চার্লসের বিধ্বংসী সেঞ্চুরি ও রিজওয়ানের ঝড়ে কুমিল্লার রেকর্ড গড়া জয়

২১০ রান তাড়ায় অনায়াস জয়ে ফরচুন বরিশালকে সঙ্গে নিয়ে প্লে-অফে জায়গা করে নিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Jan 2023, 05:03 PM
Updated : 31 Jan 2023, 05:03 PM

তামিম ইকবাল ও শেই হোপের ঝড়ের পর ম্যাচ জিততে রেকর্ড গড়তে হতো কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের। দাপুটে ব্যাটিংয়ে সুর বেঁধে দিলেন মোহাম্মদ রিজওয়ান। ঝড়ো সেঞ্চুরিতে বাকি কাজ সারলেন জনসন চার্লস। দুজনের অসাধারণ নৈপুণ্যে কুমিল্লা গড়ল বিপিএলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রান তাড়ার রেকর্ড। 

সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে খুলনা টাইগার্সকে ৭ উইকেটে হারিয়েছে কুমিল্লা। খুলনার দেওয়া ২১১ রানের বিশাল লক্ষ্য ১০ বল হাতে রেখেই টপকে গেছে টুর্নামেন্টের বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা।  

২০২০ সালের জানুয়ারিতে বিপিএলের সপ্তম আসরে ঢাকা প্লাটুনের ২০৫ রান তাড়া করে জিতেছিল খুলনা। এক আসর পর তাদেরই করা ২১০ রানের সংগ্রহ অনায়াসে ছাড়িয়ে গেল কুমিল্লা।  

এই জয়ে প্লে-অফের টিকেটও নিশ্চিত হয়ে গেছে কুমিল্লার। ১৬ পয়েন্ট নিয়ে আগেই সেরা চারে জায়গা করে নিয়েছে সিলেট স্ট্রাইকার্স। এবার ফরচুন বরিশালকে সঙ্গে নিয়ে প্লে-অফে উঠল কুমিল্লা। দুই দলেরই পয়েন্ট সমান ১২। 

আসরে সিলেট পর্বের শেষ ম্যাচ বলেই হয়তো প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল সিলেট স্টেডিয়াম। ঘরের মাঠের দল না থাকলেও গ্যালারি মাতানোর কাজটা ভালোভাবেই করেছে খুলনা ও কুমিল্লা।  

ম্যাচে দুই দল মিলে করেছে ৪২৩ রান। দুই ইনিংস মিলে ৩৪টি চারের সঙ্গে দেখা মিলেছে ২৭টি বিশাল ছক্কার। 

তামিমের ৯৫ ও হোপের ৯১ রানের সুবাদে দুইশ ছাড়ানো সংগ্রহ পায় খুলনা। কিন্তু চার্লস-রিজওয়ানের ব্যাটে বৃথা যায় তাদের ইনিংস। 

রান বন্যার ম্যাচে বাকি সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন চার্লস। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে ৫৬ বলে করেন অপরাজিত ১০৭ রান। ৫ চারের সঙ্গে তিনি ১১টি ছক্কায় সাজান নিজের ইনিংস। তার দুটি সেঞ্চুরিই বিপিএলে করা। 

চার্লসের কাজ সহজ হয়ে যায় শুরুতে রিজওয়ানের তাণ্ডবে। এদিন পাকিস্তানি কিপার-ব্যাটসম্যান ছিলেন ভিন্ন রুপে। আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ৮ চার ও ৪ ছক্কায় ৩৯ বলে ৭৩ রান করেন তিনি।  

রিজওয়ান ও চার্লসের ৬৯ বলে ১২২ রানের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতেই জয়ের ভিত পায় কুমিল্লা। পরে রিজওয়ান ফিরে গেলে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়েন চার্লস।  

বিশাল লক্ষ্য তাড়ায় শুরুতেই অবশ্য অনেক বড় ধাক্কা খেয়েছিল কুমিল্লা। শফিকুল ইসলামের প্রথম বলে দারুণ কাট শটে চার মারেন লিটন দাস। তবে গতিময় ভেতরে ঢোকা পরের ডেলিভারি সোজা আঘাত করে তার ডান হাতে। তীব্র ব্যথায় মাঠ ছাড়েন স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। 

