তামিম ইকবালের হৃৎস্পন্দন ফেরানোর ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ভূমিকা রাখেন মোহামেডানের ট্রেনার ইয়াকুব চৌধুরি ডালিম, চিকিৎসকরা পরে বলেছেন, ওই সময় ঠিকঠাক সিপিআর না দিলে তামিমকে হয়তো বাঁচানো যেত না।
Published : 25 Mar 2025, 07:20 PM
‘যারা তাকে সিপিআর দিয়েছিল, তখন যদি না দিত, তাহলে আজকে সুস্থ হলেও তামিমের মস্তিষ্কে সমস্যা হয়ে যেত। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল’- তামিম ইকবালের চিকিৎসা শুরুর আগে টানা ২০-২২ মিনিট ধরে সিপিআর দেওয়ার উপকারের কথা মঙ্গলবার এভাবেই বলছিলেন হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল ওয়াদুদ। ওই সিপিআর প্রক্রিয়ার পর হাসপাতালে তামিমের শতভাগ ব্লক হয়ে যাওয়া রক্তনালীতে স্টেন্ট বসানো হয় ডা. মনিরুজ্জামান মারুফের তত্ত্বাবধানে। সেদিন রাতে তামিমের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সময় ডা. মারুফ বলেন, “ওই সময় ঠিকঠাক সিপিআর দেওয়াটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নইলে হয়তো তামিমকে বাঁচানো যেত না…।”
তাৎক্ষনিক সিপিআর দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের প্রশংসা আদায় করে নেওয়া মানুষটির নাম ইয়াকুব চৌধুরি ডালিম। হাসপাতালে নেওয়া পথে অ্যাম্বুলেন্সে যখন তামিম অচেতন, দেহ প্রায় নিথর, ক্রমাগত তখন সিপিআর দিয়ে গেছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের এই ট্রেনার। তামিমের মুখ দিয়ে যখন ফেনা পড়তে শুরু করেছে, তখন ‘মাউথ টু মাউথ রিসাসিটেশন’ দিয়ে গেছেন তিনি। তার টানা প্রচেষ্টাই ফিরিয়ে আনে তামিমের হৃৎস্পন্দন।
তামিমের চিকিৎসায় পরের কাজগুলো করেন মারুফ ও কেপিজে স্পেশালাইজড হাসপাতালের প্রশিক্ষিত দল। দ্রুততম সময়ে এনজিওগ্রাম করে হার্টের ‘লেফট এন্টেরিয়র ডিসেন্ডিং আর্টারি’তে ব্লক শনাক্ত করেন তারা। পরে কালক্ষেপণ না করে স্টেন্ট (রিং) বসান ডা. মারুফ।
সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে জ্ঞান ফিরে আসে তামিমের এবং ধীরে ধীরে উন্নতি হতে থাকে শারীরিক অবস্থার। তবে দুপুরের পর থেকে প্রায় পুরোটা সময় হাসপাতালের চিকিৎসক দল ও তামিমের ঘনিষ্ঠদের মুখে মুখে ছিল মোহামেডানের ট্রেনার ডালিমের ভূমিকার কথা।
গত কয়েক বছর ধরে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে বিভিন্ন দলের হয়ে ট্রেনারের কাজ করছেন ডালিম। তবে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ও স্মরণীয় দিনটি তিনি কাটিয়েছেন সোমবার। যেখানে দেশের সর্বকালের সেরা ওপেনারের জীবনযুদ্ধে বড় অবদান রেখেছেন তিনি।
কেপিজে হাসপাতালের চিকিৎসকদের ভাষায় তামিমকে ‘নতুন জীবন’ দেওয়ার পরদিন বিসিবিতে যান ডালিম। বোর্ড কর্তারাও তার তাৎক্ষণিক ভূমিকার জন্য বাহবা দেন।
পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় ওই সময়ে ফিরে যান ডালিম।
“ম্যাচের টসের সময়ও তামিমের অবস্থা ভালো ছিল। টস করে আসার পর বুকে ব্যথার কথা বলেন তিনি। এমনিতে যেটা হয়, বুক ব্যথা হলে আমরা গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট খেয়ে থাকি। খাওয়ার পরও কোনো উন্নতি হয়নি দেখে তামিম ভাই নিজ থেকেই বলছিলেন যে, ‘আমি হাসপাতালে যাব।’ তারপর আমরা উনার গাড়িতে করেই হাসপাতালে গেলাম। সেখানে রুটিন চেক-আপ করা হয় এবং খাবার যেটা প্রয়োজন ছিল তাকে খাওয়ানো হয়।”
হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পথে তামিম নিজেই যোগাযোগ করে ঢাকায় যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু হেলিকপ্টারে আর উঠতে পারেননি দেশের সাবেক অধিনায়ক। আগেই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করে অচেতন হয়ে পড়েন তিনি।
