পাওয়ার হিটিংয়ের সামর্থ্যে সাড়া জাগানো সেই ব্যাটার নানা কারণে চাপা পড়েছেন আড়ালে, এবার প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে নতুন শুরুর আশা তার।
Published : 19 Feb 2025, 08:06 AM
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটে বড় দুর্বলতার জায়গা ব্যাটিং। সবচেয়ে বেশি ঘাটতি পাওয়ার হিটিংয়ে। দ্রুত গতিতে রান তোলা, নিয়মিত চার-ছক্কার প্রদর্শনী কিংবা বেশি স্ট্রাইক রেটে বড় ইনিংস খেলা, সময়ের এসব দাবি মেটানোয় অনেক পিছিয়ে এই দেশ। বছর দুয়েক আগে এই জায়গাতেই আশার আলো হয়ে আবির্ভাব হয়েছিল এক ব্যাটারের। তবে সময়ের পরিক্রমায় তিনি ডুবে গেছেন আঁধারে। এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে আবার জ্বলে ওঠার আশায় আছেন সেই ব্যাটার আফিয়া হুমায়রা আনাম প্রত্যাশা।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০২৩ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রথম পাওয়ার হিটিংয়ের ঝলক দেখান প্রত্যাশা। অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরুর ম্যাচে দুইটি করে চার-ছক্কা মারেন তিনি। পরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৪৩ বলে ৫৩ রানের ইনিংসটি সাজান ৫ চারের সঙ্গে ৩ ছক্কায়।
মেয়েদের বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপের প্রথম আসরটিতে এক ইনিংসে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ছক্কা ছিল শুধু ভারতের শেফালি ভার্মার। শারীরিক গড়ন ও খেলার ধরনে মিল থাকায় প্রত্যাশার মাঝে শেফালি হয়ে ওঠার আশাই দেখছিলেন অনেকে।
কিন্তু বিশ্বকাপের পর শেফালি যখন ক্রমে হয়ে উঠেছেন বিশ্ব ক্রিকেটের আলোচিত নাম, প্রত্যাশা তখন আড়ালে চলে গেছেন দেশের ক্রিকেটেই!
বিশ্বকাপ থেকে ফেরার পর একের পর এক প্রতিবন্ধকতা এসেছে প্রত্যাশার ক্রিকেট যাত্রায়। দেশে ফিরে বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগে (বিসিএল) খেলার প্রস্তুতি নেন তিনি। কিন্তু টুর্নামেন্টের প্রথম দিনই অসুস্থতার কারণে ছিটকে যান মাঠ থেকে। জানা যায়, ডায়াবেটিকস, এপেন্ডিসাইটিস, কিডনিতে পাথরসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন তরুণ এই ক্রিকেটার।
সেসব পাশ কাটিয়ে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেললেও তেমন ভালো করতে পারেননি। পরে তিন মাসের বেশি সময় ক্রিকেটের বাইরে থাকতে হয় তাকে। সুস্থ হয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে জাতীয় দলের অনুশীলন ক্যাম্পে ডাক পান প্রত্যাশা। কিন্তু সেখানে আবার চোট পান কাঁধে।
এরপর আর জাতীয় দলের আশপাশে যাওয়া হয়নি তার। একজন আগ্রাসী ব্যাটারের জন্য বাংলাদেশ দলের হাহাকারও মেটেনি এখনও।
বারবার হোঁচট খেয়েও অবশ্য মুখ থুবড়ে পড়েননি প্রত্যাশা। বরং চালিয়ে যাচ্ছেন মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই। তার সামনের অভিযান এখন ডাকা প্রিমিয়ার লিগ। বুধবার শুরু হতে যাওয়া টুর্নামেন্টে খেলাঘর সমাজকল্যাণ সমিতিতে নাম লিখিয়েছেন ২০ বছর বয়সী ওপেনার।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে নিজের বর্তমান অবস্থা জানান তিনি।
“এখন ভালো আছি। শতভাগ ফিট আছি।”
