পেসারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ের পর অধিনায়ক আজিজুল হাকিম তামিমের আগ্রাসী ফিফটিতে পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ।
Published : 06 Dec 2024, 04:55 PM
ব্যাট-বলের লড়াই তো ছিলই, মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও চলছিল মাঠে। তাতে আজিজুল হাকিম যেন তেতে উঠলেন আরও। আলি রাজার বলে চোখধাঁধানো এক শটে ছক্কা মেরে প্রায় তেড়ে গিয়ে ইশারা করে দেখালেন কাউকে। পরের বলে ছক্কা মারলেন আরেকটি। তার শরীরী ভাষায় ছিল বারুদ, ব্যাটে ছিল স্কিল আর প্রতিজ্ঞার বিস্ফোরণ। ব্যক্তিগত এই লড়াইয়ে যেমন দাপটে জিতলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, তেমনি তার দলও যেন স্রেফ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল পাকিস্তানকে।
তিন পেসারের আগুনে বোলিং আগেই পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের ব্যাটিং। এরপর আজিজুলের দুর্দান্ত ইনিংসে ছাই হয়ে উড়ে গেল পাকিস্তানের সব আশা। ৭ উইকেটের জয়ে টানা দ্বিতীয়বার এসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে পৌঁছে গেল বাংলাদেশ।
টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের অভিযানে রোববার ফাইনালে বাংলাদেশ লড়বে ভারতের বিপক্ষে।
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেমি-ফাইনালে শুক্রবার পাকিস্তানকে ১১৬ রানেই গুটিয়ে দেয় বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপজ্জনক দুই ওপেনারকে শুরুতেই ফিরিয়ে বড় ধাক্কা দেন মারুফ মৃধা। পরে দারুণ বোলিংয়ে চার উইকেট শিকার করেন আরেক পেসার ইকবাল হোসেন ইমন।
রান তাড়ায় শুরুতে বাংলাদেশকে একটু চেপে ধরতে পেরেছিল পাকিস্তান। তবে আজিজুলের স্ট্রোকের ছটায় দূর হয়ে যায় সব চাপ। জয় ধরা দেয় মাত্র ২২.১ ওভারেই।
অর্ধেকের বেশি রান একাই করেন আজিজুল। ৭ চার ও ৩ ছক্কায় বাংলাদেশ অধিনায়ক অপরাজিত থাকেন ৪২ বলে ৬১ রান করে।
যুব ওয়ানডে অভিষেকে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান হয়ে এই আসর শুরু করেছিলেন আজিজুল। পরের ম্যাচে বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান করেন অপরাজিত ফিফটি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ব্যর্থ হলেও এই ম্যাচে জ্বলে উঠলেন আবার। টুর্নামেন্টের চার ম্যাচে তার রান ২২৪, গড় ১১২।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশকে স্বপ্নের মতো শুরু এনে দেন মারুফ মৃধা। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন দুই ওপেনার উসমান খান ও শাহজাইব খান। বিশেষ করে শাহজাইব ছিলেন অসাধারণ ফর্মে। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১০ ছক্কায় ১৫৯ রান করার পর দ্বিতীয় ম্যাচে তিনি করেন ১৩২, পরের ম্যাচ ৪৫। কিন্তু দুই ওপেনারকেই শুন্য রানে বিদায় করেন মারুফ।
সকালের উইকেটে আর্দ্রতা ছিল কিছু। তা কাজে লাগিয়ে সিম মুভমেন্ট আদায় করে নেন মারুফ। বাঁহাতি এই পেসার ম্যাচের প্রথম ওভারে ফেরান উসমানকে, তৃতীয় ওভারে শাহজাইবকে।
তৃতীয় উইকেটে দলকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন মোহাম্মদ রিয়াজউল্লাহ ও সাদ বেগ। বাংলাদেশের পেসারদের সামনে যদিও রানের গতি তাদের ভালো ছিল না একটুও, তবে উইকেট আগলে রেখে প্রতিরোধ গড়েন দুজনই। এই জুটি ভেঙেই দৃশ্যপটে নিজেকে তুলে ধরেন ইমন।
পাকিস্তান অধিনায়ক সাদকে (৪১ বলে ১৮) ফিরিয়ে ৪২ রানের জুটি থামান ইমন। ক্যাচ নিয়ে এখানেও ছিলেন মারুফ মৃধা।
নতুন ব্যাটসম্যান নাভিদ আহমেদ খানকে ২ রানে রান আউট করে দেন কালাম সিদ্দিকি। লম্বা সময় এক প্রান্ত আগলে রাখা রিয়াজউল্লাহর (৬৫ বলে ২৮) প্রতিরোধ ভেঙে দেন ইমন।
নতুন বলে নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেও উইকেট না পাওয়া আল ফাহাদ দ্বিতীয় স্পেলে ফিরেই বিদায় করেন হারুন আরশাদকে।
৭৯ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা দলকে একশ পার করান ফারহান ইউসুফ। তিন ছক্কায় ৩২ বলে ৩২ রান করেন তিনি। তাকে বিদায় করার পর পাকিস্তান ইনিংসের লেজ দ্রুত ছেটে দেয় বাংলাদেশ।
তিন রানে পাকিস্তান হারায় শেষ চার উইকেট। এর দুটি নিয়ে চার উইকেট পূর্ণ করেন ইমন।
রান তাড়ায় শুরুতে বাংলাদেশের দুই ওপেনার ছিলেন একটু নড়বড়ে। পাকিস্তানের দুই পেসারের চমৎকার বোলিংয়ে পাঁচ ওভারে কেবল চার রান তোলেন জাওয়াদ আবরার ও কালাম সিদ্দিকি।
পরের ওভারে উমার জাইবকে চারটি চার মেরে জেগে ওঠার আভাস দেন জাওয়াদ। তবে বেশিদূর যেতে পারেননি তিনি। ১৭ রানেই শেষ হয় তার ইনিংস। কালাম তো আগেই ফেরেন ১৪ বলে কোনো রান না করেই।
ছোট পুঁজি নিয়েও তখন ম্যাচ জমিয়ে তোলার আভাস দিচ্ছিল পাকিস্তান। কিন্তু আজিজুল হাকিমের মনে ছিল অন্য ভাবনা। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই বাউন্ডারিতে শুরু করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। এরপর আব্দুল সুবহানকে মারেন টানা তিনটি চার।
এরপর স্রেফ এগিয়ে যাওয়ার পালা। তাকে সঙ্গ দেন মোহাম্মদ শিহাব জেমস।
পাকিস্তানিরা এক পর্যায়ে তাদেরকে স্লেজিং করেন প্রচুর। তাদের মনোযোগ নাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আজিজুল জবাব দেন ব্যাট হাতে দুর্দান্ত সব শট খেলে। বাদ রাখেননি শরীরী ভাষা দিয়ে জবাব দিতেও।
শিহাব (২৬) শেষ পর্যন্ত থাকতে পারেননি। তবে আজিজুল হার মানেননি।
নাভিদের বলে বাউন্ডারিতে দলকে জিতিয়ে হুঙ্কার ছোড়েন বাংলাদেশ অধিনায়ক। উদযাপনে তার সঙ্গী হন দলের অন্যরাও। পরে মাঠ প্রদক্ষিণ করে গ্যালারিতে থাকা বাংলাদেশি সমর্থকদের প্রতি ভালোবাসা জানান তারা।
একই দিনে আরেক সেমি-ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে ৭ উইকেটে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে ভারত। পেসার চেতান শার্মা নেন তিন উইকেট। ৩৬ বলে ৬৭ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ-সেরা হন কদিন আগে আইপিএলে কোটি টাকায় দল পাওয়া ১৩ বছর বয়সী ওপেনার বৈভাব সুরিয়াভানশি।
পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯: ৩৭ ওভারে ১১৬ (উসমান ০, শাহজাইব ০, রিয়াজউল্লাহ ২৮, সাদ ১৮, নাভিদ ২, হারুন ১০, ফারহান ৩২, ফাহাম ৮*, উমার ১, সুবহান ০, রাজা ০; মারুফ ৬-০-২৩-২, ফাহাদ ৮-০-২৩-১, রিয়াজ ৮-২-১৩-০, ইমন ৭-১-২৪-৪, সামিউন ৫-০-১৫-০, আজিজুল ১-০-১১-০, দেবাশিস ২-১-৭-১)
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯: ২২.১ ওভারে ১২০/৩ (জাওয়াদ ১৭, কালাম ০, আজিজুল ৬১*, শিহাব ২৬, রিজান ৫*; রাজা ৯-৩-৪০-১, উমার ৫-১-৩৬-০, সুবহান ৫-০-২৭-১, নাভিদ ৩.১-০-১৩-১)
ফল: বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল ৭ উইকেটে জয়ী
ম্যান ব দা ম্যাচ: ইকবাল হোসেন ইমন