ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের প্রথম পর্ব শেষে শিরোপার লড়াইয়ে বাকিদের চেয়ে এগিয়ে শিরোপাধারী শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ও আবাহনী লিমিটেড।
Published : 18 Apr 2023, 04:14 PM
নতুন আসরেও পুরনো চেহারায় দেখা যাচ্ছে এনামুল হককে। তার সঙ্গে দুর্দান্ত একটি উদ্বোধনী জুটি গড়েছেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ। বোলিংয়ে দারুণ লড়াই চলছে রবিউল হক ও পারভেজ রসুলের মাঝে। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন চিরাগ জানি। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে দেশের মূল টুর্নামেন্ট ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগের প্রথম পর্বে দেখা গেছে নজরকাড়া সব পারফরম্যান্স।
তীব্র তাপপ্রবাহের মাঝেই সোমবার শেষ হয়েছে প্রথম পর্বের খেলা। দুই সপ্তাহ বিরতি দিয়ে আগামী ১ মে শুরু হবে শিরোপার সুপার লিগ। যেখানে খেলবে শীর্ষ ছয় দল।
প্রথম পর্ব শেষে নিজেদের শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে এখন পর্যন্ত ভালোভাবেই আছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব। তাদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে প্রতিযোগিতার সফলতম দল আবাহনী লিমিটেড।
ব্যাটিংয়ে বাকিদের ছাড়িয়ে সবার উপরে আবাহনীর দুই ওপেনার নাঈম ও এনামুল। বোলিংয়ের মুকুট শেখ জামালের ভারতীয় অলরাউন্ডার রসুলের। তার সঙ্গে আছেন সিটি ক্লাবের অধিনায়ক রবিউল।
সবার উপরে শেখ জামাল, পাশেই আবাহনী
প্রথম পর্বে ১০টি করে ম্যাচ জিতেছে শেখ জামাল ও আবাহনী। দুই দলের পয়েন্ট সমান ২০ হলেও হেড টু হেডে এগিয়ে থাকায় টেবিলের শীর্ষে শেখ জামাল।
তাদের একমাত্র হারটি মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে। টানা ৮ ম্যাচ জেতার পর নবম রাউন্ডে শেখ জামালের কাছে হারে আবাহনী। ফলে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে যায় নুরুল হাসান সোহানের নেতৃত্বাধীন দলটি।
সুপার লিগের টিকেট পাওয়া বাকি চার দল- লেজেন্ডস অব রূপগঞ্জ (১৬), প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব (১৪), মোহামেডান (১৩) ও গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স (১১)। মাত্র একটি করে ম্যাচ হারায় শিরোপা লড়াইটা শেখ জামাল ও আবাহনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
অবনমন এড়াতে রেলিগেশন লিগে লড়বে অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব (৬), শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাব (৪) ও ঢাকা লেপার্ডস (৩)। রেলিগেশন লিগ শেষে তলানির দুই দল নেমে যাবে প্রথম বিভাগে।
বাকি তিন দল রূপগঞ্জ টাইগার্স ক্রিকেট ক্লাব (৯), সিটি ক্লাব (৮) ও ব্রাদার্স ইউনিয়নের (৮) লিগ শেষ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। আগামী বছর নতুন মৌসুমে আবার মাঠে নামতে দেখা যাবে তাদের।
মোহামেডানের প্রত্যাবর্তন
গতবারের লিগে অল্পের জন্য রেলিগেশন লিগে পড়তে হয়নি মোহামেডানকে। নবম দল হিসেবে আসর শেষ করে তারা। এবারের শুরুটাও ছিল ব্যর্থতায় ভরা। প্রথম পাঁচ ম্যাচে ছিল না কোনো জয়। বৃষ্টির কল্যাণে পায় একটি পয়েন্ট।
সেখান থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। টানা ৬ ম্যাচ জিতে ১৩ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম হয়ে সুপার লিগ নিশ্চিত করেছে তারা।
ষষ্ঠ রাউন্ডের ম্যাচে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন শেখ জামালকে ২২ রানে হারিয়ে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু। এরপর একে একে অগ্রণী ব্যাংক, সিটি ক্লাব, ব্রাদার্স, শাইনপুকুর ও ঢাকা লেপার্ডসকে হারায় ইমরুল কায়েসের নেতৃত্বাধীন দলটি।
মোহামেডানের হয়ে এখন পর্যন্ত এক সেঞ্চুরি ও চার ফিফটিতে সর্বোচ্চ ৪৬৫ রান করেছেন ইমরুল। এক সেঞ্চুরি ও তিন ফিফটিতে মাহিদুল ইসলামের সংগ্রহ ৪৬১ রান। সবশেষ দুই জয়ে ম্যাচ সেরা মাহিদুল।
বোলিংয়ে স্রেফ ৬ ম্যাচেই দলের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন জেইক লিন্টট। বাঁহাতি লেগ স্পিনে তার শিকার ১৭ উইকেট। মূলত লিন্টট যোগ দেওয়ার পর থেকেই আর কোনো ম্যাচ হারেনি মোহামেডান।
রোমাঞ্চ ছড়িয়েছে শেষ ওভারের নাটকীয়তা
প্রথম পর্বে শেষ ওভারের শেষ বলে ফল হয়েছে দুইটি ম্যাচ। এছাড়া শেষ ওভারে ১ উইকেটের জয় এসেছে আরেক ম্যাচে।
গত ২ এপ্রিল ব্রাদার্সের ২১৯ রানের জবাবে ২ উইকেট হাতে নিয়ে শেষ ওভারে ৫ রান প্রয়োজন ছিল সিটি ক্লাবের। তৃতীয় বলে শেষ স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রাফসান আল মাহমুদের উইকেট হারায় তারা। ওভারের পঞ্চম বলে চার মেরে ম্যাচ জেতান দশ নম্বরে নামা ইফরান হোসেন।
নবাগত লেপার্ডসের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য জয় পায় লেজেন্ডস অব রূপগঞ্জ। ৫ উইকেট হাতে রেখে শেষ ওভারে ৭ রান প্রয়োজন ছিল লেপার্ডসের। চিরাগের করা ওভারের প্রথম ৫ বলে ৫ রান নিতে পারে তারা। শেষ বলে আশিক উল আলমের দারুণ ফিল্ডিংয়ে রান আউট হন সোহরাওয়ার্দী শুভ। ১ রানে ম্যাচ জিতে যায় রূপগঞ্জ।
ব্রাদার্সের পর রূপগঞ্জ টাইগার্স ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষেও শেষ ওভারে জয় পায় সিটি ক্লাব। শেষ বলে প্রয়োজন ছিল ২ রান। আলাউদ্দিন বাবুর অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বল পয়েন্টের দিকে ঠেলেই রানের জন্য ছোটেন রবিউল। সোজা ফিল্ডারের হাতে যাওয়ায় দ্বিতীয় রান নেওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ফিল্ডারের এলোমেলো থ্রোয়ে দ্বিতীয় রান নিয়ে ম্যাচ জিতে যায় সিটি ক্লাব।
উড়ছেন নাঈম শেখ, একই ছন্দে এনামুল
লিগের প্রথম পর্বে আবাহনীর ছুটে চলার পেছনে মূল কারিগর দুই ওপেনার মোহাম্মদ নাঈম শেখ ও এনামুল হক। গত আসরে প্রাইম ব্যাংকের হয়ে ১১শর বেশি রান করা এনামুল এবারও শুরু করেন একই ছন্দে। শুরু থেকেই নাঈম দেখাচ্ছেন ধারাবাহিকতা।
সাত রাউন্ড পর্যন্ত রান সংগ্রাহকের তালিকায় এগিয়ে ছিলেন এনামুল। শেষ চার রাউন্ডের ম্যাচে তাকে ছাড়িয়ে গেছেন নাঈম।
১১ ম্যাচে এক সেঞ্চুরি ও সাত ফিফটিতে ৭১৯ রান করেছেন নাঈম। সিটি ক্লাবের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে শূন্য রানে আউট হওয়ায় গড় নেমেছে একশর নিচে, ৮৯.৮৮। স্ট্রাইক রেটও দারুণ, ৯৫.২৩!
