যে ক্রিকেটারদের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে দলগুলি, যারা গড়ে দিতে পারেন পার্থক্য। বিশ্বকাপের সব দল থেকে বেছে নেওয়া হলো তেমন একজন করে ক্রিকেটার।
Published : 14 Oct 2022, 07:11 PM
টি-টোয়েন্টি সংস্করণই এমন যে, দলীয় পারফরম্যান্সে জয়ের পথে যেমন এগিয়ে যাওয়া যায়, তেমনি একাই পার্থক্য গড়ে দেওয়ার সুযোগ এই সংস্করণেই বেশি। পারফরমার কম-বেশি আছে সব দলেই। তবু কারও ওপর নির্ভরতা থাকে বেশি, কারও কাছে প্রত্যাশা থাকে আকাশ ছোঁয়া। এবারের বিশ্বকাপের প্রতিটি দল থেকে বেছে নেওয়া হলো তেমন একজনকেই।
নাজিবউল্লাহ জাদরান - আফগানিস্তান
যে দলে খেলেন টি-টোয়েন্টি বৈশ্বিক মহাতারকা রশিদ খান, যেখানে আছে বিশ্বজুড়ে ব্যাটসম্যানদের ঘোর লাগানো স্পিনার মুজিব-উর-রহমান, সেই দল থেকে অন্য কাউকে বেছে নেওয়া কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আফগানিস্তান দলে রশিদ-মুজিবদের মতোই গুরুত্বপূর্ণ নাজিবউল্লাহ জাদরানের পারফর্ম করা।
রশিদ-মুজিবই শুধু নয়, নাভিন উল হক, মোহাম্মদ নবিদের নিয়ে আফগানদের বোলিং আক্রমণ দুর্দান্ত। কিন্তু সেই বোলিং আক্রমণের জন্য যথেষ্ট পুঁজি তো দিতে হবে! সেখানেই বড় দায়িত্ব জাদরানের।
হজরতউল্লাহ জাজাই ও রহমানউল্লাহ গুরবাজকে নিয়ে গড়া আফগানদের উদ্বোধনী জুটি বেশ বিপজ্জনক। এই দলের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা মিডল অর্ডার ব্যাটিংয়ে। সেখানেই বড় ভরসা নাজিবউল্লাহ।
ইনিংসের যে কোনো পর্যায়ে নেমে তিনি তাণ্ডব চালাতে পারেন ব্যাট হাতে। বিপর্যয়ের মধ্যে নেমেও তিনি পাল্টা আক্রমণে এলোমেলো করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের বোলিং। অভাবনীয় সব শট জানান দেয় তার কবজি ও পেশির জোর।
দুর্দান্ত ফর্মেও আছেন তিনি। চার-পাঁচে ব্যাট করেও এ বছর এখনও পর্যন্ত দলের সর্বোচ্চ রান স্কোরার তিনি। ১৪ ইনিংসে ৩২৭ রান করেছেন প্রায় দেড়শ স্ট্রাইক রেটে। ২৯ বছর বয়সী বাঁহাতিকে বিশ্বকাপেও এমন ফর্মে চাইবে আফগানিস্তান।
অস্ট্রেলিয়া - ডেভিড ওয়ার্নার
দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিং গুঁড়িয়ে ৪৩ বলে ৮৯। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে মেলবোর্নে টি-টোয়েন্টি দিয়েই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের আগমণী বার্তা দিয়েছিলে ডেভিড ওয়ার্নার। ক্রমে তিন সংস্করণেই তিনি রাঙিয়েছেন ব্যাটের আলোয়। তবে টি-টোয়েন্টি যেন একটু বেশিই আপন তার। এখানে তার ধারাবাহিকতাও দারুণ, হোক তা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি।
তবে টি-টোয়েন্টির বিশ্ব আসরে নিজের সেরাটা তিনি দেখাতে পারছিলেন না। তার দলও পাচ্ছিল না কাঙ্ক্ষিত সেই ট্রফির দেখা। অবশেষে গত বিশ্বকাপে তার ও দলের সাফল্য মিলে যায় এক বিন্দুতে। আসরের সর্বোচ্চ রান করে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শিরোপায় বড় অবদান রাখেন তিনি।
