হ্যারি টেক্টরের দুর্দান্ত ইনিংসে আয়ারল্যান্ড বড় স্কোর গড়লেও শেষ পর্যন্ত তা টপকে দারুণ জয় পেল বাংলাদেশ।
Published : 13 May 2023, 02:46 AM
একটি ফুল টস। একটি ক্যাচ। রুদ্ধশ্বাস কয়েকটি মুহূর্ত অপেক্ষা। ‘নো’ বলের সিদ্ধান্ত আসার পর এক সমুদ্র গর্জন। পরের বলেই মুশফিকুর রহিমের স্কুপ শটে বাউন্ডারি। বাংলাদেশের জয়! নাজমুল হাসান শান্তর স্মরণীয় প্রথম সেঞ্চুরি আর তাওহিদ হৃদয়ের সঙ্গে অসাধারণ জুটিতে যে পথে ছুটেছিল দল, সেই পথেই মুশফিকের অভিজ্ঞতার ভেলায় ধরা দিল দারুণ এক জয়।
লক্ষ্য ছিল পাহাড় সমান। চোখরাঙানি ছিল পরাজয়ের। তামিম ইকবাল, লিটন দাস ও সাকিব আল হাসানের ভরসার ছায়া সরে গিয়েছিল আগেই। তবে গত কিছুদিন ধরে যে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন দিনের যে কিরণ, আরও তীব্র হলো এই ম্যাচে। মিইয়ে আশা সম্ভাবনা উজ্জ্বল হলো শান্তর সেঞ্চুরি আর হৃদয়ের স্ট্রোকের ছটায়। নতুন ভূমিকায় নিজের কার্যকারিতার প্রমাণ মেলে ধরে শেষটা রাঙালেন মুশফিক।
চেমসফোর্ডে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৩ বল বাকি রেখে ৩ উইকেটের জয়ে সিরিজে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছিল বৃষ্টিতে। তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ তাই আর হারছে না নিশ্চিতভাবেই।
যদিও ম্যাচের প্রথম ভাগ স্বপ্নের আবির মেখে দিয়েছিল আইরিশদের চোখেমুখে। বৃষ্টিতে ৪৫ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে হ্যারি টেক্টরের দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি ও জর্জ ডকরেলের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে আয়ারল্যান্ড তোলে ৩১৯ রান।
কিন্তু তাদেরকে আড়াল করে দেন শান্ত ও হৃদয়। মন্থর শুরুর পর রূপ বদলে আগ্রাসী সেঞ্চুরি উপহার দেন শান্ত। প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে ৯৩ বলে ১১৭ রানের মুক্তোখচিত ইনিংস সাজান তিনি ১২ চার ও ৩ ছক্কায়। হৃদয়ের ৫৮ বলে ৬৮ রানের ইনিংস দলকে জোগায় সাহস। বাকিটুকুর জন্য তো মুশফিক ছিলেনই!
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ১৫০তম জয় এটি।
এর চেয়ে বেশি রান তাড়ায় বাংলাদেশ জিতেছে কেবল একবারই। ২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টন্টনে জয় এসেছিল ৩২১ রান তাড়া করে।
সেই ম্যাচে শুরুটা মোটামুটি ভালোই করেছিলেন তামিম ইকবাল। এবার উল্টো। রান তাড়ার শুরুতে বাংলাদেশ হোঁচট খায় অধিনায়ককে হারিয়ে।
লেগ স্টাম্পে থাকা হাফভলি বল ফিল্ডারের হাতে তুলে দিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মাঠ ছাড়েন তামিম। তবে এই শটও তার দুঃসময়র প্রতীকী। এই নিয়ে ফিফটি নেই তার টানা ৯টি ওয়ানডে ইনিংসে।
লিটন সাবধানী শুরুর পর লিটলের বলে ছক্কা ও চার মেরে জ্বলে ওঠার ইঙ্গিত দিলেও নিভে যান দপ করে। আলগা শটে তার ইনিংস থামে ২১ বলে ২১ করে।
বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরুর পরের জুটিতে। শান্ত ও সাকিব ৬১ রান যোগ করেন ৪৭ বলে।
সাকিব শুরুতে একটু অস্থির ছিলেন। পরে নিজেকে সামলে নেন। শান্ত ঠাণ্ডা মাথার ব্যাটিংয়ে প্রথম ২৬ বলে করেন ১৩ রান। এরপর গ্রাহাম হিউমকে জোড়া বাউন্ডারি দিয়ে শুরু করেন নতুন গতিতে ছুটে চলা। আর থামাথামি নেই! হিউমের পরের ওভারেই মারেন তিনি ছক্কা ও চার।
সাকিব অবশ্য আগের ম্যাচের মতোই আউট হয়ে যান ভালো কিছুর সম্ভাবনা জাগিয়েও (২৭ বলে ২৬)। দলের সম্ভাবনাও তখন প্রায় উধাও। শান্তর ওয়ানডে ক্যারিয়ার কেবল থিতু হতে শুরু করেছে, হৃদয় এখনও নবীন।
কিন্তু এই দুজনই মেলে ধরণের তারুণ্যের দুঃসাহস। শান্ত ফিফটি করেন ৪৯ বলে। হৃদয় তখনও এগোচ্ছেন বল প্রতি রান নিয়ে। পরে দুজনই দারুণ সব শট খেলতে থাকেন স্কিল, হাতের জোর আর সাহসিকতার মিশেলে। হৃদয়ের ফিফটিও আসে ৪৯ বলেই।
শান্ত ফিফটি থেকে শতরানে পৌঁছে যান ৩৪ বলে। দেশের বাইরে বাংলাদেশের হয়ে তার ৮৩ বলের সেঞ্চুরির চেয়ে দ্রুতগতির সেঞ্চুরি আছে কেবল সাকিবের ৬৩ বলের সেঞ্চুরি।
দুজনের কেউই অবশ্য কাজ শেষ করে ফিরতে পারেননি। জর্জ ডকরেলের নীরিহ এক শর্ট বলে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন হৃদয়। বাংলাদেশের প্রাণ জাগিয়ে তোলা জুটি থামে ১০২ বলে ১৩১ রানে।
একটু পর বিদায় নেন শান্তও। দায়িত্ব তখন মুশফিকের চওড়া কাঁধে। ১২ বলে ১৯ রানের ক্যামিও খেলে ফিরে যান মিরাজ। তাইজুল কিছুক্ষণ টিকে থেকে বিদায় নেন। তবে মুশফিক রয়ে যান ক্রিজে।
শেষ ওভারে প্রয়োজন পড়ে ৫ রানের। মুশফিক স্ট্রাইকে থাকলেও রান আসেনি প্রথম দুই বলে। তৃতীয় বলে ওই ফুল টসে সীমানায় ক্যাচ দেন মুশফিক। তবে তৃতীয় আম্পায়ার টিভি রিপ্লে দেখে জানান বলটি ছিল ‘নো।’ পরের বলেই লেংথ বলে স্কুপ খেলে কিপারের মাথার ওপর দিয়ে বাউন্ডারিতে দলকে জেতান মুশফিক। অপরাজিত রয়ে যান তিনি ২৮ বলে ৩৬ রান করে।
শেষের মতো ম্যাচের শুরুটাও ছিল বাংলাদেশের ভালো। মেঘলা আকাশের নিচে টস জিতে যে উদ্দেশ্যে বোলিং নেন তামিম ইকবাল, তা পূরণ হয় দ্রুতই। প্রথম ওভারেই দলকে সাফল্য এনে দেন হাসান মাহমুদ। বিপজ্জনক পল স্টার্লিং শূন্যতেই বিদায় নেন মুশফিকুর রহিমের দুর্দান্ত ক্যাচে। হাসান একটু পর ফিরিয়ে দেন আরেক ওপেনার স্টিভেন ডোহেনিকেও।
হ্যারি টেক্টর ও অ্যান্ড্রু বালবার্নি সেখান থেকেই টেনে তোলেন দলকে। দলে বাজে শুরুর কারণে দুজনেই ছিলেন একটু সাবধানী। ১১ ওভারে রান ছিল স্রেফ ৩০। একাদশ ওভারে শরিফুল ইসলামের বলে টেক্টরের চার ও ছক্কায় ইনিংসের গতি বদলানোর শুরু।
শরিফুলই একটু পরে ইবাদতের বলে নিতে পারেননি টেক্টরের ক্যাচ। ২৩ রানে জীবন পেয়ে বাংলাদেশকে ভোগান্তি বুঝিয়ে দিতে থাকেন তরুণ এই আইরিশ ব্যাটসম্যান। আরেক প্রান্তে বালবার্নি অস্বস্তিতে পড়েন কয়েকবার। তবে উইকেটে টিকে থাকেন। তাতে জমে ওঠে জুটি।
