রান কত, সেটি খুব বেশি মুখ্য নয়। এনামুল হকের রান পাওয়া মানেই দুটি প্রশ্ন অবধারিত। স্ট্রাইক রেট কত? ডট বল খেলেছে কয়টি? গত বছর দেড়েক ধরেই এই প্রশ্ন দুটি এনামুলের নিত্য সঙ্গী। সেটি যৌক্তিক কারণেই।
Published : 02 May 2016, 07:53 PM
আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে ২৭ ইনিংসে ৩টি শতক, ৩টি অর্ধশতক। বাংলাদেশের একজন ব্যাটসম্যানের জন্য ক্যারিয়ারের শুরুতে এমন রেকর্ড দারুণ বললেও কম বলা হয়। কিন্তু প্রাসঙ্গিক তথ্য হিসেবেই চলে আসে, স্ট্রাইক রেট ৭০। প্রতিটি বড় ইনিংসেই ডট বলের দীর্ঘ মালা। দারুণ প্রতিভাবান, রেকর্ডও ভালো হওয়ার পরও এনামুল জাতীয় দলে জায়গা হারিয়েছেন মূলত অতিরিক্ত ডট বল খেলার প্রবণতার কারণেই।
নিজের ভেতরের ভাবনা যেটাই থাকুক, প্রকাশ্যে এই সত্যটি মানতে এক সময় আপত্তি ছিল এনামুলের। তবে বছরখানেক জাতীয় দলের বাইরে থাকার পর অবশেষে স্বীকার করছেন নিজের ঘাটতিটুকু। সোমবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের হয়ে ঝড়ো শতকের পর জানালেন, বুঝতে পেরেছেন ভুলটুকু। চেষ্টা করছেন শোধরাতে।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ওয়ানডেতেই শতক করেছিলেন এনামুল। সেই ইনিংসে ডট বল ছিল ৮০টি। পরে আরও দুটি শতক করেছেন, ডট বল ৭৩ ও ৭৪টি। তিনটি অর্ধশতকের ইনিংসেও ডট বল ৫৮টি, ৫৬টি ও ৬৮টি; এই যুগের ক্রিকেটে যা যথেষ্টই বেমানান।
বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের মতে, ডট বলের চেয়েও এনামুলকে নিয়ে বেশি সমস্যা ছিল সিঙ্গেল নেওয়ার আগ্রহটাই না দেখানো। উইকেট বাঁচিয়ে অতি সাবধানী ও নিরাপদ পথে হাঁটা। টিম ম্যানেজমেন্টের অনেকের কাছে যেটি ছিল ‘স্বার্থপর’ ব্যাটিং।
২০১৫ বিশ্বকাপে দল অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে এনামুলকে বারবার বলেছেন দলের স্বার্থে খেলতে। তরুণ এই ব্যাটসম্যান কোচকে কথাও দিয়েছেন। কিন্তু ২২ গজে দেখা গেছে উল্টো চিত্র। বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে করেছিলেন ৫৫ বলে ২৯, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৩ বলে ২৯। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ফিল্ডিংয়ে চোট পেয়ে শেষ হয়ে গেল বিশ্বকাপ। ততদিনে নাম কাটা গেছে কোচের ‘গুড বুক’ থেকেও। তাই আর ফেরা হয়নি দলে।
ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে এনামুল স্বীকার করলেন অতীতের ভুল। দাবি করলেন, জাতীয় দলের কোচিং স্টাফরা তার ভুলের কথা বললেও কখনোই বাতলে দেননি শোধরানোর উপায়।
“আমার ভুল ছিল। সেটা আমাকে বলাও হয়েছিল। কিন্তু ধরিয়ে দেওয়া হয়নি যে কি করলে ভুল শোধরানো সম্ভব।”
জাতীয় দল থেকে ছিটকে পড়া এনামুল ক্যারিয়ারের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পাশে পেয়েছেন সম্ভাব্য সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষটিকেই। এবার গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিন ঘরোয়া ক্রিকেটে দারুণ শ্রদ্ধেয় ও সবচেয়ে কার্যকর কোচদের একজন।
এনামুল জানালেন, ক্লাব কোচের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন নিজের ভুল শোধরাতে।
“চেষ্টা করছি উন্নতি করতে। প্রতিদিনই সালাউদ্দিন স্যার, জিকো ভাই (সহকারী কোচ), তাদের সঙ্গে কথা বলছি, কাজ করছি। সকাল-সন্ধ্যা কাজ করছি নিজের ভুলটা শোধরাতে।”
সোমবার ঝড়ো শতক করলেও অবশ্য প্রশ্নগুলি এখনই ছেড়ে যাচ্ছে না এনামুলকে। এবারের লিগে আগের দুই ম্যাচেও যে দেখা গেছে পুরোনো এনামুলকেই! প্রথম ম্যাচে ৬৭ রান করতে বল খেলেছিলেন ১০১টি, ডট বলই ছিল ৬৫টি। পরের ম্যাচে ৪২ করেছিলেন মাত্র ৬৩.৬৩ স্ট্রাইকরেটে।
এনামুল অবশ্য এটিকে বলতে চাইলেন দীর্ঘদিন পর এই সংস্করণে খেলার অস্বস্তি।
“সত্যি বলতে, দীর্ঘদিন পর আমি ওয়ানডে ফরম্যাটে খেলছি। বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের পর এই ফরম্যাটে আর খেলা হয়নি (গত সেপ্টেম্বরে ‘এ’ দলের ভারত সফরে তিনটি ম্যাচ খেলে করেছিলেন ০, ৩৪ ও ১)। অনেক দিন পর খেললে একটু চাপ থাকেই। এক বছরে কতটুকু উন্নতি করতে পারলাম, না পারলাম, এই ভাবনা থাকে মাথায়।”
“প্রিমিয়ার লিগে আমারও মনে হয়েছে প্রথম ম্যাচটায় আরও ভালো করা উচিত ছিল। তবে চেষ্টা করছি। আশা করি, সামনে ভালো হবে।”
সোমবার এনামুল যখন অর্ধশতক করলেন, কাছাকাছি গেলেন এবং ছুঁলেন তিন অঙ্ক, প্রতিবারই গ্যালারি থেকে তালি দিয়ে, চিৎকার করে তাকে উৎসাহ জানিয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। জাতীয় দলের অধিনায়কের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে দারুণ অনুপ্রাণিত এনামুল।
“মাশরাফি ভাই সবসময়ই দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী। বাংলাদেশ দলে ভবিষ্যতে যত জনই আসুক, উনাকে সবাই স্যালুট করবে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে যাওয়ার নেতা তিনি। উনি উৎসাহ দিলে প্রেরণা পাই অনেক।”
লিগের শুরুটা ভালো করার পর এখন এনামুলের চাওয়া নিজেকে আরও ছাড়িয়ে যাওয়া। জাতীয় দলে ফিরলে এবার পুরো প্রস্তুত হয়েই আসতে চান।
“সবসময় চাই নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে। আগের লিগে ২টি সেঞ্চুরি করেছি, এবার বেশি করতে পারি কিনা…আগে চার ঘণ্টা অনুশীলন করলে এখন ৬ ঘণ্টা পারি কিনা। নিজের মধ্যে আরও পেশাদারিত্ব কিভাবে আনা যায়। আরও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে জাতীয় দলে ঢোকা যায় কিনা…।”
এনামুলের মতো প্রতিভা পথ হারালে দিন শেষে ক্ষতি বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই। তিনি ভুল শোধরাতে পারলে লাভটাও যেমন বেশি বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই।