পাকিস্তানের পেস আক্রমণের সঙ্গে ইংলিশ ওপেনারদের লড়াইয়ের ফলাফলই গড়ে দিতে পারে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান ফাইনালের ভাগ্য।
Published : 12 Nov 2022, 06:44 PM
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সবুজ প্রান্তরে যখন ম্যাচের প্রথম ওভারটি করতে ছুটবেন শাহিন শাহ আফ্রিদি, পাকিস্তানের স্বপ্নও ছুটতে থাকবে। তার গতি ও সুইংয়ে মিশে থাকবে দলের আশার রেণু। তবে তাকে ঠিকঠাক সামলে যদি জ্বলে উঠতে পারেন জস বাটলার ও অ্যালেক্স হেলস, ট্রফির দিকে বড় এক পদক্ষেপ নেবে ইংল্যান্ড।
একটি ক্রিকেট ম্যাচে লড়াইয়ের ভেতর থাকে ছোট ছোট অনেক লড়াই। যেসব লড়াইয়ের জয়-পরাজয়ের ওপর নির্ভর করে ম্যাচের ভাগ্য। ইংল্যান্ড-পাকিস্তানের ফাইনালেও থাকবে এরকম কিছু দ্বৈরথ। এই মুহূর্তগুলো জিততে পারলেই একটু একটু করে গড়ে উঠবে ম্যাচ জয়ের সৌধ। আর সেখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ লড়াই নিঃসন্দেহে পাকিস্তানি পেসারদের সঙ্গে ইংলিশ ওপেনারদের মোকাবেলা।
এটি আগুনের জবাবে আগুনের লড়াই। স্কিল, নার্ভ আর মাথার লড়াই। নতুন বল আর পাওয়ার প্লের লড়াই। জয়ের ভিত্তি গড়ার লড়াই।
আফ্রিদি আর নাসিম শাহর হাতে চকচকে কুকাবুরার ছোবলে থাকবে মারণ বিষ। তবে বাটলার ও হেলসের জানা আছে দাওয়াই।
চোটে পড়ায় আফ্রিদির বিশ্বকাপ খেলা নিয়েই ছিল বড় শঙ্কা। দলের সেরা অস্ত্রকে নিয়ে দুর্ভাবনায় ছিল পাকিস্তানও। শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বকাপে খেলতে পারেন বটে, তবে শুরুর দিকে দেখা যায়নি চেনা রূপে। প্রথম তিন ম্যাচে উইকেট ছিল স্রেফ ১টি। ছিল না ধার। চোট কাটিয়ে ফিরে ছন্দ পেতে লড়ছিলেন পরিষ্কারভাবেই। তবে সময়ের সঙ্গে ঠিকই খুঁজে পান ছন্দ, ফিরে পান নিজেকে। সবশেষ ৩ ম্যাচে তার শিকার ৯টি!
বিপজ্জনক বাটলার ও হেলস জুটিকে দ্রুত থামানোর মূল দায়িত্ব থাকবে তার। সেটা যদি প্রথম ওভারে হয়, তাহলে তা কথাই নেই! এই কাজটা তিনি খুব ভালো পারেন। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এখনও পর্যন্ত ৭ বার স্বাদ পেয়েছেন প্রথম ওভারে উইকেটের।
নাসিমের সেরাটা এখনও দেখা যায়নি এই বিশ্বকাপে। ৬ ম্যাচে উইকেট নিতে পেরেছেন মোটে ৩টি। তবে তার প্রতিভা, গতি আর চমকে দেওয়ার সামর্থ্য নিয়ে সংশয় আছে সামান্যই। কে জানে, সেরাটা হয়তো জমা আছে ফাইনালের জন্যই।
পাকিস্তানের চাওয়া থাকবে, এই দুজনের শুরুর ২-৩ ওভারেই উইকেট শিকার করা। সেটা যদি না হয়, ঘায়েল করার বিকল্প অস্ত্রও তাদের আছে। হারিস রউফ ও মোহাম্মদ ওয়াসিমও পিছিয়ে নেই খুব একটা।
দুজনই ডানহাতি পেসার হলেও বোলিংয়ের ধরন দুই রকমের। রউফের মূল শক্তি তার গতি ও বাড়তি বাউন্স। এই মাঠও তার খুব ভালো করে চেনা। যে টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে তিনি নজর কাড়েন পাকিস্তানের নির্বাচকদের, সেই বিগ ব্যাশে তার ঘরের মাঠ এটিই। এবার বিশ্বকাপে দলের প্রথম ম্যাচে এখানেই তিনি পাওয়ার প্লেতে বিদায় করেছিলেন রোহিত শর্মা ও সূর্যকুমার যাদবকে।
ওয়াসিমের গতি অন্য তিন পেসারের চেয়ে কম। তবে নিয়ন্ত্রণ আর স্কিল তার কম নয়। পাকিস্তানের অন্য গতিময় পেসারদের সামলে অনেক ব্যাটসম্যানই ওয়াসিমকে একটু হালকাভাবে নেয় কিংবা রান তোলার সুযোগ হিসেবে দেখে। তাতে নিজেদের বিপদও তারা ডেকে আনে। এই বিশ্বকাপেই যেমন তিনি সাত উইকেট নিয়েছেন ওভারপ্রতি সাতের কম রান দিয়ে।
