তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য মুশফিকুর রহিমকে উজ্জ্বল উদাহরণ বললেন তার প্রথম অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, ক্যারিয়ার শেষে তরুণদের নিয়ে মুশফিকের কাজ করা উচিত বলে মনে করেন সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ।
Published : 06 Mar 2025, 03:18 PM
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দলগত ব্যর্থতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও নিষ্প্রভ ছিলেন মুশফিকুর রহিম। দুই ম্যাচ মিলেও তিনি ৫ রান করতে পারেননি। আউট হওয়ার ধরন নিয়েও সমালোচনা হয়েছে ঢের। এসব আলোচনার মাঝেই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিয়েছেন অভিজ্ঞ কিপার-ব্যাটসম্যান।
ওয়ানডে থেকে অবসর নেওয়ায় জাতীয় দলে সাদা বলের ক্রিকেটে শেষ হয়ে গেল মুশফিকের অধ্যায়। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে বিদায় বেলায় তাকে প্রশংসায় ভাসালেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার প্রথম অধিনায়ক হাবিবুল বাশার ও সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ। সামাজিক মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে সামনের দিনগুলোর জন্য শুভকামনা জানালেন হান্নান সরকার।
হাবিবুল বাশার
দলকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে ‘অলরাউন্ডার’ মুশফিক
“মুশফিকের শুরুর দিনগুলো দিয়ে যদি শুরু করি। অভিষেকের আগে ঘরোয়া ক্রিকেটে ওকে তেমন দেখা হয়নি। জাতীয় দলে আসার পরেই খুব কাছ থেকে দেখা। মুশফিক আসার পরই সবাই একটা জিনিস আলোচনা করত, এই ছেলেটা টেকনিক্যালি খুব ভালো। ছোটখাটো গড়ন কিন্তু ওই সময় থেকেই বড় বড় ছক্কা মারত। ওর যে প্রিয় শট স্লগ সুইপ, তখন থেকেই খুব ভালো খেলত। ব্যাটিংয়ের টেকনিক খুব ভালো, এই কারণেই ওকে ২০০৫ সালের ইংল্যান্ড সফরে নেওয়া হয়। সেখানেও ওর টেকনিক নিয়ে সবাই খুব আলোচনা করেছে।”
“২০০৭ সালের বিশ্বকাপে যখন ওকে নেওয়া হলো, তখন কিন্তু (খালেদ মাসুদ) পাইলটকে ঘিরে অনেক আলোচনা। কারণ পাইলট তখন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। তবে মুশফিককে নেওয়ার বড় কারণ ছিল, উইকেটকিপারের সঙ্গে একজন টপ-অর্ডার ব্যাটসম্যানও পাওয়া যেত। এটা দলের জন্য অনেক সুবিধা। অনেকটা অলরাউন্ডার নেওয়ার মতো। যে কারণে একজন বাড়তি ব্যাটসম্যান বা বোলার নেওয়া যায়। মুশফিক থাকায় বাংলাদেশ দল সবসময় পেয়েছে।”
তরুণ প্রজন্মের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
“মুশফিকুর রহিমের আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, যত দিন গিয়েছে খেলার প্রতি ওর আগ্রহ, নিবেদন আরও বেড়েছে। শুরু থেকেই ছিল। যত দিন গেছে সেটা পরের ধাপে নিয়ে গেছে। আমাদের তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য খুব ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে।”
“বলতে দ্বিধা নেই, আমরা যখন শুরু করেছি, আমাদের সামনে খুব বড় উদাহরণ ছিল না। সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলা দেখে আমরা বড় হইনি। বড় হয়ে তারপর ওই পর্যায়ে খেলেছি। তবে এখনকার ছেলেদের সামনে মুশফিকুর রহিম একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। তাকে অনুসরণ করলে শুধু ব্যক্তিগতভাবে নয়, বাংলাদেশ ক্রিকেটও অনেক লাভবান হবে। তরুণ ক্রিকেটারদের উচিত মুশফিককে অনুসরণ করা। তার ওয়ার্ক এথিকস, নিবেদন, খেলার প্রতি ভালোবাসা অসাধারণ।”
শততম টেস্ট ছুঁয়ে আরও এগিয়ে যাক
“এখনও তো সে খেলছে। সব সংস্করণ থেকে অবসর নেয়নি। টেস্ট দলে এখনও সে আছে। তবে পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ অবশ্যই তাকে মিস করবে। কারণ সেও একজন অলরাউন্ডারের মতো।”
“আমার মনে হয় না, শুধু একশ টেস্ট নিয়ে চিন্তা করছে মুশফিক। খেলাটা উপভোগ করছে বলেই সে টেস্ট খেলছে। একশ টেস্ট অবশ্যই একটা মাইলফলক হবে। তবে সে শুধু এটার জন্য বসে নেই। আমার মনে হয় সে এখনও খেলাটা উপভোগ করছে। টেস্ট ক্রিকেটে তাকে এখনও দরকার। আমি চাইব আরও বেশি দিন সে টেস্ট খেলুক।”
খালেদ মাসুদ
মুশফিকের সুন্দর গোছানো ক্যারিয়ার