“গত বছর লিগে আবাহনীতে ছিলাম। ম্যাচ খেলার সুযোগ পাইনি। পরে খেলাঘরে গিয়ে তিনটা ম্যাচ খেলতে পেরেছিলাম। একটাতে রান পেয়েছিলাম। সব মিলিয়ে ভালো-খারাপ ছিল। এবার চেষ্টা করছি প্রিমিয়ার লিগ দিয়ে যেন (জাতীয় দলে) ফিরতে পারি।”
সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে যাত্রা শুরুর পর চোটের ধাক্কা, তারপর ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। কঠিন এই পথচলায় ইতিবাচক মানসিকতা ধরে রাখছেন প্রত্যাশা। সামনের প্রিমিয়ার লিগকে নতুন শুরুর সুযোগ হিসেবে নিচ্ছেন তিনি।
“ক্রিকেট খেলতে গেলে চোট আসবে, বড় ইনজুরিও হতে পারে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সবসময়ই কঠিন। জাতীয় দলের দুয়ারে ছিলাম… সেখান থেকে ফিরে আসা, ঘুরে দাঁড়ানো, আবার সেখানে যাওয়া... অনেকটা শূন্য থেকে শুরু করার মতো।”
“অনুশীলনে কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার ফিটনেসে কিছুটা ঘাটতি ছিল। তাই লক্ষ্য ছিল ফিটনেস কীভাবে আরও উন্নত করা যায়। ফিটনেস উন্নতি হলে, স্কিল এমনিই ভালো হয়ে যাবে। সেটা নিয়েই কাজ করেছি। আশা করছি, প্রিমিয়ার লিগে ভালো কিছু হবে।”
ফেরার লড়াইয়ে রাজশাহীতে নিজ শহরে ফিরে ছোটবেলার কোচ আরিফিন চৌধুরি তুষারের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রত্যাশা। পরে ফিটনেসে ঘাটতি টের পাওয়ায় ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। বিসিবির ট্রেনার তুষার কান্তি হাওলাদারের তত্ত্বাবধানে ফিটনেস উন্নতিতে কাজ করছেন তিনি।
এই অভিযানেও আরেকবার ধাক্কা খান প্রত্যাশা। চিকেন পক্স হওয়ায় গত বছরের শেষ দিকে প্রায় এক মাস ক্রিকেটীয় সব কিছু থেকে দূরে থাকতে হয় তাকে। এরপর আবার শুরু হয় ফেরার লড়াই।
স্বপ্নটা তার এখনও অটুট। লম্বা সময় খেলতে চান জাতীয় দলে। সেই আশা নিয়েই স্কিল ও ফিটনেস নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি।
“আমার মনে হয়, ফিটনেস, মানসিকতা ও ব্যাটিং মিলিয়ে খারাপ সময় কাটিয়ে উঠেছি। যেসব ঘাটতি ছিল বা যেগুলো ভালো ছিল, সব নিয়েই কাজ করেছি। গত ছয় মাস ফিটনেসে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। কারণ জাতীয় দলে খেলতে হলে ফিটনেস লাগবেই।”
“ব্যাটিংয়ে ফিফটি করার পর যদি ফিল্ডিংয়ে ৩-৪টা বল ছেড়ে দেই, তাহলে ১৫-২০ রান কমে গেল। তাই ফিটনেসটা ওই পর্যায়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। যেন যখন জাতীয় দলে ঢুকব, সেখান থেকে যেন বের হয়ে আসতে না হয়। আমি যেন টানা দেশকে সার্ভিস দিতে পারি।”
অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রত্যাশার সতীর্থ মারুফা আক্তার, স্বর্ণা আক্তার ও রাবেয়া আক্তার এর মধ্যে জাতীয় দলে নিজেদের জায়গা পোক্ত করে ফেলেছেন। দলের এক নম্বর পেসার হয়ে গেছেন মারুফা। লেগ স্পিনে বাজিমাত করছেন রাবেয়া। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে স্বর্ণাও এখন দলের বড় ভরসা।
এক সময়ের সতীর্থদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে দেখে যেমন উচ্ছ্বসিত তিনি, তেমনি ভেতরে ভেতরে চুপসে যান নিজেকে নিয়েও। তবে হতাশায় ডুব না দিয়ে পরমুহূর্তে নিজেকে উজ্জীবিত করেন তিনি সুসময়ের হাতছানির আশায়।
