বুদ্ধির জোর দেখিয়ে ইফতিখার এখন ‘চাচা’

পাকিস্তানের গণ্ডি পেরিয়ে কীভাবে সার্বজনীন ‘চাচা’ হলেন, সেই গল্প শোনালেন ফরচুন বরিশালের হয়ে বিপিএল খেলতে আসা ইফতিখার আহমেদ।

শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদচট্টগ্রাম থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2023, 03:13 PM
Updated : 15 Jan 2023, 03:13 PM

চট্টগ্রামের হোটেল লবিতে বসে ফরচুন বরিশালের বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের প্রশংসা করছিলেন ইফতিখার আহমেদ। পাশ দিয়ে তখন হেঁটে যাচ্ছিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতেই ইফতিখার বলেন, ‘(মিরাজ) আমাদের সেরা খেলোয়াড়… মূল খেলোয়াড়ও বলা যায়।’ সামনাসামনি এমন প্রশংসা পেয়ে বিগলিত মিরাজও শুরু করলেন ইফতিখারের গুণগান। দলের মধ্যে যাকে ‘চাচা’ নামে ডাকেন মিরাজসহ প্রায় সবাই।

হাত মিলিয়ে মিরাজ চলে গেলেন একটু পরই। ইফতিখার খুলে বসলেন গল্পের ঝাঁপি। যে গল্পের মূল উপাদান তার ‘চাচা’ নামের রহস্য। পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানের এমন নামে পরিচিতি পেয়ে যাওয়ার মূল অনুঘোটক তার জাতীয় দলের অধিনায়ক বাবর আজম।

এই নামের পেছনের গল্পটাও একটু অন্যরকম। ইফতিখার মূলত ব্যাটসম্যান, পাশাপাশি বোলিংও করেন। কিন্তু বাবর আজম তাকে এই নাম দিয়েছেন বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ের কারণেই।

চট্টগ্রামে রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথোপকথনে ৩২ বছর বয়সী পাকিস্তান ব্যাটসম্যান শোনালেন এই গল্পসহ, বিপিএলে নিজের অভিজ্ঞতা, বরিশালের সম্ভাবনা, বিপিএলের সঙ্গে পিএসএলের তুলনাসহ আরও অনেক কিছু।

অস্ট্রেলিয়ায় গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে ৩২ বলে ৫১ রান করেন ইফতিখার। পাকিস্তান ম্যাচটি শেষ বলে হেরে গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ইফতি চাচার’ প্রশংসা দেখা যায় প্রচুর। ক্রিকেট বিশ্বজুড়ে তার এই নাম ছড়াতে থাকে মূলত তখনই।

তবে ওই ম্যাচেরও দুই বছর আগে থেকে পাকিস্তানে ‘চাচা’ হিসেবে পরিচিত ইফতিখার। তিনি নিজেও বেশ মজা আর আগ্রহ নিয়ে শোনালেন সেই গল্প।

“এই চাচা ডাকের পেছনে ছোট্ট একটা ঘটনা আছে। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ম্যাচ ছিল আমাদের। (ব্রেন্ডন) টেইলর ব্যাটিং করছিল, আমি ছিলাম বোলিংয়ে। অধিনায়ক বাবরকে বললাম, ‘আমার বল স্পিন করছে। মিড উইকেট সামনে এনে স্কয়ার লেগ বাইরে পাঠাও।’ কারণ টেইলর মিড উইকেটে খেলতে চাইবে, কিন্তু স্পিনের কারণে বল স্কয়ার লেগে যাবে। পরের বল করলাম। টেলর পা এগিয়ে মারল। বল উড়ে চলে গেল ডিপ স্কয়ার লেগ ফিল্ডারের হাতে।”

“তখন বাবর আমাকে বলতে শুরু করল, ‘ওয়েল ডান! চাচা-এ-ক্রিকেট।’ মানে, ও (বাবর) বোঝাতে চাচ্ছিল যে, ‘আপনি এতো বুদ্ধি দিয়ে এটি ভেবেছেন। তাই আপনি চাচা-এ-ক্রিকেট।’ বাবরের এই কথা স্টাম্প মাইকে ধরা পড়ে যায়। পরে ম্যাচ শেষে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি সবাই আমাকে চাচা-চাচা বলে মেসেজ পাঠাচ্ছে।”

ইফতিখারের ‘চাচা’ উপাধি পাওয়ার ম্যাচটি ছিল ২০২০ সালের নভেম্বরে। পাকিস্তান সফরে গিয়ে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ২০৬ রানে গুটিয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। অফ স্পিনে ৪০ রান খরচায় ৫ উইকেট নেন ইফতিখার। সেদিন তার তৃতীয় শিকার ছিলেন টেলর। ডিপ স্কয়ার লেগে ক্যাচটি নেন ইমাম-উল-হক।

তবে এই ‘চাচা’ ডাকে কোনো আপত্তি নেই ইফতিখারের। বরং সবাইকে এই নামে ডাকার অঘোষিত লাইসেন্সও দিয়ে রেখেছেন তিনি।

“মানুষ এখন প্রায়ই (চাচা) বলে। আমিও এখন উপভোগ করছি। ব্র্যান্ড হয় না? মানুষ কোটি টাকা ঢালে তাতে। আমিও এখন অমন একটা ব্র্যান্ড হয়ে গেছি (হাসি)। (বরিশাল) দলের ওরা তো বলেই ফেলে। সাকিবও চাচা বলে। সবাই মিলে গল্প করি। আড্ডা চলতে থাকে।”

পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগে (এলপিএল) খেলার অভিজ্ঞতা থাকা ইফতিখার এবারই প্রথম এসেছেন বিপিএলে। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ২৬ বলে ৫৭ রানের ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছেন তিনি। সেদিন আবু জায়েদ চৌধুরি, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরিদের তুলাধুনা করে শেষ তিন ওভারেই যোগ করেন ৫১ রান।

