি। সবসময় ক্রিজে গিয়ে নিজের শট খেলতে চেয়েছি, সেই ইনিংসেও একই চেষ্টা করেছি।” 

আনুষ্ঠানিক আলোচনার বাইরেও আরও কত কত কথা হলো! এভাবেই গল্প-আড্ডা, খুনসুটি, ছবি তোলার আর স্মৃতির মেলায় হারিয়ে পেরিয়ে গেল কয়েক ঘণ্টা। 

একটা সময় মিলনমেলা ভাঙল বটে। তবে রয়ে গেল রেশ। যারাই ছিলেন ওই হলরুমে, জাদুকরি ওই রাতের আভা তাদের হৃদয় থেকে সহসাই ফুরিয়ে যাওয়ার নয়!