কোনো বিদেশি ক্রিকেটারকেই মাঠে নামাতে পারেনি দুর্বার রাজশাহী, সব দেশি ক্রিকেটার নিয়ে একাদশ গড়ে রংপুর রাইডার্সকে হারিয়ে দিল তারা।
Published : 26 Jan 2025, 10:31 PM
ম্যাড়ম্যাড়ে শেষের পথে এগিয়ে যাওয়া ম্যাচে শেষ ওভারে হঠাৎই নাটকীয়তা। ৬ বলে রংপুরের প্রয়োজন ছিল ২৫ রান। জিসান আলমের পরপর দুই বল ছক্কা মেরে দিলেন মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিন। প্রায় হেরে যাওয়া ম্যাচে হুট করেই যেন আশার আলো দেখতে পেল তার দল। তবে পরের দুই বলে টাইমিং হলো না ঠিকঠাক। বল লং অনে গেলেও সিঙ্গল নিলেন না সাইফ। শেষ দুই বলে ছক্কা মারতে পারলে ম্যাচ তখনও গড়াতে পারে সুপার ওভারে। কিন্তু পঞ্চম বলে কেবল চারই মারতে পারলেন সাইফ। শেষ বল আবার উড়িয়ে দিলেন ছক্কায়। এমন ঝড়ো শেষের পরও হতাশায় মাঠে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।
শেষ ওভারে ২২ রান দিলেও রাজশাহী তখন মেতে উঠেছে উল্লাসে। জিতেছে তারা দুই রানে। কিন্তু ব্যবধানে কী যায়-আসে! তাদের কাছে এটা তো স্রেফ একটি ম্যাচ জয়ই নয়! মাঠের বাইরে থেকে ক্রিকেটার, কোচিং স্টাফরা মাঠে ছুটে গেলেন। এক ম্যাচ জিতে যেন শিরোপা জয়ের উৎসব করে ফেললেন তারা!
তাদের কাছে এটি স্রেফ একটি জয়ের চেয়েও বেশি কিছু ম্যাচের আগের ঘটনাপ্রবাহের কারণে। এমনিতে পারিশ্রমিক বিতর্কে জেরবার এই দল। এই ম্যাচের আগে আচমকা হোটেল বদলানোর ঝামেলাও পোহাতে হয় ক্রিকেটারদের। এর মধ্যেই আরেক সঙ্কট, পারিশ্রমিক না পাওয়ায় মাঠে আসেননি বিদেশি ক্রিকেটাররা। অথচ বিপিএলের নিয়মে আছে, অন্তত দুজন বিদেশি ক্রিকেটার একাদশে রাখতেই হবে! শেষ পর্যন্ত বিপিএল টেকনিক্যাল কমিটির বিশেষ অনুমতি নিয়ে দেশের ১১ ক্রিকেটার নিয়ে খেলতে নামে তারা। অনিশ্চয়তা ছিল দেশি ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ নিয়েও। তবে শেষ মুহূর্তে পারিশ্রমিকের খাম দিয়ে তাদের মাঠে আনতে সমর্থ হয় ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। এত কিছুর পরও তারা উজ্জীবিত পারফরম্যান্সে হারিয়ে দিল শক্তিতে অনেক এগিয়ে থাকা এবং পয়েন্ট তালিকার শীর্ষে থাকা রংপুরকে।
লক্ষ্য বড় না হলেও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি ও তাসকিন আহমেদের আগুনে বোলিংয়ে বেশ আগেই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় রংপুর। পঞ্চাশের আগেই তারা হারিয়ে ফেলে ৭ উইকেট। সেখান থেকে সাইফ উদ্দিন এক প্রান্ত ধরে রেখে দলকে নিয়ে যান জয়ের কাছাকাছি। তবে তুলির শেষ আঁচড়টা দিতে ব্যর্থ এই অলরাউন্ডার।
শেষ দিকে স্নায়ুর চাপ ধরে রেখে জিতে গেল রাজশাহী। ১১ ম্যাচে পঞ্চম জয়ে প্লে-অফের টিকেট পাওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে গেল তারা। শুরুতে টানা ৮ ম্যাচে উড়তে থাকা রংপুর এ নিয়ে রাজশাহীর কাছেই হারল দুই ম্যাচ।
তুমুল অনিশ্চয়তার পর মাঠে নেমে ম্যাচের শুরুতেও ছন্নছাড়া ছিল রাজশাহী। ব্যাটিং ব্যর্থতায় মাত্র ১১৯ রানে গুটিয়ে যায় তারা। কিন্তু পেসারদের তোপে রংপুরের ব্যাটিং কাঁপিয়ে অনেক দিন মনে রাখার মতো এক জয়ই পেলেন তাসকিন আহমেদরা।
দুই ম্যাচ পর একাদশে ফিরে রাজশাহীর নায়ক মৃত্যুঞ্জয়। আগের চার ম্যাচে তিনি নিতে পেরেছিলেন কেবল তিন উইকেট। এ দিন নতুন বলে প্রথম স্পেলে চার উইকেট নিয়ে তিনি ধসিয়ে দেন রংপুরের ব্যাটিং। দুটি করে উইকেট নেন তাসকিন ও মোহর শেখ।
সাকিব আল হাসানকে ছাড়িয়ে এক বিপিএলে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড গড়েন তাসকিন।