৪৮.১৬ গড় ও ১৪৬.৭০ স্ট্রাইক রেটে ২৮৯ রান তাকে এনে দেয় ম্যান অব দা টুর্নামেন্টের স্বীকৃতি। ফাইনালেও করেন ঝড়ো ফিফটি।
এবারও দল তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। তিনি শুধু ভালো শুরু এনে দেওয়ার ভরসাই নন, লম্বা ইনিংস খেলে দলকে এগিয়ে নেওয়ার নির্ভরতাও। তিনি নিজের কাজ ঠিকঠাক করতে পারলে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, মাকার্স স্টয়নিস, টিম ডেভিডরা পাবেন ঝড় তোলার মোক্ষম মঞ্চ।
লিটন কুমার দাস – বাংলাদেশ
বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু আশা আর নড়বড়ে স্বপ্নগুলোয় নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পারেন লিটন কুমার দাস। অধিনায়ক সাকিব আল হাসান অবশ্যই আছেন, দেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার এখনও তার অলরাউন্ডার সামর্থ্য দিয়ে দলের অপরিহার্য একজন। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে আফিফ হোসেন হয়ে উঠেছেন বড় ভরসা। কিন্তু দলকে দারুণ কিছু করতে হলে লিটনের নিজেকে মেলে ধরতে হবে সম্ভাব্য সেরা চেহারায়।
বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি দলে সমস্যার অভাব নেই। তবে সবচেয়ে বড় ঘাটতির জায়গা ব্যাটিং। সেখানেই বড় দায়িত্ব লিটনের। তার সহজাত পজিশন ওপেনিংয়ে খেলার সুযোগ তিনি পাবেন কিনা, নিশ্চিত নয় এখনও। তবে তিন নম্বরে খেললেও দলের ব্যাটিং ভার বয়ে নিয়ে যেতে হবে তাকে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে টপ অর্ডারদের জন্য প্রয়োজন একই সঙ্গে আগ্রাসী ব্যাট করা ও লম্বা ইনিংস খেলা। লিটনের সেই সামর্থ্য আছে ভালোমতোই। টেকনিক্যালি তিনি দারুণ, হাতে আছে সব ধরনের ক্রিকেট শট। উদ্ভাবনী শটও খেলতে পারেন। কিছুটা ঘাটতি কেবল আত্মবিশ্বাস ও ধারাবাহিকতায়।
টেস্ট ও ওয়ানডেতে তিনি এখন বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যানদের একজন। টি-টোয়েন্টিতে ভালো কিছু ইনিংস থাকলেও নিজের সামর্থ্যের সবটুকু ছাপ এখানে রাখতে পারেননি এখনও। সুযোগ এবার বিশ্ব আসরে নিজেকে জানান দেওয়ার।
জস বাটলার - ইংল্যান্ড
ম্যাচ জেতানোর মতো ক্রিকেটার কিংবা একাই পার্থক্য গড়ার মতো ব্যাটসম্যানের অভাব নেই ইংল্যান্ড দলে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জস বাটলার। দলের সাফল্যের জন্য সবচেয়ে জরুরি তার সাফল্য। মূল কারণ দুটি। প্রথমত, আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি তিনি বড় ইনিংসও খেলেন নিয়মিত। তিনি লম্বা সময় টিকে থাকা মানে ম্যাচ থেকে প্রতিপক্ষের ছিটকে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, এই দলের নেতৃত্ব এখন তার কাঁধে।