কুমিল্লার বিপদ আরও বাড়ে তৃতীয় ওভারে অধিনায়ক ইমরুল কায়েস (৩ বলে ৫) ফিরে গেলে। তবে অন্য প্রান্তে শুরু থেকেই হাত খুলে খেলতে থাকেন রিজওয়ান। নাহিদুলের করা দ্বিতীয় ওভারে মারেন চার ও ছয়।  

রিজওয়ানের ব্যাটেই মূলত শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠে কুমিল্লা। পাওয়ার প্লে'তে পায় ৫৩ রান। যেখানে তার একারই অবদান ১৯ বলে ৩৯ রান। 

চার নম্বরে নামা চার্লসের ছন্দ খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগে। প্রথম ১০ বলে স্রেফ ২ রান করতে পারেন তিনি। পাওয়ার প্লে শেষ হতেই বদলে যায় চার্লসের ব্যাটিং।  

আমাদ বাটের করা সপ্তম ওভারে নিজে প্রথম বাউন্ডারি মারেন চার্লস। মার্ক ডেয়ালের পরের ওভারে হাঁকান জোড়া ছক্কা। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের করা নবম ওভারে ছক্কা-চার মারেন রিজওয়ান। পঞ্চাশ করতে স্রেফ ২৪ বল নেন তিনি।  

ত্রয়োদশ ওভারে ফের আমাদকে পেয়ে তিন ছক্কার সঙ্গে একটি চার মারেন চার্লস। ওই ওভারেই পূরণ হয় তার ফিফটি। পঞ্চাশ ছুঁতে খেলেন ৩৫ বল।   

পরের ওভারে এই জুটি ভাঙেন নাসুম আহমেদ। এর বড় কৃতিত্ব অবশ্য হোপের। শর্ট কভারে বাম দিকে লাফিয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় অসাধারণ ক্যাচ নেন খুলনা অধিনায়ক। বিদায়ঘণ্টা বাজে রিজওয়ানের।  

তখনও জয়ের জন্য ৩৮ বলে ৬৬ রান প্রয়োজন ছিল কুমিল্লার। নাহিদুলের করা পঞ্চদশ ওভারে ৪টি ছক্কা মেরে সমীকরণ সহজ করেন চার্লস। সাইফউদ্দিনের পরের ওভারেও ১৫ রান এলে শেষ ৪ ওভারে বাকি থাকে স্রেফ ২৫ রান।  

রানের চাপ কমে আসার পর নিজের সেঞ্চুরির দিকে মন দেন চার্লস। অষ্টাদশ ওভারে আমাদকে পয়েন্টের ওপর দিয়ে ছক্কায় উড়িয়ে তিন অঙ্কে পৌঁছান ক্যারিবিয়ান তারকা।  

৩৫ বলে ফিফটি ছোঁয়ার পর সেঞ্চুরিতে যেতে তার লাগে স্রেফ ১৮ বল। ১৯তম ওভারে ডেয়ালকে ছক্কা মেরে তিনিই শেষ করেন ম্যাচ। 

এর আগে ম্যাচের শুরুতে কিছুটা চমক দেখায় খুলনা। ৮ ম্যাচের স্রেফ দুটিতে জয় পাওয়া দলটি বদলে ফেলে অধিনায়ক। ইয়াসির আলির বদলে দায়িত্ব দেওয়া হয় এক সপ্তাহ আগে দলে যোগ দেওয়া হোপকে। 

তৃতীয় ওভারেই ড্রেসিংরুমের পথ ধরেন মাহমুদুল হাসান জয়। নাসিম শাহর মুখোমুখি প্রথম বলে এলবিডব্লিউ হন তরুণ ওপেনার।  

ফলে অধিনায়কত্বের অভিষেকে দ্রুত ব্যাটিংয়ে নামতে হয় হোপকে। অভিজ্ঞ ওপেনার তামিম ইকবালের সঙ্গে রয়েসয়ে শুরু করেন তিনি। পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে কেবল ৩৭ রান তুলতে পারে খুলনা।  

