বিশ্বাসের পথ ধরেই প্রায় ৮ বছর পর রনির ফেরা

সেই ২০১৫ সালের জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর আর কখনও সুযোগ না পেলেও নিজের ওপর বিশ্বাসটা কখনও হারাননি এই ব্যাটসম্যান।

শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদশাহাদাৎ আহমেদ সাহাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 March 2023, 12:17 PM
Updated : 2 March 2023, 12:17 PM

‘এতটাও বয়স হয়নি যে (জাতীয় দলে) ফেরার চিন্তা করব না’- এবারের বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের প্রথম ম্যাচে ঝড়ো ইনিংস খেলে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন রনি তালুকদার। ৩২ বছর বয়স আসলেও খুব বেশি নয় বটে। তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন! ত্রিশ পেরিয়ে এদেশে জাতীয় দলে ফিরতে পারার নজির বিরল। তবে পারফরম্যান্স দিয়ে সেই নিজের কথাকে সত্য প্রমাণ করেছেন রনি। দীর্ঘ বিরতির পর তিনি আদায় করে নিয়েছেন দলে জায়গা। এখন তিনি মুখিয়ে নিজেকে মেলে ধরে দলের জয়ে অবদান রাখতে। 

এবারের বিপিএলে সেরা পারফর্মারদের একজন রনি। রংপুর রাইডার্সের তৃতীয় হওয়ায় তার ছিল বড় অবদান। ১৩ ম্যাচে ৩ ফিফটিতে করেন আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২৫ রান। এই পারফরম্যান্সে খুলে যায় জাতীয় দলে ফেরার দুয়ারও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচের দলে সুযোগ পান এই ব্যাটসম্যান। 

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে তার পরিচয় প্রায় ৮ বছর আগে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি অভিষেক হয় তার। যদিও সেবার ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন অন্য দুই সংস্করণে!

ঘরোয়া প্রথম শ্রেণির মৌসুমে সেবার ১০ ম্যাচে ৪ সেঞ্চুরিতে ৯০১ রান করেছিলেন ৫৩ গড়ে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে করেছিলেন ৫১ গড়ে ৭১৪ রান। তবে তখন টেস্ট দলে সুযোগ হয়নি তার। বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে স্কোয়াডে নেওয়া হয় তাকে। কিন্তু খেলার সুযোগ পাননি। পরে তাকে নামিয়ে দেওয়া হয় দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে। 

এমনিতে টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যান হলেও অভিষেকে রনিকে খেলানো হয় সাত নম্বরে। বাংলাদেশের ৩১ রানে হারা ম্যাচে দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২১ রান করেন তিনি। 

সেটিই হয়ে আছে এখন পর্যন্ত তার একমাত্র আন্তর্জাতিক ম্যাচ। 

এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে গড়পড়তা প্রায় প্রতি মৌসুমেই রান করেছেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোতে টি-টোয়েন্টি সামর্থ্যের ঝলকও কিছু দেখিয়েছেন।  তবে বরাবরই ভালো শুরুর পর ধারাবাহিকতায় ঘাটতি রয়ে গেছে তার। ২০১৮-১৯ বিপিএলে ৩১৭ রান করেছিলেন। এছাড়া আর কোনো আসরে দেড়শ রানও করতে পারেননি। ২০২১ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতে করেছিলেন ৩৬৬ রান।

সেই রনি এবারের বিপিএলে নিজেকে উপস্থাপন করেন নতুন রূপে। এই রনি দারুণ ধারাবাহিক!

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে খেলেন ৩১ বলে ৬৭ রানের ইনিংস। স্রেফ ১৯ বলে পঞ্চাশ ছুঁয়ে গড়েন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দ্রুততম ফিফটির রেকর্ড। পুরো আসরে ধারাবাহিকতা ধরে রেখে রংপুরের শেষ ম্যাচে সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে তিনি করেন ৬৬ রান। 

পুরো টুর্নামেন্টে ৫১টি চারের সঙ্গে ১২টি ছক্কা মারেন রনি। তার চেয়ে বেশি চার মারেন সর্বোচ্চ ৫১৬ রান করা নাজমুল হোসেন শান্ত (৫৭)। 