তখন থেকেই শুরু হয়ে ডালিমের তৎপরতা। একসময় তামিমের মুখ দিয়ে ফেনা ঝরতে শুরু হলে 'মাউথ টু মাউথ রিসাসিটেশন'ও দেন তিনি।
“পরে তৎক্ষনাৎ ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা হয়। হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য মাঠে ফেরার সময় বিকেএসপির গেটে ঢুকতেই তামিম অচেতন হয়ে পড়েন। তখন বুঝলাম যে, তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তখন আমি কোনো হৃৎস্পন্দন না পেয়ে সিপিআর দেওয়া শুরু করি।”
“এর মধ্যে হেলিকপ্টার চলে আসে। কিন্তু ওই অবস্থায় তাকে হেলিকপ্টারে উঠাব কি না, তা নিয়ে আমরা দোটানায় পড়ে যাই। শেষপর্যন্ত (বিকেএসপির চিকিৎসক) সামির ভাইয়ের সঙ্গে মিলে সিদ্ধান্ত নেই যে আবার হাসপাতালে ফিরব। তখনও কিন্তু সিপিআর চলছিল। মাউথ ব্রিদিংও করতে হয়েছে তখন।”
মাঠ থেকে দ্বিতীয়বার হাসপাতালে যাওয়ার সময় ডালিমদের সঙ্গে ছিলেন ম্যাচ রেফারি দেবব্রত পাল। ডালিম বললেন, তামিমের পরিবার ও বিসিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে নেন দেবব্রত।
“আমাদের সঙ্গে ম্যাচ রেফারি দেবুদা (দেবব্রত পাল) ছিলেন। তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্মতি নেন যে তামিমকে আমরা হেলিকপ্টারে ওঠাচ্ছি না, হাসপাতালে যাচ্ছি। আমি তখনও সিপিআর চালিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঝামাঝি অবস্থায় তার একটা সাড়া পাই। যেটা ভালো দিক ছিল। এরপর তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা দ্রুততার সঙ্গে বাকি সব করেন।”
ডালিম জানান, হাসপাতালে যাওয়ার পথে তামিমকে প্রায় ৮ থেকে ১০ রাউন্ড সিপিআর দেন তিনি।
“সিপিআর দেওয়ার প্রটোকল হলো, বুকে ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর দুইবার করে ‘মাউথ ব্রিদিং’ করতে হবে। আমিও ৩০ বার চাপ দেওয়ার পর মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিচ্ছিলাম। এভাবেই চলছিল সিপিআর দেওয়ার সময়টা। সবমিলিয়ে মনে হয় ২৫০ থেকে ৩০০ বার বুকে চাপ দিতে হয়েছিল।”
ইয়াকুব মূলত একজন ট্রেনার। তার কাজ আলাদা। তবে তিনি জানালেন, সিপিআর দেওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে তার।
“সিপিআর ও ফার্স্ট এইডের ওপর সার্টিফাইড কোর্স করা আছে আমার। সিপিআর বা মাউথ ব্রিদিং শুধু ডাক্তার বা ফিজিওরই করতে হবে, এমনটা জরুরি নয়। এটা যে কেউ করতে পারে। তবে কত মসৃণভাবে এটা দিতে পারে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।”
তামিমের জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ওই জরুরি মুহূর্তে স্থির থেকে সিপিআর ও অন্যান্য সব করা একদমই সহজ ছিল না। তিনি নিজেও বড় বিপদের আশঙ্কা করছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, এক পর্যায়ে তার মনে হচ্ছিল যে তামিমকে আর বাঁচাতে পারবেন না। তবে হাল না ছেড়ে দীর্ঘ দিন মাঠের ক্রিকেটে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ওই সময় তামিমকে ফেরানোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি।
“আমি নিজেকে শক্ত রেখেছিলাম। আমরা যারা মাঠে কাজ করি... ফিজিও, ট্রেনাররা এমন স্ট্রেস নিয়ে অভ্যস্ত। সেদিক থেকে ওই সময়টায় আমি আতঙ্কিত হইনি। নিজেকে স্বাভাবিক রেখেছি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে এসব প্রক্রিয়া ঠিকঠাক করার চেষ্টা করছিলাম। আল্লাহর বিশেষ দয়া যে আমরা তামিম ভাইকে আবার ফিরে পেয়েছি।”
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরে বলেছেন, মৃত্যুর দুয়ার থেকে তামিমের এই ফিরে আসা একদম ‘মিরাকল’, অনেকটা অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরেছেন দেশের সাবেক অধিনায়ক। যেখানে নিয়ামক হয়ে ছিলেন একজন ইয়াকুব চৌধুরি ডালিম