শুরুতেই চাপে রাজশাহী
টস হেরে ব্যাটিং নেমে শুরু থেকেই রানের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকে রাজশাহী। একাদশে ফিরে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন জিসান আলম। তৃতীয় ওভারে মোহাম্মদ সাইফ উদ্দিনের বল ভুল লাইনে স্লগ করতে গিয়ে বোল্ড তরুণ ওপেনার।
চতুর্থ ওভারে আক্রমণে আসা রকিবুল হাসানের প্রথম বলে স্টাম্পড আরেক ওপেনার সাব্বির হোসেন। দুই চারে তিনি করেন ১১ রান।
পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে নাহিদ রানার বলে ছক্কা মারেন এনামুল হক। প্রথমবার ছয়ের ওপরে ওঠে রাজশাহীর রান রেট।
প্রতিরোধের চেষ্টার পর ব্যাটিং ধস
দুই ওপেনারের বিদায়ের পর প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এনামুল হক ও মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি। দুজন মিলে তৃতীয় উইকেটে গড়েন ইনিংসের সর্বোচ্চ ২৩ রানের জুটি। সপ্তম ওভারে এই জুটি ভাঙেন খুশদিল শাহ। চার নম্বরে নেমে ১০ রান করে আউট হন মৃত্যুঞ্জয়।
এরপর ধস নামে রাজশাহীর ব্যাটিংয়ে। ১৩ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারায় তারা। ক্রিজে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটানো এনামুল ফেরেন রান আউট হয়ে। এসএম মেহেরব, ইয়াসির আলি টিকতে পারেননি বেশিক্ষণ।
ঘরোয়া ক্রিকেটে এমনিতে ওপরের দিকে ব্যাট করলেও চলতি আসরে প্রথম সুযোগ পাওয়া মিজানুর রহমানকে নামানো হয় আট নম্বরে। সেখানে তেমন কিছুই করতে পারেননি তিনি। আকবর আলি ২১ বলে ১৯ রান করে ধরেন ড্রেসিং রুমের পথ।
সানজামুলের ব্যাটে একশ পার
শেষ দিকে রাজশাহীর ব্যাটিংয়ের হাল ধরেন সানজামুল ইসলাম। ত্রয়োদশ ওভারে ব্যাটিংয়ে নেমে শেষ পর্যন্ত আউটই হননি অভিজ্ঞ বাঁহাতি স্পিনার। একপ্রান্ত ধরে রেখে ৪ চারে ২৯ বলে ২৮ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে তাসকিনের বিদায়ের পর শেষ দুই ওভার একাই খেলেন সানজামুল। উনবিংশ ওভারে নাহিদের বলে দুটি বাউন্ডারি পেয়ে যান তিনি। শেষ ওভারে সাইফ উদ্দিনের বলে মারেন আরেকটি চার।
সানজামুলের অপরাজিত ইনিংসের সৌজন্যে কোনোমতে একশ পার করে রাজশাহী। যা পরে মহামূল্যবান হয় দলের জন্য।
খুশদিলের ৩ উইকেট
আসরের শুরু থেকে অলরাউন্ড পারফর্ম করা খুশদিল শাহ এদিন নেন ৩ উইকেট। চার ওভারে খরচ করেন মাত্র ১৯ রান। সব মিলিয়ে টুর্নামেন্টে ১৯ উইকেট হয়ে গেল তার। এর সঙ্গে তিনশ ছুঁইছুঁই রান করে টুর্নামেন্ট সেরার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন বাঁহাতি স্পিন অলরাউন্ডার।
তাসকিন-মৃত্যুঞ্জয়ের তোপ
অল্প পুঁজিতে বল হাতে শুরুতেই প্রয়োজন ছিল ব্রেক থ্রু। চতুর্থ বলেই তা এনে দেন তাসকিন। কট বিহাইন্ড হয়ে ফেরেন স্টিভেন টেইলর। রানের খাতা খুলতে পারেননি বাঁহাতি ওপেনার। এখন পর্যন্ত ৬ ম্যাচে তার সংগ্রহ ৮২ রান।
অধিনায়কের দেখানো পথ ধরে এরপর রংপুরের ব্যাটিং কাঁপিয়ে দেন দুই ম্যাচ পর একাদশে ফেরা মৃত্যুঞ্জয়। দ্বিতীয় ওভারে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিন নম্বরে নামা সাইফ হাসান।
চোট কাটিয়ে ফিরে চলতি আসরে প্রথম খেলতে নামা সৌম্য সরকার একদমই সুবিধা করতে পারেননি। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে মৃত্যুঞ্জয়ের পরপর দুটি লাফিয়ে ওঠে ডেলিভারি ব্যাটেই লাগাতে পারেননি বাঁহাতি ওপেনার।
প্রায় একই ধরনের তৃতীয় বলে আপার কাট খেলার চেষ্টায় কট বিহাইন্ড হন সৌম্য। ১৩ বলে মাত্র ৮ রান করতে পারেন তিনি। মারতে পারেননি কোনো বাউন্ডারি।
ওই ওভারের শেষ বলে আরেকটি শর্ট বলে পরাস্ত শেখ মেহেদি হাসান। উইকেটের পেছনে অনেকটা লাফিয়ে উঠে এক হাতে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন আকবর। রংপুরের প্রথম চার উইকেটের সবাই ফেরেন কট বিহাইন্ড হয়ে।
নিজের পরের ওভারে নুরুল হাসান সোহানকেও ফেরান মৃত্যুঞ্জয়। ৮ ওভারে মাত্র ৩০ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ম্যাচ থেকে অনেকটাই ছিটকে যায় রংপুর।
মোহরের জোড়া আঘাত
অল্পেই ৫ উইকেট হারানোর পর রংপুরের আশার ভেলা বয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল ইফতিখার আহমেদ ও খুশদিল শাহর কাঁধে। দুজনকেই ড্রেসিং রুমে ফেরত পাঠিয়ে দেন মোহর শেখ।
নবম ওভারে মোহরের শর্ট বলে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দেন ইফতিখার। ২০ বলে ১৪ রান করেন অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান।
এরপর সাইফ উদ্দিনকে নিয়ে ১৯ রানের জুটি গড়েন খুশদিল। দলের পঞ্চাশ হওয়ার আগেই মোহরের নিচু হওয়া বলে বোল্ড হয়ে যান আসরজুড়ে দারুণ ছন্দে থাকা অলরাউন্ডার।
সাইফ উদ্দিন-রকিবুলের লড়াই
স্বীকৃত সব ব্যাটসম্যানের বিদায়ের পর রকিবুল হাসানকে নিয়ে লড়াই করেন সাইফ উদ্দিন। দুজন মিলে অষ্টম উইকেটে গড়ে তোলেন ৩৬ বলে ৪২ রানের জুটি।
অষ্টাদশ ওভারে মৃত্যুঞ্জয়ের বলে দুটি চার মারেন সাইফ উদ্দিন। পরের ওভারে রকিবুলের কাছে তাসকিনও দুটি বাউন্ডারি হজম করলে হঠাৎই যেন প্রাণ ফেরে ম্যাচে। ওই ওভারের চতুর্থ বলে রকিবুলকে এলবিডব্লিউ করেন তাসকিন।
দশম নম্বরে নেমে প্রথম বলেই চার মেরে দেন আকিফ জাভেদ। ফলে শেষ ওভারে বাকি ২৫ রান। যেখানে জিসানের ওভারে শেষ চেষ্টা করলেও পারেননি সাইফ উদ্দিন। বিপিএল ক্যারিয়ারে নিজের প্রথম ফিফটিতে ৩৬ বলে ৫২ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি।
তাসকিনের রেকর্ড
টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই দারুণ ছন্দে থাকা তাসকিনের ১১ ম্যাচে হয়ে গেল ২৪ উইকেট। বিপিএলের এক আসরে এটিই সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। ২০১৯ সালে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে ১৫ ম্যাচে ২৩ উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান।
৪ ক্যাচে আকবরের কীর্তি
রংপুরের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের ক্যাচ নেন আকবর। বিপিএলে এক ম্যাচে এটিই উইকেটকিপারদের সর্বোচ্চ ক্যাচের রেকর্ড। ২০১৫ সালে বরিশাল বুলসের হয়ে রনি তালুকদার ও গত আসরে ফরচুন বরিশালের হয়ে গ্লাভস হাতে ৪টি ক্যাচ নিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
দুর্বার রাজশাহী: ২০ ওভারে ১১৯/৯ (জিসান ২, সাব্বির ১১, এনামুল ১৩, মৃত্যুঞ্জয় ১০, মেহেরব ৭, ইয়াসির ৩, আকবর ১৯, মিজানুর ৫, সানজামুল ২৮*, তাসকিন ১৩, মোহর ০*; সাইফ উদ্দিন ৪-০-২৩-২, আকিফ ৪-০-২১-১, রকিবুল ২-০-২১-২, নাহিদ ৪-০-২৬-০, খুশদিল ৪-০-১৯-৩, মেহেদি ২-০-৮-০)
রংপুর রাইডার্স: ২০ ওভারে ১১৭/৮ (টেইলর ২, সৌম্য ৮, সাইফ হাসান ০, ইফতিখার ১৪, মেহেদি ০, সোহান ২, খুশদিল ১০, সাইফ উদ্দিন ৫২*, রকিবুল ২০, আকিফ ৪*; তাসকিন ৪-০-২৫-২, মৃত্যুঞ্জয় ৪-১-১৮-৪, মোহর ৪-০-১৫-২, মেহেরব ৩-০-১৫-০, সানজামুল ১-০-৫-০, জিসান ৪-০-৩৮-০)
ফল: দুর্বার রাজশাহী ২ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি