চার্লসের ঝড়ে মাশরাফিদের হারিয়ে কুমিল্লার চতুর্থ শিরোপা

লিটন দাসের ফিফটির পর চার্লসের দুর্দান্ত ইনিংসে বিপিএল ফাইনালে সিলেটকে হারাল কুমিল্লা।

ক্রীড়া প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Feb 2023, 04:19 PM
Updated : 16 Feb 2023, 04:19 PM

একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার… হয়তো পাঁচবারও। বারংবার চেষ্টায়ও পারলেন না রুবেল হোসেন। তার হাত ফসকে, বাহুতে, বুকে, কাঁধে লেগে বল পড়ে গেল মাটিতে। সহজ ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেলেন জনসন চার্লস। ৮ রানে জীবন পাওয়া ব্যাটসম্যান পরে হয়ে উঠলেন অপ্রতিরোধ্য। শেষ দিকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সেই রুবেলের বোলিং গুঁড়িয়েই তিনি দলকে নিয়ে গেলেন দারুণ জয়ের পথে। ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানের বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে জয়ের ঠিকানায় পৌঁছে গেল কুমিল্লা।

তিন শিরোপার রেকর্ডকে আরও সমৃদ্ধ করে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স আরও একবার জিতে নিল বিপিএলের ট্রফি। ফাইনালে সিলেট স্ট্রাইকার্সকে হারাল তারা ৭ উইকেটে।

প্রথম তিন ম্যাচ হেরে টুর্নামেন্ট শুরু করা দলটিই শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল টানা ১১ জয়ে বিপিএল রেকর্ড গড়ে।

মিরপুর শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে বৃহস্পতিবার নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুশফিকুর রহিমের দারুণ দুটি ইনিংসে সিলেট ২০ ওভারে তোলে ১৭৫ রান। কুমিল্লা সেই রান টপকে যায় ৪ বল বাকি থাকতে।

ওপেনিংয়ে ৩৯ বলে ৫৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে কুমিল্লাকে এগিয়ে নেন লিটন কুমার দাস। পরে ৭ চার ও ৫ ছক্কায় ৫২ বলে ৭৯ রানের অপরাজিত ইনিংসে জয়ের নায়ক জনসন চার্লস।

কুমিল্লা উইকেট বেশি না হারালেও আঁটসাঁট বোলিংয়ে তাদেরকে যথেষ্টই চাপে ফেলেছিল সিলেট। শেষ ৪ ওভারে প্রয়োজন ছিল ৫২ রান। তখনই রুবেলের এক ওভারে তিন ছক্কা ও ১ চারে সমীকরণ সহজ করে ফেলেন চার্লস। এরপর আর থামানো যায়নি চার্লস ও কুমিল্লাকে।

কুমিল্লার রান তাড়ার শুরুটা ছিল ঝড়ো। প্রথম ওভারে লিটনের বাউন্ডারিতে শুরু। পরের ওভারে তানজিম হাসান সাকিবকে তুলাধুনা করে লিটন ও সুনিল নারাইন নেন ২১ রান।

তৃতীয় ওভারে রুবেল আক্রমণে এসেই অবশ্য ফেরান নারাইনকে। পরের ওভারের প্রথম বলে বিদায় নেন অধিনায়ক ইমরুল কায়েসও। তবে রানের গতি ধরে রাখেন লিটন। চার্লস শুরুতে সময় নেন একটু।

পাওয়ার প্লেতে লিটনের রান ১৭ বলে ২৭। চার্লসের রান তখন ১১ বলে ৯।

পাওয়ার প্লে শেষে জ্বলে ওঠেন চার্লস। লিটনের ব্যাট থেকে আসতে থাকে চেনান সব নান্দনিক শট। রানের গতি ছুটতে থাকে। ১২ ওভারে কুমিল্লার রান পেরিয়ে যায় একশ।

৭০ রানের এই জুটি থামান রুবেল। নতুন স্পেলে ফিরে তিনি থামান লিটন দাসকে (৩৯ বলে ৫৫)। স্কয়ার লেগ সীমানায় দারুণ ক্যাচ নিয়ে আনন্দনৃত্যে মেতে ওঠেন শান্ত।

এরপরই রানের গতিতে একটু রাশ টেনে ধরেছিল সিলেটের বোলাররা। কিন্তু রুবেলের ওই ওভার আর চার্লসের শেষের তাণ্ডবে বদলে গেছে চিত্র। রুবেলের ওভারে ২৩ রানের পর তানজিমের ওভারে আসে ৮ রান। ২ ওভারে যখন প্রয়োজন ২১ রান, লুক উডের ওভারে দুটি ছক্কা ও এক চারে ম্যাচ কার্যত শেষ করে দেন চার্লস।

চার্লসের সঙ্গে ৪০ বলে ৭২ রানের অবিচ্ছিন্ন ম্যাচ জেতানো জুটিতে ১৭ বলে ২৫ রানে অপরাজিত থাকেন মইন আলি।

সিলেটের দুই বোলার রুবেল ও তানজিম মিলেই ৮ ওভারে দেন ৮৯ রান। শেষ ওভারের আনুষ্ঠানিকতার আগে বোলিং করতে দেখা যায়নি সিলেট অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাকে।

