সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে বিপিএলে খেলতে আসা অলরাউন্ডার কলিন অ্যাকারম্যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কথা বললেন তার অবিশ্বাস্য রেকর্ড, সিলেট দল, তার নাটকীয় ক্যারিয়ার-জীবন ও অনেক কিছু নিয়ে।
Published : 25 Jan 2023, 07:35 PM
বিশ্ব ক্রিকেটে বড় কোনো নাম নন কলিন অ্যাকারম্যান। তবে একটি জায়গায় তিনি অনন্য। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে ৭ উইকেট নিতে পারেননি আর কেউ। অথচ তার মূল কাজ ব্যাটিং। তার গোটা ক্যারিয়ারই অবশ্য এমন নাটকীয়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২০১০ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলে পরে সেখানকার ঘরোয় ক্রিকেটেও ভালোই করছিলেন। কিন্তু ২৬ বছর বয়সে দেশ ছেড়ে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। ইংলিশ কাউন্টি লেস্টারশায়ারের অধিনায়কত্ব করছেন অনেক দিন ধরে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলছেন নেদারল্যান্ডসের হয়ে। ডাচদের হয়ে সম্প্রতি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জন্মভূমি দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দেওয়ার ম্যাচে তিনিই ম্যান অব দা ম্যাচ!
বর্ণময় এই চরিত্র এবার বিপিএল খেলছেন সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে। বিপিএলের সিলেট পর্ব শুরু হওয়ার আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ৩১ বছর বয়সী অলরাউন্ডার কথা বললেন তার ৭ উইকেট নেওয়ার কীর্তি, দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে ইংলিশ ক্রিকেটকে আপন করে নেওয়া, ডাচ ক্রিকেটে তার অধ্যায়, সিলেট দল ও বিপিএল নিয়ে ভাবনাসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে।
আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় কীর্তি দিয়েই শুরু করা যাক। ভাবলেও আসলে অবিশ্বাস্য লাগে, একজন বোলার টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কীভাবে ৭ উইকেট নিতে পারে!
কলিন অ্যাকারম্যান: অবিশ্বাস্য বটে! আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের… জীবনেরও সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতিগুলোর একটি। ওই রাত কখনও ভোলার নয়। তবে আপনিও নিশ্চয়ই বুঝবেন, ৭ উইকেট আসলে নেওয়া যায় না। হয়ে যায়। সেই রাতেও কোনোভাবে ওটা হয়ে গিয়েছে।
সবকিছুই মনে হয় আমার পক্ষে ছিল সেই রাতে। উইকেটে একটু স্পিন ধরছিল। ব্যাটিংয়ে আমি যদিও ভালো করতে পারিনি (৪ রান), তবে আমাদের দল ভালো একটা স্কোর গড়েছিল (১৮৯)। দ্রুতগতির একটি ফিফটি করেছিল হিলি (লুইস হিল, ২৮ বলে ৫৮)।
এরপর ওরা (বার্মিংহাম) আসলে রান তাড়া করতে নেমে আমাকে টার্গেট করেছিল যে তুলাধুনা করবে। এটাই আমার পক্ষে আসে। ওরা একের পর এক উইকেট দিতে থাকে।
আমি এমন কোনো বোলার নই। বিশ্বের সেরা স্পিনারদের ধারেকাছেই নই। সাদামাটা এক স্পিনার বলতে পারেন, যে চায় জায়গায় বলটা ঠিকঠাক রাখতে। আমার তো ৭ উইকেট পাওয়ার কোনো কারণ নেই! কিন্তু রাতটি আমার ছিল।
পেছন ফিরে তাকালে আপনার নিজের কি অবিশ্বাস্য লাগে? এমন কোনো ঘোর লাগে, যে সত্যিই এরকম কিছু হয়েছিল কি না!