একটা সময় এই সংস্করণে জাতীয় দলের হয়ে মিডল অর্ডারে ব্যাট করতেন বাটলার। কখনও পালন করতেন ফিনিশারের দায়িত্ব। কিন্তু তার সামর্থ্যের সবটুকু প্রতিফলিত হচ্ছিল না সেখানে। ওপেনিংয়ে উঠে আসার পর তার কার্যকারিতা ও ধারাবাহিকতা, দুটোই বেড়ে গেছে দারুণভাবে।
ওপেনিংয়ে তার গড় ৪৮.১১ ও স্ট্রাইক রেট ১৫৩.৩৬। অন্যান্য সব পজিশন মিলিয়ে গড় ২৩.৭১, স্ট্রাইক রেট ১৩৩.৩৩। পার্থক্যটা পরিষ্কার।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিজের প্রথম তিন আসরে ১৫ ম্যাচ খেলে স্রেফ একটি ফিফটি ছিল তার। গত আসরে ওপেনিংয়ে নেমে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩২ বলে ৭১ রানের ইনিংস খেলেন, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে প্রথম সেঞ্চুরি দেখা পান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। তবে সেমি-ফাইনালে জ্বলে উঠতে পারেননি, হেরে যায় দল।
বিশ্বকাপের পর গত আইপিএলে অসাধারণ ব্যাটিংয়ে ৪টি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটিতে তিনি রান করেন ৮৬৩। তার প্রতি ইংল্যান্ডের দাবি তাতে বেড়ে গেছে আরও। বিশ্বকাপে এবার তার ব্যাটে যেমন তাকিয়ে থাকবে দল, তেমনি তার চ্যালেঞ্জ থাকবে নেতৃত্বের ছাপ রাখার।
হার্দিক পান্ডিয়া – ভারত
রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের মতো মহাতারকারা আছেন। লোকেশ রাহুলের মতো নির্ভরযোগ্য নামও আছে। সঙ্গে আছে এই সময়ের সেনসেশন সূর্যকুমার যাদব, যাকে মনে করা হচ্ছে বর্তমানে এই সংস্করণে বিশ্বের সেরা বাটসম্যান। তার পরও বিশ্বকাপে ভারতের নিউক্লিয়াস হতে পারেন হার্দিক পান্ডিয়া।
কারণ, তিনি দুর্দান্ত এক অলরাউন্ডার। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, তিন বিভাগেই গড়ে দিতে পারেন ব্যবধান।
কারণ, তিনি পেস বোলিং অলরাউন্ডার। অস্ট্রেলিয়ার মতো উইকেট-কন্ডিশনে, দলের ভারসাম্যের জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ, ম্যাচের যে মোড়গুলোয় সম্ভাবনা থেকে পিছলে শঙ্কার পড়তে পারে দল, সেখানেই বাঁধ দিতে পারেন তিনি। ঘাটতি পূরণের যোগসূত্র হতে পারেন তিনি।
চোট, হতাশার অনেক অধ্যায় পেরিয়ে গত আইপিএলে থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে তার ক্যারিয়ার। আগের সেই খ্যাপাটে চরিত্র বদলে এখন তিনি দায়িত্বশীল। কার্যকারিতা বদলেছে বহুগুন। ব্যাটিংয়ে তাকে ব্যবহার করা যায় নানা ভূমিকায়। যে কোনো সময় নেমেই ম্যাচের চিত্র বদলে দিতে পারেন। বিশ্বকাপে মূল ভূমিকা থাকবে ফিনিশারের।
বোলিংয়ে তাকে একটু কম গুরুত্ব দিতে চাইলেই প্রতিপক্ষকে দিতে হবে কড়া খেসারত। জাসপ্রিত বুমরাহ না থাকায় তার দায়িত্ব থাকবে আরেকটু বেশি। ফিল্ডিংয়ে তো তিনি বিশ্বসেরাদের একজন।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাকে ঘিরে যে সম্ভাবনা দেখেছে ভারতীয় ক্রিকেট, সাম্প্রতিক সময়ে তা পূর্ণতা পাচ্ছে দারুণ ধারাবাহিক পারফরম্যান্সে। অপেক্ষা এবার বিশ্বমঞ্চে নিজের চিহ্ন একে দেওয়ার।