এরপর তাদের ঝড়ের শুরু, যা চলে ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত। 

অষ্টম ওভারে মোসাদ্দেক হোসেনকে প্রথম ছক্কা মারেন হোপ। পরের ওভারে আশিকুর জামানকে ছক্কায় ওড়ান তামিম। পরের বলে একটি চারসহ ওই ওভার থেকে আসে ১৪ রান। 

প্রথম ৮ ওভারে ৫৬ রান করা খুলনা পরের ১২ ওভারে তোলে ১৫৪ রান।  

ইনিংসের একাদশ ওভারে স্রেফ ২৭ বলে ফিফটি পূরণ করেন হোপ। পঞ্চাশ ছোঁয়ার পথে ৪টি করে চার-ছক্কা মারেন ক্যারিবিয়ান তারকা। এক ওভার পর মোসাদ্দেকের বলে জাকের আলি অনিকের হাতে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান তামিম।  

ব্যক্তিগত ৪৫ রানে জীবন পেয়ে খোলস ভেঙে বের হন তারকা ওপেনার। তানভির ইসলামের করা পঞ্চদশ ওভারে ৩টি ছক্কার সঙ্গে এক চারে নেন ২৭ রান। প্রথম ছক্কায় পৌঁছে যান পঞ্চাশে। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে এটি তার পঞ্চাশতম পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস। 

এরপর একের পর এক চার-ছক্কায় হোপের রান ছাড়িয়ে তামিম এগিয়ে যান শতরানের দিকে। ১৮ ওভার শেষে তামিমের রান ছিল ৯৫। ১৯তম ওভারে তিনি স্ট্রাইকই পাননি। মুস্তাফিজের করা ওই ওভারে একটি করে ছক্কা ও চার মেরে ৯০ রানে পৌঁছান হোপ। 

শেষ ওভারে স্পিনার মোসাদ্দেককে পেয়ে প্রথম বলেই বড় শটের চেষ্টা করেন তামিম। কিন্তু টাইমিংয়ের গড়বড়ে কাভার বাউন্ডারিতে ধরা পড়েন তিনি। শেষ হয় ১১ চার ও ৪ ছক্কায় খেলা তার ৯৫ রানের ইনিংস।  

পরে উইকেটে গিয়ে প্রথম দুই বলে চার-ছক্কা মারেন আজম খান। শেষ দুই বলে স্ট্রাইক পান হোপ। সেঞ্চুরি করতে তার দারকার ছিল ১০ রান। কিন্তু ইয়র্কার লেংথের ডেলিভারিতে ১ রানের বেশি নিতে পারেননি তিনি। 

সেঞ্চুরি না হলেও ৫ চার ও ৭ ছক্কায় ৫৫ বলে ক্যারিয়ার সেরা ৯১ রানের ইনিংসের সুখস্মৃতি নিয়ে ফেরেন খুলনা অধিনায়ক। ম্যাচ হেরে যাওয়ায় দিন শেষে যদিও সেই আনন্দ আর থাকেনি। 

সংক্ষিপ্ত স্কোর:  

খুলনা টাইগার্স: ২০ ওভারে ২১০/২ (তামিম ৯৫, জয় ১, হোপ ৯১*, আজম ১২*; নাসিম ৪-০-৩৪-১, তানভির ৪-০-৪২-০, আশিকুর ৩-০-২৯-০, মুস্তাফিজ ৪-০-৩৯-০, মোসাদ্দেক ৪-০-৪৮-১, খুশদিল ১-০-১৫-০) 

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স: ১৮.২ ওভারে ২১৩/৩ (লিটন ৪ আহত অবসর, রিজওয়ান ৭৩, ইমরুল ৫, চার্লস ১০৭*, খুশদিল ১২, মোসাদ্দেক ৪*; শফিকু ৪-০-৩৬-১, নাহিদুল ৩-০-৪৭-০, নাসুম ৪-০-১৯-১, আমাদ ৩-০-৫২-১, ডেয়াল ১.২-০-২১-০, সাইফ উদ্দিন ৩-০-৩৭-০)