অ্যাকারম্যান: অবশ্যই এটাকে স্বাভাবিক মনে হয় না। ভাবলে মনে হয় যেন, অতিপ্রাকৃত কিছু! যেটা বললাম, স্রেফ হয়ে গেছে এবং আমি নিশ্চিত, জীবনে আর কখনও ৭ উইকেট পাব না। সেই রাতেও জানতাম, এমন কিছু আর জীবনে হবে না। তাই উপভোগ করেছি পুরোপুরি।
প্রথম দুই ওভারে সেদিন আপনার স্রেফ একটি উইকেট ছিল। পরের দুই ওভারে তিনটি করে!
অ্যাকারম্যান: হ্যাঁ, প্রথম উইকেট পাওয়ার প্লেতে (চতুর্থ ওভারে)। কাভারে খুব ভালো ক্যাচ নিয়েছিল হ্যারি (ডিয়ারডেন)। পরের ওভারে উইকেট পাইনি (সপ্তম ওভারে)। ১৫ ওভার শেষে ফেরার পর (১৫তম ওভারেই) ম্যাজিক হতে থাকল।
তখন ওদের ওভারপ্রতি দশের বেশি রান লাগত (১২ করে)। ওরা চালাতে থাকল আর টপাটপ উইকেট পেতে থাকলাম। সবকিছু খুব দ্রুত হয়ে গেল। প্রথমবার চার উইকেট পেলাম। এরপর পাঁচ, ছয়, সাত… সব চোখের পলকে হয়ে গেল যেন।
ওই সময়টায় আমার কেমন লাগছিল, তা আসলে বলতেও পারব না। কারণ, কোনো কিছু বোঝার আগেই সব হয়ে যাচ্ছিল। যেহেতু দলের অধিনায়ক আমি, মূল ভাবনা ছিল ম্যাচটা জিততে হবে। বার্মিংহাম বিয়ার্স বরাবরই আমাদের বড় প্রতিপক্ষ। তাদের বিপক্ষে জয় সবসময় স্পেশাল। জিততে মরিয়া ছিলাম আমরা। সেই চেষ্টায় একে একে সাত উইকেট হয়ে গেল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করা উচিত।
স্রেফ হ্যাটট্রিকটাই হয়নি সেদিন। অবশ্য তা নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই আমার!
অথচ তখনও পর্যন্ত আপনি অনিয়মিত বোলার ছিলেন। ওই ম্যাচের আগে ৯০ টি-টোয়েন্টিতে মাত্র ৩১ উইকেট ছিল আপনার…
অ্যাকারম্যান: যেটা বললাম, হয়ে গেছে আসলে রেকর্ডটি। দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় পার্ট টাইম বোলারই ছিলাম। তবে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর থেকে স্পিনে উন্নতির চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অলরাউন্ডারদের চাহিদা বেশি। ভাবলাম যে স্পিনটা যেহেতু করিই, আরও ভালোভাবে চেষ্টা করব না কেন! তাই কাজ করে যাচ্ছিলাম।
তবে ৭ উইকেট নেওয়ার মতো অবশ্যই নয়!
কি মনে হয়, এই রেকর্ড ভাঙতে পারে?
অ্যাকারম্যান: ওই দিনের আগ পর্যন্ত কেউ যদি বলত, আমি টি-টোয়েন্টিতে ৭ উইকেট পাব, তাহলে তাকে পাগল ভাবতাম। কাজেই এরকম আরও হতেই পারে। আমি সাত উইকেট নিলে আরও ভালো বোলাররা কেন নয়? হয়তো একদিন দেখবেন, ভেঙে গেছে।
বিপিএলে ফেরা যাক। প্রথমবার বিদেশি কোনো টি-টোয়েন্টি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলছেন। অভিজ্ঞতা কেমন এখনও পর্যন্ত?
আকারম্যান: এখনও পর্যন্ত দুর্দান্ত! আমাদের দল জিতে চলেছে, এটাও একটা কারণ। দল জিতলে সবকিছু খুব ভালো চলে, নিজেদেরও ভালো লাগে। তবে এমনিতেও আমাদের দলের ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ দারুণ।
ক্রিকেটের কথা বললে, অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের দারুণ সমন্বয় আছে দলে। বিশেষ করে, স্থানীয়দের মধ্যে। মাশরাফি ও মুশফিকের মতো অভিজ্ঞরা আছেন এই দলে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তারা কিংবদন্তি। এখানে আসার পর দেখতেও পাচ্ছি, সবাই তাদেরকে কতটা সম্মান করে। পাশাপাশি শান্ত, হৃদয়, জাকির, রাজার মতো তরুণরা আছে। স্থানীয়রাই বেশি ধারাবাহিক পারফর্ম করছে। এটাও দলের আবহের জন্য ভালো কাজ করছে।
প্রথম দুই ম্যাচের পর আপনার আর সুযোগ মেলেনি, টিম কম্বিনেশন ও অন্যান্য সব কিছু মিলিয়ে। কী মনে হয়, ওই দুই ম্যাচে বড় সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলেছেন!
অ্যাকারম্যান: তা বলতে পারেন। এই ধরনের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে আসলে সুযোগ কাজে লাগাতে হয়। এক ম্যাচে অবশ্য বোলিং ভালোই করেছি। তবে ব্যাটিংয়ে আরও ভালো করা উচিত ছিল, বিশেষ করে ওপেনিংয়ে যখন সুযোগ পেয়েছিলাম। যদিও এক ম্যাচে রান আউট হয়ে গেছি। তবে এটাই ঠিক, দক্ষিণ আফ্রিকা-ইংল্যান্ডের মতো জায়গায় খেলে এখানে এসে শুরুতেই ভালো করা কঠিন। এসব কন্ডিশনে অভিজ্ঞতা তো খুব বেশি নেই আমার।
এরপর মোহাম্মদ হারিস চলে এলো। দল ঠিকই করেছে। সে খুব ভালো তরুণ প্রতিভা, ইম্প্যাক্ট ক্রিকেটার। তাকে খেলানোই যৌক্তিক ছিল।
তবে একাদশের বাইরে গেলেও দলে ভালোভাবেই মিশে আছি। দলের সবাই যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে, সম্পৃক্ত রাখছে। যত্ন নিচ্ছে সবাই। যখন আবার সুযোগ আসবে, কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। তবে দল যেহেতু জিতছে, আমার কোনো অভিযোগ নেই। দলের জয়ই আসল। ম্যাশের (মাশরাফি) নেতৃত্বে ছেলেরা খুব চনমনে আছে।
দলে আসার পর মাশরাফির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তটি কেমন ছিল?
অ্যাকারম্যান: তার সম্পর্কে জানতাম টুকটাক। এবার দেখলাম কাছ থেকে। প্রথম পরিচয়ে তো সে খুবই ‘চিলড’ ছিল। একদমই সাধারণ একজন যেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে তো সে আইকনিক চরিত্র। ২০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে। সে খুবই প্রাণবন্ত। তবে একইসঙ্গে ধীরস্থিরও, বিশেষ করে চাপের সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে। দেখে কখনোই মনে হয় না যে চাপে আছে। খুবই শান্ত ও রিল্যাক্সড থাকে। অধিনায়ক এরকম হলে দলের টেনশনও তখন কমে যায়।
আসলে এত অভিজ্ঞতা তার, এসব তার কাছ থেকে প্রত্যাশিতই। স্থানীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সে দারুণ জনপ্রিয়, তার দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেরা। বিদেশিদের মধ্যেও (মোহাম্মদ) আমির, ইমাদ (ওয়াসিম), থিসারা (পেরেরা)…ওদের সঙ্গে ম্যাশের আগে থেকেই পরিচয় ছিল। অনেক কিছু তারা রিলেট করতে পারে। ম্যাশের ধরনটার সঙ্গে তারা সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এটাও সহায়তা করছে দলকে।
আরেকটা ব্যাপার হলো, সে জানে কীভাবে এই ধরনের টুর্নামেন্ট জিততে হয়। আমাদের জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আশা করি।
সিলেট স্ট্রাইকার্সে সুযোগ পাওয়ার ব্যাপারটি কখন জানতে পারলেন?
