জিম্বাবুয়ের কাছে হারায় ‘অতিরিক্ত আপসেট’ নন বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, অথচ এমন পরাজয়ে তাদের হৃদয়ে চোট লাগার কথা, অহমে আঘাত পাওয়ার কথা।
Published : 24 Apr 2025, 07:30 PM
২০০৪ সালে বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের ঘটনা। সিরিজের প্রথম টেস্টে সেন্ট লুসিয়ায় অভাবনীয়ভাবে ড্র করে ফেলল বাংলাদেশ। জ্যামাইকায় পরের টেস্ট শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে ক্যারিবিয়ান আধিনায়ক ব্রায়ান লারা ঘোষণা দিলেন, এই টেস্ট জিততে না পারলে নেতৃত্ব ছেড়ে দেবেন। তার পরিষ্কার কথা, “জ্যামাইকায় পাঁচ দিন খেলে যদি বাংলাদেশকে হারাতে না পারি, তাহলে আমাদের অন্য অধিনায়ক প্রয়োজন।”
প্রায় ২৫ বছর পর চলে আসা যাক। জিম্বাবুয়ের কাছে সিলেট টেস্টে হারার পর বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বললেন, “অতিরিক্ত আপসেট, এটা আসলে বলব না। কারণ এটাও একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল। ভালো করিনি, এই কারণে আপসেট।” পরে আরেক দফায় তিনি বললেন, “এই ম্যাচ হেরে অনেক বেশি খারাপ লাগছে, জিনিসটা এরকম নয়। নরম্যালি ম্যাচ হারলে যেমন খারাপ লাগে, আজকেও অমনই লাগছে।”
শান্ত অবশ্যই লারা নন। কোনো তুলনাই চলে না। তবে লারার মতো শান্তও এমন একটা দলের অধিনায়ক, যে দলটি বিব্রতকর এক পরাজয়ের তেতো স্বাদ পেয়েছে। এমন এক দলের কাছে তারা হেরেছে, যাদের সঙ্গে দাপুটে জয় ছাড়া অন্য কোনো ফলাফলই অপ্রত্যাশিত। যে হারটি স্রেফ শুধু হার নয়, বরং একটি বিপর্যয়।
সেই উপলব্ধি লারার ছিল। বাংলাদেশর সঙ্গে জিততে না পেরে তার অহমে চোট লেগেছিল। গৌরবময় একটি ক্রিকেট জাতির অধিনায়কের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল।
শান্তর মনের পরিবেশ তো আর জানার উপায় নেই। তবে তার কণ্ঠের যা প্রকাশ, তাতে বাংলাদেশ অধিনায়কের হৃদয়ের ক্ষত ততটা গভীর নয়।
অবশ্য তিনি বলতেই পারেন, জিম্বাবুয়ের কাছে তো ২০১৮ সালেই সিলেটে টেস্ট হেরেছে বাংলাদেশ!
হেরেছে বটে। তবে সেই জিম্বাবুয়ে দলে ছিলেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, ব্রেন্ডান টেইলর, সিকান্দার রাজা, কাইল জার্ভিসরা। এবারের দলের অভিজ্ঞ তারকা শন উইলিয়ামস ছিলেন সেবারও। দলটা তুলনামূলকভাবে এবারের চেয়ে পোক্ত ছিল অনেক।
এবার সিলেট টেস্ট শুরুর সময় জিম্বাবুয়ের গোটা একাদশের অভিজ্ঞতা ছিল ৮১ ম্যাচের। বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিমের একার অভিজ্ঞতা তখন ৯৪ টেস্টের।
২০১৮ সালের নভেম্বরে ওই টেস্টের পর পেরিয়ে গেছে সাড়ে ছয় বছর। এই সময়ে (সিলেট টেস্টের আগ পর্যন্ত) বাংলাদেশ খেলেছে ৪১ টেস্ট, জিম্বাবুয়ে খেলেছে ১৫টি।
সবশেষ ১০ টেস্টে জিম্বাবুয়ের জয় নেই। এর মধ্যে দুটি স্রেফ ড্র করতে পেরেছিল তারা, বাকি আটটিতেই ছিল হার। কিছুদিন আগে দেশের মাঠে তারা হেরেছে আফগানিস্তান, আয়ারল্যান্ডের কাছেও।
এমন একটি দলের কাছে হারলে কেন তা হৃদয়ে হাহাকার জাগাবে না!
অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারতের মতো দলের সঙ্গে জিতলে যদি তা হয় উত্তুঙ্গ উচ্ছ্বাসের উপলক্ষ, জিম্বাবুয়ের কাছে হারলে তাহলে দহন কেন তীব্র হবে না!
আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ নয় জিম্বাবুয়ে। আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে তারা পড়ে আছে তলানিতে। এমন দলের কাছে পরাজয় কেন গৌরবে আঘাত করবে না? কেন অধিনায়কের কাছে ‘অনেক বেশি’ খারাপ লাগছে না!
গত বছর দেশের মাঠে শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশড হয়েছে বাংলাদেশ। অথচ দুটি সিরিজেই জয় ছিল প্রত্যাশিত। বিশেষ করে, দক্ষিণ আফ্রিকার খর্বশক্তির ও এই কন্ডিশনে আনকোরা দলের কাছে দুই টেস্টেই হেরে যাওয়া ছিল চরম হতাশাজনক। কিন্তু এবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই পরাজয়ে দেশের ক্রিকেট নেমে গেছে নতুন তলানিতে।
অধিনায়কের কেন এটিকে স্রেফ আরেকটি ‘সাধারণ’ পরাজয় মনে হবে?
প্রথম টেস্টে হারার পর এই সিরিজে পরের টেস্টে স্রেফ জিতলেও তা আসলে বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট নয়। এই হারকে তো কোনোভাবেই পুষিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। তবে পরের টেস্টে প্রবল দাপটে জিতলে, জিম্বাবুয়েকে গুঁড়িয়ে দিতে পারলে, মানসিক ক্ষতে একটু প্রলেপ হয়তো দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু সেই তাড়নার ছাপ বা তেতে থাকার প্রকাশ তো অধিনায়কের কথায় নেই!
ব্রায়ান লারার সেই ঘোষণার পর বাংলাদেশকে ইনিংস ব্যবধানে হারিয়ে সিরিজ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। লারার মতো পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া শান্তর জন্য জরুরি নয়। কিন্তু দলকে উজ্জীবিত করার কোনো উপকরণ তো থাকতে হবে! জিম্বাবুয়ের কাছে এমন পরাজয়ে দেশের ক্রিকেটে গৌরবে কালির ছোপ যে লাগে, সমর্থকদের মনেও কষ্টের আঁচড় লাগে, সেই উপলব্ধি তো অধিনায়ক ও দলের থাকতে হবে!