পল স্টার্লিং- আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের সম্ভাবনা নিয়ে বলতে গেলে পল স্টার্লিংকে বাইরে রেখে কিছু বলা কঠিন। আইরিশ ক্রিকেটে তিনি কিংবদন্তি, বিশ্ব ক্রিকেটেও নিজের ছাপ রেখেছেন নানা সময়ে।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ৩ হাজার রান করা স্রেফ ৬ ব্যাটসম্যানের একজন তিনি। এই রেকর্ডে তিনি রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, বাবর আজম, অ্যারন ফিঞ্চ, মার্টিন গাপটিলের মতো তারকাদের সঙ্গী।
সেই ২০০৮ সালে ১৭ বছর বয়সে আয়ারল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রেখেছিলেন অমিত সম্ভাবনা নিয়ে। দীর্ঘ পথচলায় আইরিশ ক্রিকেটের ইতিহাসে নিজের নাম খোদাই করে নিয়েছেন। ওয়ানডেতে তার রেকর্ড দুর্দান্ত। কম যাননি টি-টোয়েন্টিতেও।
আন্তজাতিক টি-টোয়েন্টিতে ১১৪ ম্যাচের অভিজ্ঞতা তার। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও আছে বিপুল অভিজ্ঞতা। একসময় তিনি ছিলেন ভীষণ খ্যাপাটে। আগ্রাসন ছাড়া আর কোনো পথ জানা ছিল না। সময়ের সঙ্গে পরিণত হয়েছেন, মানিয়ে নিতে শিখেছেন নানা পরিস্থিতির সঙ্গে। নিয়ন্ত্রিত আগ্রাসনও এখন ভালোভাবেই পারেন তিনি। ব্যাটিংয়ের সঙ্গে তার বোলিংও গুরুত্বপূর্ণ দলের জন্য।
এই বছর অবশ্য নিজের সেরা চেহারায় নেই তিনি। আপন রূপে ফেরার জন্য বিশ্বকাপের চেয়ে আদর্শ জায়গা আর কী হতে পারে!
ডেভিড ভিসা – নামিবিয়া
তাকে বলা যায় ছোট দলের বড় তারকা। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গত বছর নামিবিয়ার হয়ে খেলা শুরুর পর ডেভিড ভিসা হয়ে উঠেছেন অনেকটা এই দলের প্রতীক। ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগগুলোয় অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের যে ঝলক তিনি দেখিয়ে আসছেন বছরের পর বছর, এখন নামিবিয়ার হয়েও করে চলেছেন তিনি।
বয়স তার পেরিয়ে গেছে ৩৭। কিন্তু এখনও তিনি দারুণ ফিট, প্রাণশক্তিতে ভরপুর এক বিশাল হৃদয় ক্রিকেটার। দুর্দান্ত স্কিলের সঙ্গে হার না মানা মানসিকতা দিয়ে যে কোনো প্রতিপক্ষের জন্যই তিনি হতে পারেন ভয়ঙ্কর।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নামিবিয়ার স্বপ্নযাত্রায় তার অবদান ছিল বিশাল। ৪৫.৪০ গড় ও ১২৭.৫২ স্ট্রাইক রেটে রান করেছিলেন ২২৭, ওভারপ্রতি সাড়ে সাতের কম রান দিয়ে উইকেট শিকার করেছিলেন ৬টি। ৪০ বলে অপরাজিত ৬৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩১ বলে অপরাজিত ৪২।
নামিবিয়াকে গত আসরের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে হলে ভিসাকেও আবার আবির্ভূত হতে হবে একই চেহারায়।
টম কুপার – নেদারল্যান্ডস
একসময় তিনি স্বপ্ন দেখতেন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার। সেই টম কুমার এবার বিশ্বকাপ খেলবে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে, কিন্ত নেদারল্যান্ডসের হয়ে।
তার জন্ম, ক্রিকেটের শুরু, ক্রিকেটের পথে এগিয়ে চলা, সবই অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার অনূর্ধ্ব-১৯ দল, অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলেও খেলেছেন। তবে জাতীয় দলে আসার মতো পারফরম্যান্স ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পূরণে ২০১০ সালে বেছে নেন মায়ের দেশ নেদারল্যান্ডসকে।
ডাচদের হয়ে তার পারফরম্যান্সও ছিল দারুণ, বিশেষ করে ওয়ানডে ক্রিকেটে। তবে নেদারল্যান্ডসে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আর নিজের নানা ব্যস্ততা মিলিয়ে খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি। ২০১৩ সালের পর ওয়ানডে ও ২০১৬ সালের পর টি-টোয়েন্টিতে লম্বা বিরতি পড়ে তার। এই সময়ে বিগ ব্যাশ, সিপিএল, টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে খেলেন। দীর্ঘ বিরতির পর অবশেষে আবার এই বছর ফেরেন নেদারল্যান্ডস দলে।
ফেরার পর উগান্ডার সঙ্গে একটি টি-টোয়েন্টিতে ৪২ বলে খেলেন ৮১ রানের ইনিংস। অগাস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ফিফটি করেন টানা তিন ম্যাচে। ১৬৪টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের অভিজ্ঞতা তার, অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল অভিজ্ঞতা তো আছেই। বিশ্বকাপে তিনি হতে পারেন ডাচদের সম্পদ।
ট্রেন্ট বোল্ট – নিউ জিল্যান্ড
বড় টুর্নামেন্টের বড় বোলার। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউ জিল্যান্ডের ফাইনালে ওঠায় বড় অবদান রেখেছিলেন তিনি ১৩ উইকেট নিয়ে। এবারও ট্রেন্ট বোল্টের স্কিল ও নতুন বলে সুইংয়ের ওপর নির্ভর করবে কিউইদের সাফল্যের অনেকটুকু।
অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ভালো করার কৌশলও তার যথেষ্টই জানা আছে। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ২২ উইকেট নিয়ে যৌথভাবে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। পরে ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে ১০ ম্যাচে তিনি শিকার করেন ১৭ উইকেট। সাফল্যের এই খতিয়ানই বলে দিচ্ছে, বিশ্বমঞ্চের চাপ তিনি উপভোগ করেন দারুণভাবে।
রান আটকানো ও উইকেট শিকার, দুটি কাজই তিনি করতে পারেন সমান দক্ষতায়। টিম সাউদির সঙ্গে তার নতুন বলের জুটির রসায়নও দারুণ।
এখন আর নিউ জিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে নেই তিনি। এই বিশ্বকাপের পর আবার তাকে জাতীয় দলে কতটা দেখা যাবে, বড় আসরে আর কখনও আদৌ খেলতে পারবেন কিনা, সংশয় আছে যথেষ্টই। বোল্টা নিজেও তাই মরিয়া থাকবেন এই আসর স্মরণীয় করে রাখতে।
শাহিন শাহ আফ্রিদি - পাকিস্তান
পাকিস্তানের টি-টোয়েন্টি মানেই যেন মোহাম্মদ রিজওয়ান ও বাবর আজম। ব্যাটসম্যানদের পারফরম্যান্সই নজর কাড়ে বেশি। রিজওয়ান ও বাবরের ধারাবাহিকতাকে পাকিস্তানের সাফল্যের সমার্থক তাই মনে হতেই পারে। তবে এই দলে সত্যিকারের পার্থক্য গড়ে দিতেন পারেন একজন- শাহিন শাহ আফ্রিদি।