২০১৯ সালের প্রিমিয়ার লিগে ৮০৭ রান করেছিলেন নাঈম। তা ছাড়িয়ে যেতে সুপার লিগের পাঁচ ম্যাচে তাকে করতে হবে আর ৮৮ রান। হাজার রানের মাইলফলক ছুঁতে তার প্রয়োজন ২৮১ রান।
এনামুল ২ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটিতে করেছেন ৬৪৪ রান। প্রথম ৭ ম্যাচেই তিনি করেন ৫৭২ রান। শেষ চার ম্যাচে তেমন রানের দেখা পাননি ৩০ বছর বয়সী ওপেনার। গত আসরে ৩ সেঞ্চুরি ও ৯ ফিফটিতে তার সংগ্রহ ছিল রেকর্ড ১ হাজার ১৩৮ রান।
নাঈম-এনামুল ছাড়া পাঁচশর বেশি রান করতে পেরেছেন কেবল রবি তেজা। দুইটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটিতে ৬৩.৫০ গড়ে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের ভারতীয় অলরাউন্ডারের সংগ্রহ ৫০৮ রান।
বোলিংয়ে শীর্ষে রবিউল-রসুল
সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় সবার ওপরে আছেন সিটি ক্লাবের রবিউল হক ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের পারভেজ রসুল। দুজনই ১১ ম্যাচে নিয়েছেন ২৩টি করে উইকেট।
রবিউলের সিটি ক্লাবের টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাওয়ায় উইকেট বাড়ার সুযোগ নেই। তবে সুপার লিগে আরও পাঁচ ম্যাচ পাওয়ায় এককভাবে মুকুট নিজের মাথায় নেওয়ার সম্ভাবনা থাকছে শেখ জামালের ভারতীয় অলরাউন্ডারের সামনে।
প্রাইম ব্যাংকের হয়ে গত আসরে ৪ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন রবিউল। এবার দল বদলে পান সিটি ক্লাবের অধিনায়কত্ব। ১১ ম্যাচে তিনবার নিয়েছেন ৪ উইকেট। সেরা বোলিং শেখ জামালের বিপক্ষে নেওয়া ৩৬ রানে ৪ উইকেট। আবাহনীর বিপক্ষে তার নামের পাশে ছিল ৩৮ রানে ৪ শিকার।
অফ স্পিনে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন রসুল। আবাহনীর বিপক্ষে ১০ ওভারে ৪১ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি। বাকি ১০ ম্যাচেই পেয়েছেন উইকেটের দেখা। সেরা বোলিং ৩০ রানে ৪ উইকেট, গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে। মিতব্যয়ী বোলিংয়ে ওভারপ্রতি স্রেফ ৪.১০ রান দিয়েছেন রসুল।
এছাড়া অন্তত ২০ উইকেট নিতে পেরেছেন শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের বাঁহাতি স্পিনার হাসান মুরাদ। রেলিগেশন লিগের দুইটি ম্যাচ বাকি থাকায় উইকেট সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকছে তার।
ফের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে উজ্জ্বল চিরাগ জানি
গত আসরের মতো এবারও দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছেন লেজেন্ডস অব রূপগঞ্জের চিরাগ জানি। ব্যাট হাতে ৪৬৬ রানের পাশাপাশি বল হাতে তার শিকার ১৭ উইকেট। ব্যাটসম্যানদের তালিকায় তার অবস্থান অষ্টম, বোলিংয়ে ষষ্ঠ।
৫ ফিফটিতে ৭৭.৬৭ গড় ও ৯৮.১১ স্ট্রাইক রেটে রান করেছেন ভারতীয় অলরাউন্ডার। সর্বোচ্চ ৯৪ রানের ইনিংস খেলেন রূপগঞ্জ টাইগার্স ক্রিকেট ক্লাবের বিপক্ষে। বল হাতে ওভারপ্রতি ৪.৫৪ রান খরচ করেছেন চিরাগ। সেরা বোলিং ৩৭ রানে ৪ উইকেট।
প্রিমিয়ার লিগের গত আসরে রূপগঞ্জকে রানার্স আপ করার পথে টুর্নামেন্টের পঞ্চম সর্বোচ্চ ৫৯৭ রান করেন তিনি। এক সেঞ্চুরির সঙ্গে করেন ৪টি ফিফটি। এর সঙ্গে বল হাতে নেন তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৭ উইকেট।
মাশরাফির রেকর্ড, আলাউদ্দিন বাবুর হ্যাটট্রিক
গত ৭ মার্চ মোহামেডানের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া বোলিংয়ে স্রেফ ১৭ রানে ৫ উইকেট নেন লেজেন্ড অব রূপগঞ্জের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে ৫ উইকেটের রেকর্ড এটি। সেদিন তার বয়স ছিল ৩৯ বছর ১৭৩ দিন। আগের রেকর্ড ছিল মোহাম্মদ আশরাফুলের, ৩৭ বছর ৩৫৮ দিন।
একই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে ৪৫০ উইকেট পূরণ করেন মাশরাফি। ৪০০ ছোঁয়া বাংলাদেশি বোলার আছেন আর স্রেফ একজন- আব্দুর রাজ্জাক, ৪১২ উইকেট।
লিগের শুরুতে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন রূপগঞ্জ টাইগার্সের আলাউদ্দিন বাবু। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে পরপর তিন বলে হাবিবুর রহমান, অমিত মজুমদার ও রবি তেজাকে আউট করেন তিনি।
লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে বাংলাদেশের বোলারদের ১৪তম হ্যাটট্রিক এটি। লিস্ট 'এ' স্বীকৃতি পাওয়ার পর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে নবম। এছাড়া কুড়ি ওভারের স্বীকৃত ক্রিকেটেও হ্যাটট্রিক আছে আলাউদ্দিন বাবুর।