চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে এবার এ আয়োজন পা রাখবে ১১৬ বছরে।
Published : 24 Apr 2025, 10:19 PM
ঐতিহ্যের ছায়ায়, বীরত্ব আর প্রাণচঞ্চল উৎসবের মেলবন্ধনে—চট্টগ্রামের লালদীঘির মাঠে প্রতি বৈশাখে এক অনন্য সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটে। শতাধিক বছরের পুরনো এই বলী খেলা শুধু একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নয়, এটি একটি জনসংস্কৃতির বহ্নিশিখা, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে ইতিহাসের ঋদ্ধ বার্তা। আবদুল জব্বার সওদাগরের হাতে ১৯০৯ সালে শুরু হওয়া এই বলী খেলা ব্রিটিশবিরোধী চেতনার ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছিল, যেখানে কুস্তির আড়ালে লুকিয়ে ছিল আত্মপ্রতিরোধের আহ্বান।
গবেষক আবদুল হক চৌধুরী তার ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন—‘চট্টগ্রাম বলীর দেশ।‘ তিনি উল্লেখ করেন, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের উনিশটি গ্রামে একসময় বাস করতেন ‘মল্ল’ উপাধিধারী শক্তিশালী এক জনগোষ্ঠী। শরীরচর্চা ও বলী খেলার ঐতিহ্যই ছিল যাদের বংশানুক্রমিক পেশা। এরাই ছিলেন চট্টগ্রামের বলী খেলার প্রাণ। মল্লরা শুধু কুস্তিগির নন, তারা ছিলেন সাহস ও শারীরিক শৌর্যের প্রতীক।
চট্টগ্রামের অন্তত ২২টি মল্ল পরিবারের নাম ইতিহাসে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন— আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল,
মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল ও গৈরলার চুয়ান মল্ল।
চট্টগ্রামের বলী খেলাকে ঘিরে যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল, তার অনুসন্ধানে চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী লিখেছেন, “এক সময় চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি বড় গ্রামেই ২ থেকে ৪টি করে বলী খেলার আয়োজন হতো। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কাল থেকে এই ঐতিহ্যে ছন্দপতন ঘটতে থাকে; বলী খেলার সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পায়।” তিনি আরও জানান, উত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে বলী খেলার ছিল ব্যাপক খ্যাতি। বিশেষত: মহারাজ্যা বাপের বলী খেলা, ফতেপুরের বলী খেলা, হাটহাজারীর বলী খেলা, নদীমপুরের বলী খেলা, মাদার্শার বলী খেলা ও ফটিকছড়ি-রাউজান অঞ্চলের বলী খেলা।
এতে অংশ নিয়েছিলেন অসংখ্য বলিষ্ঠ ও খ্যাতনামা বলী, যাদের নাম আজও কিংবদন্তির মতো উচ্চারিত হয়: লাল মিয়া বলী, দুইধ্যা বলী, এয়াকুব আলী বলী, সুলতান বলী, ওয়ালী বলী, জাফর আলী বলী, আছু বলী ও টুইখ্যা বলী। মধ্য চট্টগ্রামের বলী খেলাগুলোও ছিল সমানভাবে জনপ্রিয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য: পটিয়ার বলী খেলা ও তুফান আলী মুন্সীর বলী খেলা। এই অঞ্চলের বলীদের মধ্যেও বহু নাম অমর হয়ে আছে ক্রীড়া-ইতিহাসে: গইন্যা বলী, মিরা বলী, আসাদ আলী বলী, আহমদ ছফা বলী ও কুমীরে খাওয়া বলী।
১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল (১২ বৈশাখ ১৩১৬ বঙ্গাব্দ) চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার আবদুল জব্বার সওদাগর প্রথমবারের মতো এই বলী খেলার আয়োজন করেন লালদীঘি ময়দানে। কালের পরিক্রমায় এটি শুধু জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি, বরং ‘জব্বারের বলী খেলা’ নামেই চিহ্নিত হয়েছে।
‘বলী খেলা’ শব্দটি অনেক সময়ই ‘কুস্তি খেলা’র সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও, বাস্তবে রয়েছে সূক্ষ্ম ও তাৎপর্যময় ভিন্নতা। বলী খেলা শুধু দেহশক্তির প্রদর্শন নয়, এটি চট্টগ্রামের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার তার ‘বাংলাদেশের খেলাধুলা’ বইয়ে এটিকে সরলীকরণ করে ‘কুস্তি’ বলেননি। তিনি লিখেছেন, “জব্বারের বলীখেলা এক বিশেষ ধরনের কুস্তি খেলা, যা চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে প্রতিবছরের ১২ বৈশাখে অনুষ্ঠিত হয়।”
জব্বারের বলী খেলা পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক মহত্তম আয়োজন হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত। এটি সময়ের সঙ্গে হয়ে উঠেছে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অনুষঙ্গ। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে গণমানস তৈরি ও সংগঠনের ক্ষেত্রেও এই বলী খেলার গুরুত্ব ছিল অনস্বীকার্য। চলতি বছর এই বলী খেলার আয়োজন পা রাখবে ১১৬ বছরে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংকটময় সময় এবং সাম্প্রতিক অতিমারী—এই দুই সময় ব্যতীত, গত এক শতাব্দীজুড়ে একটিবারের জন্যও এর ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েনি।