সিলেটের ঘাটতি কিছুটা ছিল ব্যাটিংয়েও। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা দলের হয়ে শান্ত ও মুশফিক যে ভিত্তি রচনা করেছিলেন, তাতে রানটা অন্তত আরও ১৫-২০ বেশি হতে পারত। কিন্তু শেষ দিকে রায়ান বার্ল, জর্জ লিন্ডা, থিসারা পেরেরার মতো বিদেশীরা শেষ দিকে কার্যকর ব্যাটিং করতে পারেননি।

ম্যাচের শুরুটা ছিল নাটকীয়। প্রথম বলে রান আউট হতে পারতেন দুই প্রান্তের যে কোনো ব্যাটসম্যান। কিন্তু ওভারথ্রো থেকে চারটি রান পেয়ে যান শান্ত। ওই ওভারে ব্যাটে থেকেই দুটি বাউন্ডারি পান শান্ত। শেষ বলে আবার ওভারথ্রো থেকে আসে ৫ রান। প্রথম ওভার থেকেই ১৮!

পরের ওভারের প্রথম বলেই কুমিল্লার আঘাত। তানভির ইসলামের জোরের ওপর করা সোজা বলে জায়গা বানিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড তৌহিদ হৃদয়। দুর্দান্ত পারফর্ম করা বিপিএলের শেষটা তার হলো শূন্যতে ফেরার হতাশায়।

আগের দুই ম্যাচে ক্যামিও ইনিংস খেলা মাশরাফি বিন মুর্তজার (১) ফাটকা এবার কাজে লাগেনি তিনে নেমে। এক ওভারে ১৮ রানে পরও পাওয়ার প্লেতে আসে ৪২ রান। পঞ্চাশ ছুঁতে লেগে যায় তাদের অষ্টম ওভার।

ওই ওভারেই তানভির ইসলামের বলে মিড উইকেটে শান্তর ক্যাচ ছাড়েন কুমিল্লা অধিনায়ক ইমরুল। ৩৭ রানে জীবন পেয়ে পরের বলেই বাউন্ডারি মারেন শান্ত। আরেক প্রান্তে মুশফিকও দারুণ খেলতে থাকেন। রানের গতিতে জোয়ার আসে নতুন করে।

শান্ত আসরে তার চতুর্থ ফিফটি স্পর্শ করেন ৩৮ বলে। এই পরিক্রমায় বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিপিএলে স্পর্শ করেন ৫০০ রান। দেশি-বিদেশি মিলিয়ে আগে এই কীর্তি ছিল কেবল রাইলি রুশোর। ২০১৯ আসরে তিনি করেছিলেন ৫৫৮ রান।

পঞ্চাশের পর মুকিদুল ইসলামের এক ওভারে এক ছক্কা ও দুই চারে রানের গতি বাড়ান শান্ত। তবে পরের ওভারেই মইনের বলে বোল্ড হয়ে থামে তার ৪৪ বলে ৬৪ রানের ইনিংস।

এরপর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন মুশফিক। কিন্তু আরেক পাশে সঙ্গী কাউকে পাননি। জীবন পাওয়ার পরও বার্ল উইকেট বিলিয়ে আসেন ১৩ রান করে। নারাইনের বলে জাবে শটে থিসারা পেরে উইকেট ছুড়ে দেন প্রথম বলেই। মুস্তাফিজের এক ওভারে দুই দফায় জীবন পেয়ে জর্জ লিন্ডা ওই ওভারেই আউট হন ৯ রান করে।

মুশফিক তবু দারুণ কিছু শটে বাড়ান দলের রান। ৫ চার ও ৩ ছক্কায় ৪৮ বলে অপরাজিত থাকেন ৭৩ রান করে। বিপিএলের ফাইনালে যা তার সেরা ইনিংস।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়িয়ে পুঁজি পেলেও তা যথেষ্ট হলো না সিলেটের জন্য। আরও একবার শিরোপার উৎসবে মেতে উঠল কুমিল্লা।

সংক্ষিপ্ত স্কোর: 

সিলেট স্ট্রাইকার্স : ২০ ওভারে ১৭৫/৭ (শান্ত ৬৪, হৃদয় ০, মাশরাফি ১, মুশফিক ৭৪*, বার্ল ১৩, পেরেরা ০, লিন্ডা ৯, জাকির ১, তানজিম ০*; রাসেল ৩-০-৩১-১, তানভির ৩-০-২১-১, নারাইন ৪-০-৩৩-১, মুস্তাফিজ ৪-০-৩১-২, মইন ৪-০-৩১-১, মুকিদুল ২-০-২১-০)। 

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স : ১৯.৪ ওভারে ১৭৬/৩ (লিটন ৫৫, নারাইন ১০, ইমরুল ২, চার্লস ৭৯*, মইন ২৫*; রুবেল ৪-০-৩৯-২, তানজিম ৪-০-৫০-০, লিন্ডা ৪-১-১৪-১, উড ৪-০-৩৮-০, পেরেরা ১-০-১২-০, বার্ল ২-০-১৮-০, মাশরাফি ০.২-০-৩-০)। 

ফল: কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ৭ উইকেটে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: জনসন চার্লস।

ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট: নাজমুল হোসেন শান্ত।

Also Read: রানের রেকর্ড গড়ে ‘ম্যান অব দা টুর্নামেন্ট’ শান্ত

Also Read: বোলিংয়ে শীর্ষে তানভির, ব্যাটিংয়ের সেরা শান্ত

Also Read: বিপিএলে কে জিতলেন কোন পুরস্কার

Also Read: মাশরাফিদের হারিয়ে মাশরাফিকে ছাড়িয়ে লিটন