চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি
জশ ইংলিসের জন্ম, বেড়ে ওঠা ও ক্রিকেটের পাঠ, সবই ইংল্যান্ডে, সেই তিনি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অসাধারণ খেলে হারিয়ে দিলেন ইংলিশদের।
Published : 23 Feb 2025, 10:42 AM
ধারাভাষ্যে মাইক আথারটন কয়েকবার জশ ইংলিসকে বলে ফেলেছিলেন ‘ইংলিশ।’ সেটা নিয়ে বেশ মজা করলেন সহধারাভাষ্যকার। ম্যাচ শেষে পুরস্কার বিতরণী আয়োজনে সাবেক এই ইংল্যান্ড অধিনায়ক মজা করে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথকে মজা করে বললেন, “জশ ইংলিসের ইংলিশ পাসপোর্ট কি এখনও আছে?”
এতক্ষণ পর্যন্ত বেশ রাশভারী চেহারায় কথা বলছিলেন স্মিথ। আথারটনের প্রশ্ন শুনে শব্দ করে হেসে উঠলেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক। চওড়া হাসিতে ছোট্ট করে বললেন, ‘জানি না আছে কি না, তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে… যদিও তাকে ছাড়ছি না, সে কোথাও যাচ্ছে না…।”
স্মিথ সেটুকু না বললেও চলত। ইংলিস এখন পুরোদমে অস্ট্রেলিয়ান তো বটেই, অস্ট্রেলিয়া দলেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোথাও চলে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না!
সময়টাও এখন তার। সপ্তাহ তিনেক আগেও টেস্ট অভিষেকে শ্রীলঙ্কায় দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি উপহার দিলেন ৯০ বলে। এবার ওয়ানডেতে প্রথম শতরানের স্বাদ পেলেন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ম্যাচেই। সেটিও এমন পরিস্থিতিতে, যা তার ইনিংসটিকে করে তুলেছে বিশেষ কিছু।
লাহোরে শনিবার ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার লক্ষ্য ছিল ৩৫২। আইসিসি টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সাড়ে তিনশ রান তাড়ায় জয়ের নজির নেই তখনও। খর্বশক্তির দল নিয়ে আসা অস্ট্রেলিয়া সেই রান তাড়ায় পাঁচ ওভারের মধ্যে হারায় ব্যাটিং লাইন আপের মূল দুই ভরসা ট্রাভিস হেড ও স্টিভেন স্মিথকে। পরে ম্যাথু শর্ট (৬৩) ও মার্নাস লাবুশেন (৪৫) একটি জুটি গড়ে তুললেও ইনিংস বড় করতে পারেননি। এই দুজনের বিদায়ে দলের স্কোর দাঁড়ায় ৪ উইকেটে ১৩৬।
অস্ট্রেলিয়ার পরাজয়কেই তখন মনে হচ্ছিল অবিশ্যম্ভাবী।
কিন্তু ইংলিসের তো অস্ট্রেলিয়ান মানসিকতা গেঁথে গেছে হৃদয়ে। সঙ্গী পেলেন তিনি অ্যালেক্স কেয়ারিকে। দুজনই মূলত কিপার। তবে এই ম্যাচে কিপিং করেছেন ইংলিস। মাঠে তিনটি ক্যাচ নিয়েছেন কেয়ারি। এর মধ্যে প্রথমটি অসাধারণ, তৃতীয়টি দুর্দান্ত। ফিল্ডিংয়ের সেই আত্মবিশ্বাস প্রতিফলিত হলো কেয়ারির ব্যাটিংয়ে। ইংলিস ছিলেন নিজের সেরা ছন্দে।
সব চাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১১৬ বলে ১৪৬ রানের জুটি গড়লেন দুজন। ৬৩ বলে ৬৯ রান করে কেয়ারি আউট হলেও ইংলিসের থামাথামি নেই। চোখধাঁধানো পুল-হুক, কাট, রিভার্স র্যাম্প আর রিভার্স ল্যাপ, দুর্দান্ত সব ড্রাইভে ইনিংস সাজিয়ে দলকে জিতিয়ে অপরাজিত রইলেন ৮৬ বলে ১২০ রানের ইনিংস খেলে।
ইনিংসটি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বলেও তা আলোচনার খোরাক জোগাল আরও।
ইংলিসের ইংলিশ সংযোগ সম্পর্কে যারা জানেন না, তারা এই আলোচনায় একটু অবাক হতে পারেন। অস্ট্রেলিয়ার ইংলিস আদতে জন্মসূত্রেই ইংলিশ।
১৯৯৫ সালের মার্চে তার জন্ম ইংল্যান্ডের লিডসে। বেড়ে ওঠাও সেখানেই। তার বাবা-মাও ইংল্যান্ডেরই। সত্যিকারের ক্রিকেট শিক্ষার শুরু করেন তিনি ইয়র্কশায়ারের একাডেমিতে। এই কাউন্টি দলের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলেও খেলেছেন চার মৌসুম। ইংল্যান্ডের হয়ে খেলর স্বপ্নই দেখতেন তখন।
তবে নিয়তির লিখন ছিল ভিন্ন। তার বাবা-মা ছুটি কাটাতে প্রায়ই যেতেন অস্ট্রেলিয়ায়। দেশটিকে তাদের এতটা ভালো লেগে যায় যে, সেখানেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। ইংলিসের বয়স যখন ১৪, পুরো পরিবার পাকাপাকিভাবে পাড়ি জমায় অস্ট্রেলিয়ায়।
এরপর অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট কাঠামোতেই নিজেকে গড়ে তুলেছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফর্ম করেছেন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্নের সীমানা পেরিয়েছেন। ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটেও অবশ্য খেলেছেন। লেস্টারশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে, টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে খেলেছেন। দা হান্ড্রেড টুর্নামেন্টে খেলেছেন লন্ডন স্পিরিটের হয়ে। অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডে দলে প্রথমবার সুযোগ পান তিনি ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। সেটির পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল ওই মৌসুমে টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে তার পারফরম্যান্সের।
ওই বিশ্বকাপে তিনি খেলার সুযোগ পাননি। তবে পরে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন ক্রমেই। টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ২৮ ইনিংস খেলে দুটি সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তার ৪৩ বলের সেঞ্চুরি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড। ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছেন ৪৭ বলে।
এবার টেস্ট ও ওয়ানডেতে সেঞ্চুরি করে ফেললেন তিন সপ্তাহের মধ্যে। তিন সংস্করণেই সেঞ্চুরি করা চতুর্থ অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান তিনি। তার এই কীর্তি গড়তে লাগল সব মিলিয়ে স্রেফ ৫৬ ইনিংস।
তবে তিনি নিজে এখনও পর্যন্ত ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস বলছেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেঞ্চুরিকেই।
“পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করলে হয়তো এটি আমার সেরা ইনিংস। এটা সত্যিই স্পেশাল। আইসিসি আসরে ছাপ রাখার তাড়না থাকে সবার, দলকে ম্যাচ জেতাতে সহায়তা করার ইচ্ছে থাকে। কাজেই এটিই হয়তো (সেরা)… তবে আরও পরে গিয়ে বুঝতে পারব ভালোভাবে।”
অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন তিনি ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সমর্থক ছিলেন। এই ম্যাচের পর সেই প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, “ওসব দিন অনেক আগেই অতীত হয়ে গেছে!”
ইংল্যান্ডে থাকা আত্মীয়দের কাছ থেকে অনেক ম্যাসেজ পাচ্ছেন বলে জানালেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এমন ইনিংস বলে চর্চাও হচ্ছে প্রচুর। তবে ইংলিস বেশি খুশি জয় দিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করতে পারায়।
“সত্যি বলতে, কার বিপক্ষে ইনিংসটি খেলেছি, এটা ততটা মুখ্য নয়। এটা খুব আঁটসাঁট ও দ্রুত টুর্নামেন্ট। আমরা জানি, ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে আমরা কীভাবে শুরু করেছিলাম। খুব ভালো শুরু করতে পারিনি তখন। জানতাম যে, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ওরকম করলে চলবে না। প্রথম ম্যাচ থেকেই ছন্দে থাকতে হবে।”
“সেটি করতে পারাই সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার, প্রথম ম্যাচেই জয়।”
ভারতে ২০২৩ বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচে বাজেভাবে হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। পরে টানা ৯ ম্যাচ জিতে তারা শিরোপা জিতেছিল। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শুরুর আগের দিন অধিনায়ক স্মিথ বলেছিলেন, এই টুর্নামেন্ট এত ছোট যে, শুরু থেকেই জিততে না পারলে উপায় নেই। এজন্য তিনি দলকে বার্তা দিয়েছেন, এখানে প্রথম ম্যাচটিই কোয়ার্টার-ফাইনাল।
অধিনায়ক প্যাট কামিন্সসহ নানা কারণে নিয়মিত দলের ছয়জন ক্রিকেটারকে ছাড়া খেলতে আসা অস্ট্রেলিয়া টুর্নামেন্ট শুরু করল ‘কোয়ার্টার-ফাইনাল’ জিতেই।