“মুশফিকুর রহিমের ক্যারিয়ার অসম্ভব সুন্দর। উঠে আসা থেকে শুরু করে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশকে দলকে সার্ভিস দেওয়া- সব কিছু মিলিয়ে সুন্দর গোছানো একজন ক্রিকেটার। অনেক পরিশ্রমী। আইকনিক একজন ক্রিকেটার। তার কাছ থেকে তরুণ প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। সত্যিকারের ক্রিকেটার হতে হলে মুশফিকুর রহিম একজন উদাহরণ। তার শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, সবার আগে মাঠে চলে যাওয়া, অনুশীলনে বাড়তি সময় কাটানো- সব কিছু মিলিয়ে অসাধারণ।”
“আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বিবেচনায় তার শারীরিক গড়ন যদি দেখেন, এর মধ্যেই সে কিন্তু বাকিদের সঙ্গে লড়াই করেছে, অনেককে টক্কর দিয়েছে। নিজের মেধা ব্যবহার করে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে একদম ভালো পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জন্য এটাই সর্বোচ্চ পর্যায়, সে যেখানে খেলেছে।”
“মুশফিক যতটা কঠোর পরিশ্রম করেছে, সে যদি আরও উঁচু দল যেমন অস্ট্রেলিয়া বা ভারতে খেলত, আমার বিশ্বাস ক্রিকেটার হিসেবে আরও ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভালো হতো তার পারফরম্যান্স। কারণ সেসব দেশে ঘরোয়া ক্রিকেটের মানও অনেক উঁচুতে। তবু সব মিলিয়ে আমি মনে করি, খুব সুন্দর ক্যারিয়ার মুশফিকের।”
“(জাতীয় দলে মুশফিকের কাছে জায়গা হারানোয়) আমার কখনও খারাপ লাগেনি। দল নির্বাচনের অংশ এসব। ক্রিকেটার হিসেবে আমাদের কাজ মাঠে পারফর্ম করা। নির্বাচকদের কাজ দল বাছাই করা। আমার জায়গায় মুশফিক এসেছে। লম্বা সময় দলে খেলেছে। এটা আমার নিজের কাছে খুবই ভালো লাগে।
ভবিষ্যতের মুশফিক তৈরির দায়িত্ব
“এখন শুধু ওয়ানডে থেকে বিদায় নিয়েছে। টেস্ট খেলে যাবে। আমি মনে করি, এখনও বাংলাদেশ দলকে অনেক কিছু দেওয়ার আছে তার। এখন হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেটার হিসেবে ক্যারিয়ার শেষ করল।”
“তবে আমি মনে করি, অনেক ক্রিকেটার সে তৈরি করবে। সেই দোয়াই আমি করি। সবাই প্রত্যাশা করে, তাদের মতো ক্রিকেটার যেন অবসরের পরও ক্রিকেটের কাছেই থাকে। মুশফিক এতদিন একজন ক্রিকেটার হিসেবে খেলেছে। এখন থেকে দেশের ক্রিকেটের কথা চিন্তা করে যেন ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্রিকেটার তৈরি করতে পারে, মুশফিকুর রহিমের চেয়েও ভালো কাউকে তৈরি করতে পারে।”
মাঠ থেকে অবসর নেওয়ার সংস্কৃতি শুরুর আশা
“মুশফিকুর রহিমের কিন্তু মাঠ থেকে অবসর নেওয়া হলো না। আমারও ঠিক মাঠ থেকে অবসর হয়নি। সাকিবের হলো না। মাশরাফির হয়নি, তামিমেরও হয়নি। মাহমুদউল্লাহ জানি না, কবে হবে বা হবে কি না। অনেক ক্রিকেটারের মাঠ থেকে অবসর হয়নি।”
“আমি মনে করি, অবসরের বিষয়টা মাঠ থেকেই করা সম্ভব। সবার জন্যই। যদি এক-দুই বছর আগেই মুশফিকের সঙ্গে নির্বাচকরা আলোচনা করতেন, তাহলে দুই পক্ষের ভাবনাই পরিষ্কার জানা যেত। দীর্ঘ দিন বাংলাদেশ দলকে সার্ভিস দেওয়ার পর যে কোনো ক্রিকেটারের এই সম্মান প্রাপ্য।”
“নির্বাচকের সঙ্গে, বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারের বোঝাপড়ার বিষয়। স্টিভেন স্মিথের বিষয়টাই যেমন। সে নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। ভালো ফর্মে ছিল। তাও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অবসর নিয়েছে।”
“আমাদের ক্রিকেটাররা কেন রাগ বা অভিমান করে চলে যাবে। কেন মাঠ থেকে হবে না! আমি আশা করব, আমাদের ম্যানেজমেন্ট এটা দায়িত্ব নিয়ে দূরত্বটা ঘোচাবে এবং দুই পক্ষই নিজেদের পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখবে। তাহলেই সুন্দরভাবে অবসরের বিষয়গুলো করা সম্ভব।”
হান্নান সরকার
টেস্টে দুর্দান্ত কিছু ইনিংস দেখার আশা
“খেলাটার প্রতি তুমি কতটা সৎ ছিলে আর ঠিক কী পরিমাণ নিবেদনের সঙ্গে খেলে গেছো বছরের পর বছর ধরে, তা খুব কাছ থেকেই দেখা। শেষটা হয়তো সেরাভাবে হলো না, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে তোমার অবদান কোনোদিন অস্বীকার করা সম্ভব না, কখনও না। তোমার আগামী দিনগুলো খুব সুন্দর হোক, মুশফিক। টেস্টে দুর্দান্ত কিছু ইনিংস দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।”