বাংলাদেশের বোলারদের প্রচেষ্টা সব ব্যর্থ হতে থাকে। দুই ডানহাতি ব্যাটসম্যান ক্রিজে বলেই কি না, বড় জুটি গড়ে উঠলেও অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজকে আক্রমণে আনেননি অধিনায়ক তামিম। তাইজুল ইসলামের এক ওভারে তিন ছক্কায় টেক্টরের ফিফটি আসে ৫৩ বলে।
যার ওপর ঝড় বয়ে যায় বেশি, সেই শরিফুলই ভাঙন ধরান ৯৮ রানের এই জুটিতে। ৫৭ বলে ৪২ রান করে ফেরেন বালবার্নি। শরিফুল একটু পর ফিরিয়ে দেন লর্কান টাকারকেও। দিনের আরেক খরুচে বোলার তাইজুল দ্রুত বিদায় করেন কার্টিস ক্যাম্পারকে।
তবে টেক্টর আরেকপ্রান্তে ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। ফিফটি থেকে সেঞ্চুরিতে যেতে তার লাগে ৪০ বল। জর্জ ডকরেল ক্রিজে যাওয়ার পর দুই প্রান্তেই তুলাধুনা হতে থাকে বাংলাদেশের বোলিং।
উইকেটে যাওয়ার পরপরই সাকিবের ওভারে চার ও ছক্কায় হাত খোলেন ডকরেল। পরের ওভারেই টেক্টর শতরানে পা রাখেন ৯৩ বল খেলে।
তার ২৯ ইনিংসের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি এটি। সবকটিই করলেন সবশেষ ৯ ইনিংসের মধ্যে।
এরপরও বাকি ছিল ১০ ওভার। টেক্টর ও ডকরেল স্রেফ তাণ্ডব চালাতে থাকেন। তাইজুলের টানা দুই বলে ছক্কা মারেন টেক্টর, শরিফুলের এক ওভারে তিনটি ছক্কায় ওড়ান ডকরেল। টেক্টর ছাড়েননি সাকিবকেও।
টেক্টরের রোমাঞ্চকর অভিযান শেষ পর্যন্ত থামে ১৪০ রানে। ইবাদত হোসেনকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে পরের বলে স্লগ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যান তিনি।
ওভার তখন বাকি স্রেফ তিনটি। তার পরও হতাশায় বারবার মাথা নেড়ে মাঠ ছাড়ছিলেন তিনি। গোটা মাঠ অবশ্য দাঁড়িয়ে তখন অভিনন্দন জানাচ্ছে তাকে।
ডকরেলের সঙ্গে তার ৬৮ বলে ১১৫ রানের জুটিতে আয়ারল্যান্ড তখন তিনশর কাছে। পরের জুটিতে ডকরেল ও মার্ক অ্যাডায়ার রানকে তিনশ ছাড়িয়ে নিয়ে যান আরেকটু দূরে। তিন ওভারে ৩৭ রান যোগ করেন দুজন।
চার ছক্কায় ডকরেল ক্যারিয়ার সেরা ৭৪ স্পর্শ করেন ৪৭ বল খেলে। ৮ বলে ২০ রানে অপরাজিত থাকেন অ্যাডায়ার। শেষ ১০ ওভার থেকে ১২৪ রান তোলে আয়ারল্যান্ড।
বাংলাদেশের সামনে তখন বড় চ্যালেঞ্জ। শান্ত-হৃদয়রা জানিয়ে দিলেন, নতুন দিনের দায়িত্ব নিতে তারা প্রস্তুত।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
আয়ারল্যান্ড: ৪৫ ওভারে ৩১৯/৬ (ডোহেনি ১২, স্টার্লিং ০, বালবার্নি ৪২, টেক্টর ১৪০, টাকার ১৬, ক্যাম্পার ৮, ডকরেল ৭৪*, অ্যাডায়ার ২০*; হাসান ৯-০-৪৮-২, শরিফুল ৯-০-৮৩-২, ইবাদত ৯-১-৫৬-১, সাকিব ৯-০-৫৭-০, তাইজুল ৭-০-৫৯-১, মিরাজ ২-০-১৩-০)।
বাংলাদেশ: ৪৪.৩ ওভারে ৩২০/৭ (তামিম ৭, লিটন ২১, শান্ত ১১৭, সাকিব ২৬, হৃদয় ৬৮, মুশফিক ৩৬*, মিরাজ ১৯, তাইজুল ৯, শরিফুল ৪*; লিটল ৯-০-৬৩-১, অ্যাডায়ার ৮.৩-১-৫২-১, হিউম ৬-০-৫৭-১, ম্যাকব্রাইন ৭-০-৪৯-০, ক্যাম্পার ৫-০-৩৭-২, ডকরেল ৯-০-৫৮-২)।
ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী।
সিরিজ: ৩ ম্যাচের ১-০তে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: নাজমুল হোসেন শান্ত।