পারফরম্যান্সের পুরস্কারও তিনি পেয়ে গেলেন দ্রুতই। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় নারায়নগঞ্জের এই ক্রিকেটার জানালেন উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া।

“অনুভূতি তো সত্যি বলতে অনেক ভালো। লক্ষ্য তো এটিই থাকে...জাতীয় দলে খেলা। (নির্বাচক) হাবিবুল বাশার ভাই ফোন দিয়ে বললেন, টি-টোয়েন্টি দলে আছি আমি। পরে শুভকামনা জানালেন, সাহস দিলেন।”

টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই রনিকে তার মা বলেছিলেন, বিপিএলে ভালো কিছু করতে হবে। ছেলে সেই কথা রেখে আরও বড় পুরস্কার পাওয়ার পর মায়ের আনন্দ সীমাহীন। একই দিনে প্রয়াত বাবার কথা খুব মনে পড়ছে রনির।


“খবরটা জানার পর বাসায় ফোন দিলাম, মায়ের সঙ্গে কথা বললাম। পরিবারের সবাই খুব খুশি। মা তো অনেক খুশি। স্ত্রী, বাকিরাও আশীর্বাদ করছেন যেন ভালো খেলতে পারি, বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছু করতে পারি।”

“এখন বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো মায়ের চেয়েও বেশি খুশি হতেন। এটা (জাতীয় দলে খেলা) আমার বাবার অনেক ইচ্ছা ছিল। বাবাকে খুব মিস করি। প্রথম ম্যাচ যে খেলেছিলাম, তার আগেই উনি মারা যান। আমার এই জিনিসগুলো দেখাতে পারলাম না বাবাকে...।”

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বয়সে জাতীয় দলে ফেরাটা অনেকটা অভাবনীয় কিছু। সঙ্গে যদি যোগ হয় ৮ বছরের বিরতি, তাহলে তো বলা যায় প্রায় অবিশ্বাস্যই। নিজের ওপর বিশ্বাসটাও অনেক সময় হারিয়ে যায় এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার পরিক্রমায়।

তবে রনি জানালেন, নিজের প্রতি আস্থা রেখেই তিনি ছুটে গেছেন বিশ্বাসের মন্ত্রে।


“আগে নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকতে হবে যে, আমি কী করতে পারি। আমার খেলার ধরনটা কিন্তু অমনই। টি-টোয়েন্টিতে কেমন খেলি, কী করতে পারব- সেই বিশ্বাসটা আগে নিজের প্রতি আনতে হবে। আর যদি ফিটনেস ঠিক থাকে, তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়, ইতিবাচক চিন্তা করার সাহসটা পাওয়া যায়।”


“আর একটা বিষয় হলো, নির্বাচক বা বিসিবির কর্মকর্তারা আমাকে বারবার বলেছেন যে, পারফর্ম করলে অবশ্যই সুযোগ আসবে। এই ইতিবাচক বার্তাটা সবসময়ই ছিল। সাম্প্রতিক সময়েও বলেছেন, যারা পারফর্ম করবে অবশ্যই সুযোগ দেওয়া হবে। তো সাহসটা পেয়েছি।”

জাতীয় দলের ফেরার লক্ষ্য তো পূরণ হলো। এবার তিনি তাকিয়ে একাদশে সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষায়। আর সেই সুযোগটি যদি আসে, তাহলে তার চাওয়া কাজে লাগানো।

ঘরোয়া ক্রিকেটে তার ব্যাটে দল জিতেছে তো কতবারই! এবার বিপিএলেই যেমন রংপুরের প্রথম ম্যাচেই জয়ের নায়ক ছিলেন তিনি। এখন তার চোখে স্বপ্ন, দেশের জয়ের নায়ক হওয়ার।


“চেষ্টা থাকবে (একাদশে) সুযোগ পেলে যেন ভালো কিছু করতে পারি, দেশের জন্য কিছু করতে পারি। আমার লক্ষ্য মূলত একটাই, দলের জন্য যেন কিছু করতে পারি, দলকে কিছু দিতে পারি।”

“আমি পারফর্ম করলাম কিন্তু দল হেরে গেল, এটার কোনো গুরুত্ব নেই আমার কাছে। আমি যদি ১০ রান করেও ম্যাচ জেতাতে পারি, সেটাই আমার কাছে বড়। মূল কথা, আমি ম্যাচ জেতাতে চাই।”