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার আগুনে প্রথম স্পেলে যেমন পুড়েছিল ভারতের টপ অর্ডার। ছন্দে থাকলে তিনি গতির ঝড় আর সুইংয়ের বিষ দিয়ে এলোমেলো করে দিতে পারেন যে কোনো ব্যাটিং লাইন আপ। তার বিধ্বংসী কোনো স্পেল ইনিংসের শুরুতেই গড়ে দিতে পারে ম্যাচের ভাগ্য।
তিনি চোটে পড়ায় তাই পাকিস্তানের ক্রিকেটে শুরু হয়ে যায় হাহাকার। শঙ্কা উড়িয়ে শেষ পর্যন্ত অবশ্য বিশ্বকাপে দলের সঙ্গে থাকছেন তিনি। লম্বা সময় পর মাঠে নেমে আগের সেই গতি, ধার ও ছন্দ খুঁজে পেতেও লড়তে হবে তাকে। আফ্রিদি নিজেকে কতটা দ্রুত ফিরে পান, সেটির ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে পাকিস্তানের সাফল্য-ব্যর্থতা।
জর্জ মানজি - স্কটল্যান্ড
ছেলেবেলায় তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে গলফার হবেন। জন্মস্থান অক্সফোর্ড ছেড়ে ১৩ বছর বয়সে এডিনবরায় চলে আসার পর সেই স্বপ্নের পিছু ছুটছিলেন। কিন্তু একটা সময় বুঝে যান, এই খেলা তার জন্য নয়। চলে আসেন ক্রিকেটে। এখন ক্রিকেট ব্যাটকেই গলফ ক্লাব বানিয়ে উড়িয়ে মারেন বল। ২২ গজে ব্যাট হাতে নামলে একটি পথই তার জানা, স্রেফ আক্রমণ।
খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ স্কটল্যান্ডের হয় না। তাই ধারাবাহিকতাও ধরে রাখা কঠিন দলের ও ক্রিকেটারদের। তার পরও ৫১ ইনিংসে ১ হাজার ৩১৭ রান করেছেন তিনি ১৪৪.৭২ স্ট্রাইক রেটে। স্কটিশদের হয়ে ক্যারিয়ারে অন্তত দেড়শ রান করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ১৩০-এর বেশি স্ট্রাইক রেট কেবল তারই।
টি-টোয়েন্টিতে স্কটল্যান্ডের দুই সেঞ্চুরির একটি এসেছে তার ব্যাট থেকেই। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে অপরাজিত ১২৭ করেছিলেন স্রেফ ৫৬ বলে। ছক্কা ছিল ১৪টি!
টপ অর্ডারে মানজির পারফরম্যান্সের ওপর অনেকটা নির্ভর করবে, বিশ্বকাপে কতদূর যেতে পারবে স্কটল্যান্ড।
রাইলি রুশো – দক্ষিণ আফ্রিকা
রাইলি রুশোকে আবার দক্ষিণ আফ্রিকা দলে দেখা যাবে, কয়েক মাস আগেও তা ছিল অভাবনীয়। বিশ্বকাপ খেলা তো বহুদূর। বদলে যাওয়া প্রেক্ষাপটে সেই রুশোই অস্ট্রেলিয়াতে হবেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন সারথী।
কাউন্টি ক্রিকেটে কলপ্যাক চুক্তি নিয়ে ২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ছেড়ে যান রুশো। ইংল্যান্ডে তিনি ব্যাটের ঝলক দেখাতে থাকেন। বিশ্বজুড়ে টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগুলোয় দারুণ কাঙ্ক্ষিত নাম হয়ে ওঠেন দুর্দান্ত সব পারফরম্যান্সে। আর দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে বাড়তে থাকে হাহাকার।