অ্যাকারম্যান: এই ধরনের সুযোগ খুঁজছিলাম অনেক দিন ধরেই। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে এজেন্ট বলল যে আমি এখানে খেলতে চাই কি না। ‘না’ বলার তো প্রশ্নই আসে না। বিশ্বকাপও মোটামুটি ভালো কাটল। এরপর নতুন অভিজ্ঞতার জন্য মুখিয়ে ছিলাম।
নানা দেশে খেলার অভিজ্ঞতা তো আপনার যথেষ্টই আছে! জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকায়, জন্মভূমির হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে এগিয়ে যাওয়া, জাতীয় দলের কাছাকাছি গিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানো, এখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলা, আপনাকে মোটামুটি বিশ্ব নাগরিক বলা যায়। নিজের দেশ কেন ছাড়লেন? সিদ্ধান্তটি কতটা সহজ বা কঠিন ছিল?
অ্যাকারম্যান: কঠিন ছিল। খুবই কঠিন। তবে আমার মনে হচ্ছিল, নিজের খেলার উন্নতির জন্য এবং ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার জন্য ওই পদক্ষেপ প্রয়োজন। নিজের দেশ ছেড়ে যাওয়া, ভিন্ন কন্ডিশনে, ভিন্ন চ্যালেঞ্জে যাওয়া, এসব দিক থেকে অবশ্যই কঠিন ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত যখন ক্যারিয়ারের কথা এবং আরও কিছু বাস্তবতার কথা ভেবেছি, তখন আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে গেছে।
এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, আমার জন্য দারুণ পদক্ষেপ ছিল। আমার পরিবারের জন্যও। আমি খুবই খুশি যে ওই সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম।
দেশ ছাড়ার ঠিক আগে ঘরোয়া বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেট আসরে (২০১৬-১৭ মৌসুমে) সবচেয়ে বেশি রান করেছিলেন আপনি। জাতীয় দলে ডাক পেতে পারেন বলে আলোচনা হচ্ছিল। তারপরও দেশের ক্রিকেট ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল?
অ্যাকারম্যান: হয়তো ডাক পেতে পারতাম… হ্যাঁ, সম্ভাবনা ছিল। আমার ভাবনায়ও ছিল সেটা। তবে যেটা বললাম, সবকিছু ভেবে লেস্টারশায়ারের চুক্তিটাকেই আমার নিজের জন্য ভালো মনে হচ্ছিল। সেই সময়টায় দক্ষিণ আফ্রিকার আরও অনেকেই কাউন্টিতে চুক্তি করল, ডেন ভিলাস, সাইমন হার্মার, কাইল অ্যাবট, হাইনো কুন… সবাই দেশের বাইরের চুক্তিকেই বেশি উপযুক্ত মনে করল।
‘কিছু বাস্তবতার’ কথা বলছিলেন একটু আগে। সেটা কি দক্ষিণ আফ্রিকার কোটা প্রথা? এটা তো প্রায় ‘ওপেন সিক্রেট’ যে কোটার কারণে তৈরি হওয়া অনিশ্চিত ক্যারিয়ারের জন্যই দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটাররা ঝাঁকে ঝাঁকে কলপ্যাক চুক্তিতে বা দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছিল!
অ্যাকারম্যান: আমি আসলে এখন আর অত গভীরে যেতে চাই না। যেটা ওপেন সিক্রেট, সেটা তো ওপেনই। আমি শুধু বলতে পারি… পেছন ফিরে তাকিয়ে মনে হয়, একদম ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। কোনো আক্ষেপ নেই।
নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার সুযোগ কিভাবে পেলেন?
অ্যাকারম্যান: আমার মা নেদারল্যান্ডসের। আমার তাই ডাচ পাসপোর্ট ছিলই। দক্ষিণ আফ্রিকায় দুটি পাসপোর্ট রাখা যায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ইচ্ছেটুকু পূরণ হয়েছে মায়ের দেশের হয়ে খেলে। ২০১৯ সাল থেকে খেলছি তাদের হয়ে।
এখন আপনি এমনিতে থাকেন কোথায়?