“একজন ক্রিকেটারের জন্য আসলে এটা দুঃখজনক যে, সতীর্থরা ভালো জায়গায় খেলছে আর আমার সেই জায়গায় গিয়েও ফিরে আসতে হয়েছে। এটা যে কোনো ক্রিকেটারের জন্য খারাপ লাগা কাজ করে। তবে চেষ্টা করেছি ভালো-খারাপ সব কিছু ঠেলে মাঠে ফেরার।”
“আমার বিশ্বাস আছে, আমি জাতীয় দলে খেলার মতো সামর্থ্যবান। এখনও বয়স অনেক কম আমার। অনেক দিন ক্রিকেটের সঙ্গে থাকব। চেষ্টা করব যত দ্রুত জাতীয় দলে ফেরা যায়।”
দেশের ক্রিকেটে পাওয়ার হিটিংয়ের ঘাটতি সবসময়ই মাথাব্যথার কারণ। সেই জায়গায়ই বড় আশা প্রত্যাশাকে ঘিরে। বড় শট খেলার সহজাত সামর্থ্য টের পান তিনি শৈশব থেকেই।
“ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে বাসার সামনের মাঠে টেনিস বলে খেলতাম। ছোট মাঠ ছিল, এক-দুই রান নেওয়া হতো না। চার-ছক্কাই বেশি মারতাম। সেখান থেকে (পাওয়ার হিটিং) সহজাত হয়ে গেছে। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার সময়ও টিম ম্যানেজমেন্ট আমার মধ্যে এটা দেখে। উনারাও আমাকে নিয়ে অনেক কাজ করেছেন। ধীরে ধীরে এটি আমার জন্য সহজ হয়ে গেছে।”
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান প্রত্যাশার ক্রিকেট শুরুর দিনগুলোও ছিল বেশ মজার। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় প্রথম ক্রিকেট বলের অনুশীলনে যান তিনি। কিন্তু ব্যাটিংয়ের আগে রানিং সেশন করানোয় দুই বছর আর ওমুখো হননি।
তবে ক্রিকেটেই স্বপ্ন বোনায় ২০১৬ সালে বিকেএসপির ট্রায়াল দেন এবং টিকে যান। তখন মাত্র পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী তিনি। বাবা-মায়ের থেকে দূরে একা ক্যাম্পে চার দিনের বেশি টিকতে পারেননি সেদিনের ছোট্ট বালিকা।
ওই বছর রাজশাহী মহিলা কমপ্লেক্সে জাতীয় ক্রিকেট লিগের ট্রায়ালে ৯টি ছক্কা মেরে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন প্রত্যাশা। ওই টুর্নামেন্ট দিয়েই শুরু হয়ে যায় ব্যাট-বল নিয়ে স্বপ্নপূরণের সত্যিকারের যাত্রা।
সেই স্বপ্ন অবশ্য শুরুতে দেখেন প্রত্যাশার বাবা আখতারুল আনাম ববিন। নিজে ক্রিকেটার হওয়ার আকাঙ্খা পূরণ করতে না পারলেও একমাত্র সন্তানকে দেখিয়ে দেন সাফল্যের পথ। বাবার স্বপ্নকে নিজের বুকে লালন করার গল্পটাও শোনান প্রত্যাশা।
“আমার বাবা রাজশাহীর বিভাগীয় ক্রিকেটে খেলেছেন। তবে বেশি দিন পারেননি। অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেলেছিলেন। পরিবারের দায়িত্ব চলে এসেছিল। তাই উনার স্বপ্নই ছিল, ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, ক্রিকেটারই বানাবেন। বাবার স্বপ্ন থেকেই নিজের স্বপ্ন বোনা। বাবার যে স্বপ্ন... একটু একটু করে সেদিকেই হাঁটছি। বাবাই আমাকে ক্রিকেটে এনেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন।”
“যখন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে যাই, তখন থেকে আমার বিশ্বাস হয় যে আমি দেশকে কিছু দিতে পারব। সেই সামর্থ্য আমার আছে। পরে বিসিবি বা বড় আপুরা, সব সময় আমাকে সাহস দিয়েছেন। দেখা হলে বলেছেন, তুমি ভালো ক্রিকেটার। ভালো কিছু করতে পারবে। প্র্যাকটিস করো, পরিশ্রম করো, ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”
নিজের স্বপ্ন আর সতীর্থদের সেই প্রেরণাতেই এখন ধাবমান প্রত্যাশা।