বিচ্ছেদের দীর্ঘ অধ্যায় কাটিয়ে অবশেষে গত মৌসুমে তিনি আবার ফেরেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করে জায়গা ফিরে পান টি-টোয়েন্টি দলে। ছাপ রাখতেও সময় নেননি। ৬ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরে দ্বিতীয় ম্যাচেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ৫৫ বলে ৯৬ রানের অপরাজিত ইনিংস। এই মাসের শুরুতে ভারতের বিপক্ষে ইন্দোরে করেন ৪৮ বলে অপরাজিত ১০০।
আপাতত তিনি খেলছেন তিন নম্বরে। তবে টপ অর্ডার থেকে শুরু করে মিডল অর্ডারের যে কোনো পজিশনেই তিনি ব্যাট করতে পারেন। পেস-স্পিন, দুটিতেই দারুণ সাবলিল। খেলতে পারেন উইকেটের চারপাশে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি রান তার ১৪২.৯৮ স্ট্রাইক রেটে। ৩৩ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানের অভিজ্ঞতায় বড় নির্ভারতা থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার।
ভানিন্দু হাসারাঙ্গা- শ্রীলঙ্কা
আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ের তিন নম্বর বোলার। শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি দলের সম্ভবত সবচেয়ে বড় তারকা। বিশ্বকাপে দলের সাফল্য-ব্যর্থতার অনেকটুকু নির্ভর করবে তার পারফরম্যান্সের ওপরই।
শ্রীলঙ্কার বোলিং আক্রমণের হৃৎস্পন্দন তিনি। গত এশিয়া কাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে জিতে নেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। অস্ট্রেলিয়ায় অবশ্য কন্ডিশন ও উইকেট ভিন্ন। তবে তার কার্যকারিতায় ভাটা পড়ার কারণ নেই। সাইডস্পিন ও বাড়তি বাউন্সের কারণে সেখানেও তিনি হতে পারেন বিপজ্জনক। টি-টোয়েন্টির জন্য যে কোনো কন্ডিশনে তিনি আদর্শ এক বোলার।
দুর্দান্ত বোলিংয়ের কারণে তার ব্যাটিং আড়ালে পড়ে যায় অনেক সময়। নিজের অলরাউন্ড সত্ত্বার প্রকাশ অবশ্য পুরোপুরি এখনও দেখাতে পারেননি তিনি। টি-টোয়েন্টিতে ব্যাটিং রেকর্ড এখনও সমৃদ্ধ নয়। তবে ব্যাট হাতে তিনি যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন, তা দেখিয়েছেন নানা সময়েই।
চমকপ্রদ সাফল্যে দলকে এশিয়া কাপের শিরোপা এনে দেওয়া হাসারাঙ্গা চাইবেন বিশ্বকাপেও স্মরণীয় কিছু করতে।
মুহাম্মাদ ওয়াসিম- সংযুক্ত আরব আমিরাত
ব্যাটিং গড় ৪০.৬২, স্ট্রাইক রেট ১৫২.৩৮। এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে মুহাম্মাদ ওয়াসিমের পরিচয়। আদর্শ এক টি-টোয়েন্টি ওপেনারের প্রতিচ্ছবি।
মানসম্পন্ন ক্রিকেটার খুব বেশি নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের। ওয়াসিম সেখানে নিজেকে আলাদা করে চেনাতে পেরেছেন উদ্ভাসিত পারফরম্যান্সে। টি-টোয়েন্টিতে দুটি সেঞ্চুরি করা আমিরাতের একমাত্র ব্যাটসম্যান তিনি। অনেকের হয়তো চোখেও পড়ে না, বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক রথী-মহারথীদের ভীড়ে আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে তিনি আছেন ৯ নম্বরে!