অ্যাকারম্যান: ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকা মিলিয়েই থাকি। আমার স্ত্রী ইংল্যান্ডের। ওকে আর মেয়েকে নিয়ে আমি ইংল্যান্ডে থাকি বেশি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও অবশ্য অনেকটা সময় কাটাই। আমার পুরো পরিবার দক্ষিণ আফ্রিকায়।
নেদারল্যান্ডসে তো সেভাবে যাওয়াই হয় না তাহলে। হুট করে শুধু সিরিজের সময় গিয়ে খেলা কঠিন নয়?
অ্যাকারম্যান: কঠিন তো বটেই। নেদারল্যান্ডস তো আসলে সারা বছর ক্রিকেট খেলে না। সত্যি বলতে, খুব কমই খেলার সুযোগ পায়। কয়েক ব্লকে ওরা খেলে। আমাকে বা এরকম আরও যারা আছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয়, কে কোন ব্লকে খেলতে পারবে। আমরা জানিয়ে দেই। আমার ক্ষেত্রে, অবশ্যই আগে লেস্টারশায়ারের চুক্তিকে সম্মান করতে হয়। এর ফাঁকে নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলি সুযোগমতো। আগামী মার্চে যেমন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ আছে। আশা করি খেলব। ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সুযোগ থাকলে খেলব।
নেদারল্যান্ডসের বোর্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে সম্ভবত ৫-৬ জন আছে। অন্যরা বেশির ভাগই আমার মতো, ওদের কাউন্টিতে ভালো চুক্তি আছে।
নেদারল্যান্ডসের হয়েই তো গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্মরণীয় জয়ের স্বাক্ষী হলেন। বাংলাদেশকে হারানোর সম্ভাবনা জাগিয়েও পারেননি আপনারা। পরে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিলেন! জন্মভূমিকে হারানোর ম্যাচে ম্যান অব দা ম্যাচ আপনিই। কেমন লাগছিল?
অ্যাকারম্যান: বলার অপেক্ষা রাখে না, খুবই অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি ছিল। তবে দিনশেষে, লড়াইটি দুটি ক্রিকেট দলের এবং নিজের দল জিতলে ভালো লাগবেই। আমি নেদারল্যান্ডসের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষ খেলছি মানে আমি তখন একজন ডাচ। ব্যস।
দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। গোটা বিশ্বকাপই স্মরণীয় এক ভ্রমণ ছিল। এমনকি প্রাথমিক পর্বে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে শেষ ওভারে নাটকীয় জয়, পরে নামিবিয়াকে হারানো, মূল পর্বে ওঠার যে উল্লাস… এসব ভোলার নয়।
বাংলাদেশের বিপক্ষে খুব ভালো সুযোগ ছিল আমাদের। ওদের রান বেশি ছিল না। কিন্তু তাসকিনের প্রথম ওভারে দুই উইকেট আর পরে দুটি রান আউটে আমাদের বড় ক্ষতি হয়ে যায়। তারপরও আমরা লড়াইয়ে ছিলাম। কিন্তু আমিও ফিফটির পর শেষ পর্যন্ত থাকতে পারিনি।
তবে শেষ পর্যন্ত জিম্বাবুয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে গ্রুপে শীর্ষ চারে থাকা এবং পরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করা আমাদের জন্য, ডাচ ক্রিকেটের জন্য অনেক বড় ব্যাপার।
দক্ষিণ আফ্রিকা দলের অনেকের সঙ্গেই তো নিশ্চয়ই ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছেন। মাঠে তাদের সঙ্গে ঠাট্টা-মজা, খোঁচা দেওয়া বা পাওয়া, এরকম কিছু হয়নি? ম্যাচ শেষে কি অবস্থা ছিল তাদের?
অ্যাকারম্যান: নাহ, ওসব তেমন একটা হয়নি। টুকটাক নরম্যাল কথা হয়েছে। ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই ওদের অনেকের সঙ্গে পরিচয়, একসঙ্গে খেলে আসছি। আনরিখ নরকিয়ার সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই। ওর সঙ্গে একটু-আধটু হয়েছে। তবে খুব বেশি নয়। দুর্দান্ত বোলিং করেছিল সেদিন সে (৪-০-১০-১)।
ম্যাচের পর তো… ওরা হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল, তারপর আসলে ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য সময়টা খুব আদর্শ ছিল না!
