রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বল ব্যাট-প্যাড হয়ে জমা পড়ল স্লিপে থাকা বিরাট কোহলির হাতে। সমাপ্তি হলো জাকির হাসানের ৩১৫ মিনিটের লড়াইয়ের। তার চোখেমুখে নেমে এলো রাজ্যের হতাশা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মাঠও ছাড়লেন এমনভাবে, যেন ব্যর্থ হয় ফিরছেন!
অনন্য এক সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েও করেও তার অমন হতাশার কারণ জানা গেল দিন শেষে। অভিষিক্ত ব্যাটসম্যানের চাওয়া ছিল, ইনিংস আরও লম্বা করা।
আউট হওয়ার আগে যা করেছেন, তাতে তার নাম লেখা হয়ে গেছে রেকর্ড বইয়ে। তবে অর্জনের প্রতিক্রিয়াও অনেকটাই ভাবলেশহীন তিনি। সেঞ্চুরির পরের অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে শুধু বললেন, “ভালো লেগেছে আসলে, আর কিছু না।”
অভিব্যক্তিতে নেই বাড়তি উচ্ছ্বাস অথবা আনন্দের আতিশয্যে ভেসে যাওয়ার কোনো চিহ্ন। বরং আরও বেশিক্ষণ খেলতে না পারার আফসোস পোড়াচ্ছে তাকে।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে এই অভিযানে সোয়া ৫ ঘণ্টা উইকেটে ছিলেন জাকির। চতুর্থ ইনিংসে ভারতের ৫১৩ রানের চ্যালেঞ্জের মুখে খেলেন ১৩ চার ও ১ ছয়ে ২২৪ বলে ১০০ রানের ইনিংস। তবে সেঞ্চুরির পর আর এক রানও করতে পারেননি বাঁহাতি এ ওপেনার।
মাঠ ছাড়ার সময় তার চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল হতাশার ছাপ। ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে জাকির জানান, নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারার অতৃপ্তির কথা।
“আউট হওয়ার পর একটু হতাশ ছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম দলের জন্য যদি আরও একটু লম্বা ব্যাটিং করা যায়। আজকের দিনটা যদি আমিই পার করতে পারি। তাহলে কালকের (রোববার) জন্য আরেকটু সহজ হবে। এ চেষ্টা ছিল আমার।”
দিন শেষে অপরাজিত থাকতে না পারলেও চতুর্থ দিন জাকিরের সেঞ্চুরিই বাংলাদেশের প্রাপ্তি। আগের দিন করা ১৭ রান নিয়ে খেলতে নেমে কোনো তাড়াহুড়ো করেননি তিনি। অশ্বিন, আকসার প্যাটেল বা কুলদিপ যাদবকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলেন জাকির। মোহাম্মদ সিরাজ, উমেশ যাদবের পেসও টলাতে পারেনি তাকে।
১০১ বলে ফিফটি ছোঁয়ার পর সেঞ্চুরি করতে জাকির খেলেন আরও ১১৮ বল। সকালের সেশনে কিছুটা হাত খুললেও লাঞ্চ বিরতির পর রয়েসয়ে খেলেন তিনি। সহজাত ওপেনার না হলেও ইনিংস সূচনার পর থেকে যতক্ষণ উইকেটে ছিলেন, ২৪ বছর বয়সী ব্যাটসম্যানর নিয়ন্ত্রণ ছিল দেখার মতো।
অভিষিক্ত ওপেনার হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান তিনি। টেস্ট ইতিহাসে চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় ওপেনার। সব মিলিয়ে অভিষেক টেস্টে চতুর্থ ইনিংসে সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন জাকিরসহ ৯ জন ব্যাটসম্যান। সবকিছুই তিনি করেছেন বিশাল লক্ষ্যের বোঝা মাথায় নিয়ে।
এমন ব্যাটিংয়ের আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন ভারত ‘এ’ দলের বিপক্ষে ‘আনঅফিসিয়াল’ টেস্ট সিরিজ থেকে। সপ্তাহ দুয়েক আগে নবদিপ সাইনি, জয়ন্ত যাদব, মুকেশ কুমারদের নিয়ে সাজানো বোলিং আক্রমণের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে প্রায় সাড়ে ১০ ঘণ্টা ব্যাট করে ৪০২ বলে ১৭৩ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
৩৫৩ রানে পিছিয়ে থাকার চাপ সামলে ওই ইনিংসে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ম্যাচ বাঁচান জাকির। সেই ইনিংসের তরতাজা রেশ তাকে বিশ্বাস জুগিয়েছে এই ম্যাচে ভালো করতে।