তবে এই পেস পরীক্ষায় পাশ করা তো বটেই, পাল্টা পরীক্ষায় ফেলার সবটুকু সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতাই আছে বাটলার ও হেলসের। বাটলার তো অনেক দিন ধরেই সাদা বলের ক্রিকেটে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। হেলসও সাড়ে তিন বছর পর দলে ফিরে হারানো সময়টাকে পুষিয়ে দেওয়ার অভিযানে ছুটে চলেছেন দৃঢ় পায়ে।
স্কিলের সঙ্গে তাদের সঙ্গী ফর্ম ও আত্মবিশ্বাসও। সেমি-ফাইনালে ভারতকে উড়িয়ে দেওয়ার পথে ১৭০ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন দুজন। সেখানে ‘কেউ কারও নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ অবস্থা। ৪৯ বলে ৮০ রানে অপরাজিত বাটলার, ৪৭ বলে ৮৬ হেলস।
তার আগের দুই ম্যাচে দুজনের উদ্বোধনী জুটির রান ছিল ৭.২ ওভারে ৭৫ ও ১০.২ ওভারে ৮১।
দুজনের ইনিংস গড়ার ধরন অবশ্য খানিকটা ভিন্ন। হয়তো পরিকল্পনা ও ভূমিকাও। বাটলার অনেক সময়ই শুরুতে একটু সময় নেন। থিতু হয়ে গেলে তার চেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান বিশ্বে নেই খুব একটা। হেলস শুরু থেকেই বোলারদের কচুকাটা করে ছুটতে থাকেন।
আসরের শুরুটা এবার ভালো করতে পারেননি তারা। তবে পরের ম্যাচগুলোয় পুষিয়ে দিয়ে ফাইনালে নামছেন ফর্মের চূড়ায় থেকেই।
টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত ৫২.৭৫ গড় ও প্রায় দেড়শ স্ট্রাইক রেটে ২১১ রান হেলসের। বাটলারের গড় পঞ্চাশের কাছে, স্ট্রাইক রেট ১৪৩.১৬। রান করেছেন ১৯৯।
দুজনই খেলতে পারেন বড় ইনিংস। তাদের একজন টিকে গেলেও গড়ে দিতে পারেন পার্থক্য। ফাইনালে তারা যদি নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারেন আফ্রিদি-নাসিমদের, পরের ব্যাটসম্যানদের কাজ সহজ হয়ে যাবে অনেকটাই।
ম্যাচের আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান অধিনায়ক বাবর আজম আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন, ইংলিশ ওপেনারদের ভোগাতে তৈরি তার পেসাররা।
“অ্যালেক্স হেলস ও জস বাটলার ভালো করেছে সেমিতে। অসাধারণ ইনিংস খেলেছে। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে সেরাটা দেওয়ার। আমাদের পেস আক্রমণ বিশ্বের সেরাগুলোর একটি। চেষ্টা থাকবে আমাদের শক্তির জায়গা ধরে রাখার এবং আমাদের পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করার।”
প্রতিপক্ষের পেস আক্রমণের এই হুমকির দিকটা ভালোভাবেই জানেন জস বাটলার। ফাইনালের আগে তাই সমীহই ফুটে উঠল তার কণ্ঠে।
“দুর্দান্ত সব ফাস্ট বোলার বের করে আনার দীর্ঘ ইতিহাস আছে পাকিস্তানের। এখনকার দলও ব্যতিক্রম নয়। আমি নিশ্চিত, এই দলের পেসারদের বেশ কজনই পাকিস্তানের ইতিহাসের সেরা ফাস্ট বোলারদের মধ্যে জায়গা করে নেবে। তাদের ফাইনালে আসার পেছনে বড় অবদান এই পেস আক্রমণের।”
“অবশ্যই আমরা জানি, তারা কঠিন চ্যালেঞ্জ জানাবে আমাদের। তবে তাদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অনেক খেলেছি, উজ্জীবিত পারফরম্যান্স দেখিয়েছি। ফাইনালেও তেমন কিছু না পারার কারণ নেই।”
তবে ম্যাচের আগে যতটা শ্রদ্ধাই থাকুক, ২২ গজে ব্যাট হাতে বোলারদের খুব একটা সম্মান করতে দেখা যায় না বাটলার-হেলসকে। আফ্রিদি-নাসিমরাও তা জানেন। ফাইনালে মেলবোর্নের ২২ গজে তাই অপেক্ষা বিদ্যুচ্চমকের।