ক্যারিয়ারে সামনের পথচলা নিয়ে পরিকল্পনা কি?
অ্যাকারম্যান: বয়স এখন ৩১ হয়েছে, আশা করি আরও বছর দশেক খেলতে পারব (হাসি)… ১০ বছর না হলেও অন্তত আরও ৭-৮ বছর খেলার আশা রাখি। ইংল্যান্ডে যত বেশি সম্ভব ট্রফি জিততে চাই এবং অবদান রাখতে চাই। নেদারল্যান্ডসের হয়ে বিশ্বকাপে যতটা সম্ভব ভালো করতে চাই। পাশাপাশি যদি বিপিএল বা এই ধরনের টুর্নামেন্টগুলোতে খেলতে পারি, দারুণ হবে।
বিপিএল থেকে ফেরার সময় কি নিয়ে ফিরতে চান?
অ্যাকারম্যান: ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে উপমহাদেশে এলে একটি জায়গায় সব ব্যাটারই উন্নতি করতে চায়-স্পিন খেলায়। যদিও আমি মাত্র দুটি ম্যাচ খেলতে পেরেছি। তবে নেটে কাজ করছি। ইংল্যান্ডে নেটেও স্পিনার খুব বেশি পাওয়া যায় না। এখানে সিলেট দলে যারা একাদশে সুযোগ পাচ্ছে না, অপু বা নাবিল ওরা খুব ভালো স্পিনার। আরও স্পিনার আছে। নিজের স্পিন খেলায় উন্নতির ভালো একটি সুযোগ এটি।
আর হ্যাঁ, অবশ্যই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ নিয়ে ফিরতে চাই।
ক্রিকেটের বাইরে আর কি করতে ভালো লাগে? কোভিডের সময়টায় নাকি আপনি বাইক নিয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন?
অ্যাকারম্যান: মাছ ধরতে খুব ভালো লাগে আমার। আমার বাবার ছোট একটি নৌকা আছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলে বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে মাছ ধরতে চলে যাই। ক্রিকেটের বাইরে সবচেয়ে বড় শখ মাছ শিকারই। মাঝেমধ্যে গলফও খেলি।
বাইকও আছে। আমার শ্বশুর আয়রনম্যান রেসের ট্রেনার। এলিট রেস এটি, ১৮০ কিলোমিটার বাইসাইকেল রাইড, ৪২ মাইল দৌড় আর সম্ভবত ৩.৮ কিলোমিটার থাকে সাঁতার। আমিও মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে বাইসাইকেল রাইডে যাই।
শেষ প্রশ্ন। আপনি একটু আগেই বলেছেন, নিজ দেশ ছেড়ে যাওয়ায় আক্ষেপ নেই। তার পরও আরেকবার জিজ্ঞেস করছি, আসলেই আক্ষেপ নেই?
অ্যাকারম্যান: নাহ… নেই। (একটু ভেবে)… হ্যাঁ, আপনি যদি টেস্ট ক্রিকেটের কথা বলেন, সব ক্রিকেটারই তো খেলতে চায়। আমার প্রথম শ্রেণির রেকর্ডও যথেষ্ট ভালো। তবে সবাই তো সবকিছু পায় না। আমি ওটার পেছনে ছুটলে হয়তো অনেক কিছু হারাতাম, যা এখন পেয়েছি।
আরেকটা ব্যাপার হলো, লোকে সিদ্ধান্ত নেয় তার বাস্তবতা বুঝে, পরিস্থিতি অনুযায়ী। ভবিষ্যত তো কেউ দেখতে পারে না। ওই সময় যেটা সবচেয়ে ভালো মনে হয়, সেটাই করতে হয়। আমার ক্যারিয়ারের ওই সময়ে, সেরা সিদ্ধান্তই নিয়েছিলাম। ক্রিকেট ও জীবন নিয়ে আমি খুবই খুশি।