“ওই ইনিংসটার (‘এ’ দলের হয়ে ১৭৩) জন্য মনের ভেতরে আত্মবিশ্বাস ছিল। ওই ম্যাচের প্রক্রিয়াটা অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করছিলাম আর কী। ওইটাই আমার মাথায় চিন্তা ছিল যে, প্রক্রিয়াটা ঠিক রেখে খেলার চেষ্টা করব।”
“ওইখানে (‘এ’ দলের সিরিজে) ভালো একটা ইনিংস খেলার পর জাতীয় দলে ডাক পাওয়া একটা টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারেন। আমার কাছেও মনে হয়। তবে প্রক্রিয়াটা ঠিক রাখা জরুরি ছিল।”
‘এ’ দলের সিরিজের আগে জাতীয় ক্রিকেট লিগেও উজ্জ্বল ছিলেন জাকির। ওই আসরে ৫৫.২৫ গড়ে আসরের সর্বোচ্চ ৪৪২ রান করেন সিলেট বিভাগের অধিনায়ক। সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ২১৩ রানের ইনিংসটিও ছিল তার ব্যাট থেকে। এজন্য তাকে জিততে হয়েছে ডিউক বলের কঠিন চ্যালেঞ্জ।
প্রথমবারের মতো জাতীয় লিগ খেলা হয়েছে ডিউক বলে। খাড়া সিম ও চকচকে শক্ত এই বলে প্রায় সারাদিনই সুইং পান মেলে। যা কঠিন করে তোলে ব্যাটসম্যানদের কাজ। সেই পরীক্ষায় উতরানোর পর এবার কুকাবুরা বলে ভালো খেলা রসদ পেয়ে যান জাকির।
“(জাতীয় লিগে) এবার যে কন্ডিশন ছিল... ডিউক বল সবসময় সুইং করেছে। এমনও হয়েছে ৮০ ওভার পর্যন্ত সুইং করেছে। ওই সুইংটা মোকাবিলা করায়... কোকাবুরা বলে সাধারণত একটু কম সুইং হয় ডিউকের তুলনায়। আমার কাছে মনে হয়, সুইংটা একটু কমের কারণে কিছুটা সহজ হয়েছে।”
এছাড়া জাতীয় লিগে তিন বা চার নম্বরে খেললেও ডিউক বল হওয়ায় পুরো সময় নতুন বল মোকাবিলার মতো করেই খেলার অনুশীলনটাও হয়েছে জাকিরের। যা ওপেনিংয়ে মানিয়ে নেওয়ার পেছনেও রেখেছে ভূমিকা।
“(আগে) ওপেনিং খুব একটা করিনি, তিন-চারে সবসময় ব্যাটিং করেছি। তবে নতুন বল সবসময়ই মুখোমুখি হতে হয় প্রথম শ্রেণিতে। আসলে মাথায় ছিল, (ওপেনারদের) এক বলেই আউট হওয়ার চান্স থাকে। তখন তো তিনে ব্যাটিং করলেও নতুন বলই খেলতে হয়। তাই ওই আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমি পারব।”
২০১৮ সালে প্রথমবার জাতীয় দলে সুযোগ পান জাকির। তখন তার নামের পাশে ছিল ‘টি-টোয়েন্টি বিশেষজ্ঞের’ তকমা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি দিয়েই আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় তার। ওই ম্যাচে ১০ রান করে আউট হওয়ার পর লম্বা সময়ের জন্য ছিটকে যান দল থেকে।
এবার ফিরেছেন সাদা পোশাকের টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে। মাঝের সময়ে নিজের খেলার ধরন বদলে বাড়তি মনোযোগ দেন লাল বলের সংস্করণে। টেস্ট অভিষেকের আগে খেলেছেন ৬৯টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। তার চেয়ে বেশি ম্যাচ খেলে টেস্ট অভিষেক হয়েছে বাংলাদেশের আর মাত্র ৩ জন ক্রিকেটারের।
টেস্ট অভিষেকের আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মোট ২৭টি পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেছেন জাকির। এর মধ্যে ১৩টিকে রূপ দিয়েছেন সেঞ্চুরিতে। এবার আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রথম ফিফটিকে নিয়ে গেছেন ১০০ রানে। এই তালিমটা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকেই পাওয়া, বলছেন জাকির।
“অবশ্যই, প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলার কারণে আমি আমার টেম্পারমেন্টটা ধরে রাখতে পেরেছি। ওইখানে অনেকগুলো বড় ইনিংস আছে, আবার ছোটও আছে। তো প্রক্রিয়াটা কিছুটা হলেও আমার আয়ত্তে ছিল যে আমি এভাবে রান করতে পারি।”