প্রতি বছর ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে বসে এই বলী খেলার ঐতিহাসিক আসর। কোনো আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র প্রয়োজন হয় না। খেলোয়াড়, বিক্রেতা, ক্রেতা ও দর্শক—সবাই যেন এক অলিখিত ঐতিহ্যের আহ্বানে সময়মতো এসে উপস্থিত হন। লালদিঘীর মাঠের আশপাশ দিয়ে চলাচলকারী মাত্রেই খেয়াল করবেন, চৈত্রের শেষ আর বৈশাখের শুরুতেই ওই এলাকার দেওয়ালে, মেঝেতে চিহ্ন এঁকে, নাম লিখে রাখছে। এরা আর কেউ নন, এরা আবদুল জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষ্যে বৈশাখী মেলার দোকানি। বৈশাখের ১২ তারিখ এসে তারা যে যার স্থানে পসরা সাজাবে। এজন্য তেমন কোনো বিচার শালিসও লাগে না। বিগত শত বছর ধরে এভাবেই চলছে। মেলায় এমন কিছু জিনিসপত্র পাওয়া যায়, যা কিনা অন্য কোনো মেলায় পাওয়া যায় না। চট্টগ্রামবাসী এসব জিনিস কিনতে সারা বছর ধরে এই সময়টার জন্য অপেক্ষায় থাকে।
খেলাধুলার মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুব সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে চট্টগ্রামের বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার এই খেলার সূচনা করেছিলেন। ব্যতিক্রম এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে দিতে চাইলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সংস্কৃতি শুধু বিনোদনের জন্য অংশ নয়, লড়াই-সংগ্রামেরও অংশ, একথা সচেতন মানুষ মাত্রেই জেনে আসছেন। কিন্তু সংস্কৃতির পাশাপাশি ক্রীড়াও যে লড়াই-সংগ্রামের অংশ, তা ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার বাঙালির বোধের মধ্যে নিয়ে আসেন। তারই প্রকাশ আমরা আবার খুঁজে পাই, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের মাধ্যমে।
চট্টগ্রামে বলী খেলার সূচনা নিয়ে দুটি পৃথক তত্ত্ব পেশ করা হয়েছে। কবি আলাদিন আলীনুরের বর্ণিত ঐতিহাসিক বিবরণটি আকর্ষণীয়, যেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, প্রতি বছর চৈত্রের শেষার্ধ ও বৈশাখের প্রথমার্ধে বলী খেলার মৌসুম শুরু হতো। এই সময়ে বসত মেলা, নতুন পণ্যের আমদানি ও ব্যাপক বেচাকেনা হত, আর চারদিকে শোনা যেত বাদ্যধ্বনি ও সানাইয়ের আওয়াজ। আলীনুর দাবি করেন, “১৩৪৫-৪৬ সালে ইবনে বতুতার পরিদর্শনের সময়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বরহনক থেকে বলীরা খেলায় যোগ দিতে আসায় দর্শকদের উত্তেজনা বাড়ে। কবি কালিদাসের জন্মভূমি মালিয়ারা ও কবি আফজল আলীর জন্মভূমি মিলুয়া অঞ্চল থেকে বলী খেলার উদ্ভব হয় এবং তা চট্টগ্রামজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।”
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম গবেষক আবদুল হক চৌধুরী আলীনুরের বর্ণিত ইতিহাসের সাথে ভিন্নমত পেশ করেন। তিনি বলেন, “যদি মালিয়ারা ও মিলুয়া অঞ্চলকে মল্ল ক্রীড়ার জন্মস্থান হিসেবে ধরা হয়, তবে রাউজান থানার ডাবুয়া ইউনিয়নের মেলুয়া গ্রামেও বলী খেলার উদ্ভব ঘটতে পারে। তবে চট্টগ্রামের চতুর্দিকে বলী খেলার উৎপত্তি নিয়ে বিরোধের পরিবর্তে একত্রিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা উচিত।”
মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকেও বলীরা এ খেলায় অংশ নিতে আসতেন। এছাড়া সিলেট অঞ্চলেও বলী খেলার প্রচলন ছিল, যা ‘মাল খেলা’ নামে পরিচিত ছিল। এ বিষয়ে আবদুল হক চৌধুরী লিখেন, “সিলেটে মাল খেলা শরৎ ও হেমন্তকালে অনুষ্ঠিত হত।” তবে ‘মাল খেলা’ আসলে ছিল সিলেট অঞ্চলের শক্তি প্রদর্শনের খেলা, যার প্রকৃতি বলী খেলার কাছাকাছি। তবে এর পোশাক, নিয়মকানুন, আয়োজন ও প্রেক্ষাপট বলী খেলার চেয়ে ভিন্ন।
জব্বারের বলী খেলা ধারাবাহিকতার দিক থেকে অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহাসিক খেলা হিসেবে পরিচিত। চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্থানে, যেমন চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, আনোয়ারা, রাউজান, হাটহাজারী, চান্দগাঁও ও কক্সবাজারে আজও বলী খেলার আয়োজন হয়, যা এ খেলার জীবন্ত ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত। আজ বলী খেলা আজ বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি একদিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরম্পরার ধারক, অন্যদিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের ঐতিহাসিক আয়োজন।