এই সময়ের টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানদের মতোই রিফ্লেক্স, পেশির জোর ও ভয়ডরহীন মানসিকতা তার বড় শক্তি। নিজের জোনে বল পেলে বড় শট খেলায় তার জুড়ি নেই। যেটির প্রমাণ, ১৭ টি-টোয়েন্টি ইনিংসেই মেরেছেন ৪৪ ছক্কা।
প্রয়োজনে টুকটাক বোলিংও করতে পারেন ২৮ বছর বয়সী ক্রিকেটার। তবে আমিরাতকে বিশ্বকাপে চমক দেখাতে হলে ওয়াসিমকে জ্বলে উঠতে হবে ব্যাট হাতে।
কাইল মেয়ার্স – ওয়েস্ট ইন্ডিজ
একসময়কার তারকায় ঠাসা দলের আকাশে এবার উজ্জ্বল তারা খুব বেশি নেই। অধিনায়ক নিকোলাস পুরান, সহ-অধিনায়ক রভম্যান পাওয়েলকে বইতে হবে ব্যাটিংয়ের মূল ভার। দলে ফেরা অভিজ্ঞ ওপেনার এভিন লুইসের দিকেও থাকবে অনেকের নজর। তবে এই দলে গুরুত্বপূর্ণ থাকবে কাইল মেয়ার্সের ব্যাটিং।
গত বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে টেস্টে অবিস্মরণীয় ডাবল সেঞ্চুরি করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক তার। গত দেড় বছরে অলরাউন্ড সামর্থ্য দেখিয়ে তিন সংস্করণেই তিনি হয়ে উঠেছেন প্রায় নিয়মিত। ব্যাটিংয়ে তিনি মানিয়ে নিতে পারেন নানা পজিশনে। বোলিংয়ে রাখতে পারেন কার্যকর অবদান।
টি-টোয়েন্টি দলে আপাতত তার ভূমিকা ওপেনারের। চমক জাগানিয়া শট তিনি খেলতে পারেন। কদিন আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ক্যামেরন গ্রিনের বলে তার একটি ছক্কা যেমন তোলপাড় ফেলে দেয় ক্রিকেট বিশ্বে। বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংসের শুরুতে দ্রুত রান তোলার কাজটি করতে হবে মেয়ার্সকেই। তিনি সফল হলে পরে ঝড় তোলার মঞ্চ পাবেন পুরান-পাওয়েলরা।
এই দলে মেয়ার্স অপরিহার্য তার বোলিংয়ের কারণেও। স্রেফ জেন্টল মিডিয়াম পেসার তিনি, কিন্তু বড় শক্তি দুই দিকেই সুইং করাতে পারার ক্ষমতা। বিশেষ করে, নতুন বলে তার সুইং বিপজ্জনক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাকে নতুন বলের বোলার হিসেবে ব্যবহার করে নিয়মিতই।
তার দিকে হয়তো দৃষ্টি থাকবে কম, তবে পাদপ্রদীপের আলো কেড়ে নেওয়ার সামর্থ্য তার আছে।
সিকান্দার রাজা – জিম্বাবুয়ে
অন্য সব দলের মূল ভরসা কিংবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার নিয়ে দ্বিমত, তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু জিম্বাবুয়ে দলের ক্ষেত্রে এটি নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। এই দলের প্রাণভ্রোমরা সিকান্দার রাজা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৯ বছরের পথচলায় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের মতো রাজার ক্যারিয়ারও অনেক উত্থান-পতনের ঢেউয়ে ভেসেছে। দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন, শূন্য হাতে বিদায় নিয়েছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন, দল থেকে বাদ পড়েছেন। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে তিনি ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটাচ্ছেন।
জুলাইয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে বলতে গেলে তার হাত ধরেই চ্যাম্পিয়ন হয় জিম্বাবুয়ে। ৫ ইনিংসে ২২৮ রান করেন তিনি ৫৭ গড় ও ১৭৬.৭৪ স্ট্রাইক রেটে। বোলিংয়ে ওভারপ্রতি সাড়ে ছয়ের কম রান দিয়ে উইকেট নেন ৫টি। ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট ছিলেন তিনিই। সেই সাফল্যের ধারা ধরে রেখে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজেও জেতেন সিরিজ সেরার পুরস্কার।
ওপরের দিকের ব্যাটসম্যানরা ভালো ভিত গড়ে দিতে পারলে তিনি গিয়েই ঝড় তুলতে পারেন। বিপর্যয়ে নেমে দলের হাল ধরে এগিয়ে নিতে পারেন। তার আঁটসাঁট অফ স্পিন কার্যকর যে কোনো সময়। অধিনায়ক না হলেও সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে দলের নেতাও তিনি। সব মিলিয়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটারের দিকে বিশ্বকাপেও তাকিয়ে থাকবে জিম্বাবুয়ে।