এর আগে ম্যাচে ১৮ বলে ২৫ রানের অপরাজিত ইনিংসে ম্যাচ শেষ করে ড্রেসিংরুমে ফেরেন তিনি। পছন্দের পজিশন টপ-মিডল অর্ডার হলেও বিপিএলে এবার ফিনিশার হিসেবে নতুন চ্যালেঞ্জ জয়ের অভিযানে পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান।

“বরিশালের এই দলে আমাকে নিয়ে অধিনায়ক ও ম্যানেজম্যান্টের পরিকল্পনা একদম পরিষ্কার। আমাকে ইনিংসের শেষ পর্যন্ত যেতে হবে, এরপর ইনিংসটাকে গড়া ও শেষ করে আসা। এই চেষ্টাটাই আমি করছি।”

“পাকিস্তানের হয়ে আমি নানা পজিশনে ব্যাট করেছি। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও তাই। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই ৪ নম্বরে খেলতে। তাহলে ইনিংসটা লম্বা করার সুযোগ থাকে। আমি চাই অনেক রান করতে, বড় রান করতে। সেখান থেকেই ইনিংসের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে চাইব। ম্যাচ ফিনিশ করতে চাইব।”

সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ১৯৪ রান করেও জিততে পারেনি বরিশাল। তবে পরের তিন ম্যাচ জিতে পয়েন্ট টেবিলের দুইয়ে উঠে এসেছে তারা। তিন জয়ের একটিতে নায়ক ইফতিখার।

বরিশালকে বাকি দুই ম্যাচ জেতান দলের দুই দেশি তারকা সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। নিজে এক ম্যাচ জেতালেও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষেত্রে দেশি ক্রিকেটারদেরই এভাবে দায়িত্ব নিতে হবে বলে মনে করেন ইফতিখার।

“ইনশাআল্লাহ (ফাইনাল খেলব)…! আমাদের দল যেমন, আমাদের স্থানীয় ক্রিকেটাররা দারুণ। আমি সবসময় বিশ্বাস করি, যারাই জিতুক, তাদের স্থানীয়রাই জেতাবে। বিদেশি যারা আসবে, তারা তো পারফর্ম করবেই। কিন্তু স্থানীয় যারা আছে, তাদের ওপরও নির্ভর করে। স্থানীয় ক্রিকেটাররা পারফর্ম করলে আপনি এমনিই জিতবেন। আমাদের স্থানীয় ক্রিকেটাররা অসাধারণ।”

“মিরাজ আমাদের সেরা খেলোয়াড়। যদি বলি সে আমাদের মূল খেলোয়াড়, তাতেও ভুল হবে না। তাকে দিয়ে সহজেই তিনটা কাজ করাতে পারি। বোলিং, ব‌্যাটিংয়ের পাশাপাশি দলের সেরা ফিল্ডারদের একজন সে। সাকিব ভাইয়ের যত প্রশংসাই করি না কেন, কম হবে। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং- তিন দিকেই পারফর্ম করছেন। অধিনায়কত্বও দারুণ করছেন।”

বিপিএল নিয়ে এই কথার স্রোত এক সময় গিয়ে মেশে পিএসএলের মোহনায়। ইফতিখার পার্থক্যগুলো আলাদা করে বলতে চাইলেন না।

“সব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের আমেজ আলাদা, দর্শক আলাদা, খেলার ধরনও আলাদা। এক লিগের সঙ্গে আরেক লিগের তুলনা করা যায় না। পিএসএল এখন বিশ্বের সেরা টুর্নামেন্টগুলোর একটি। বিপিএলও তাই। এখন পর্যন্ত বিপিএল খুবই উপভোগ করছি।”

বিপিএলের এবারের আসর শুরুর আগে থেকেই এডিআরএস নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। টুর্নামেন্টের ১২ ম্যাচে এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার দেখা গিয়েছে বিতর্ক। ইফতিখারেরও চোখে লেগে রিভিউ সিস্টেমের প্রযুক্তির ব্যবহারের অপ্রতুলতা।

“পিএসএল এখন অনেক বড় ব্র্যান্ড, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিপিএলও বড় ব্র্যান্ড। কিন্তু এখানে ডিআরএস সিস্টেমকে আরও ভালো করা উচিত। তাহলে কোনো সংশয় সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ থাকে না।”

চট্টগ্রামের বিপক্ষে ম্যাচটিতে ৩ চারের সঙ্গে ৫টি ছক্কা মারেন ইফতিখার। সেদিন শেষ ১৩ বলে ৪৭ রান করেন তিনি। বড় শটের রসায়ন তার ভালোভাবেই জানা, ২০ ওভারের ক্রিকেটে ছক্কা মেরেছেন ১৫২টি। ইফতিখার বললেন, পেশির জোর আর স্কিল মিলিয়েই তার ব্যাট থেকে বল উড়ে যায় মাঠের নানা প্রান্তে।

“পেশি শক্তির কারণেই সব অনায়াসে হচ্ছে, তা নয়। পাওয়ার হিটিংয়ের জন‌্য আপনাকে ড্রিল করতেই হবে। আমি নিজের কাজ জানি। যে সময়ে ব‌্যাটিংয়ে যা,ই সে সময়ে খুব কম বল খেলার সুযোগ হয়। তখন বাউন্ডারি মারতেই হবে। সেভাবেই পরিকল্পনা করি। অনুশীলনও সেভাবে করি। চেষ্টা থাকে মাঠের চারিদিকে শট খেলার।”

“অনুশীলনেই নিজেকে সেভাবে ঝালিয়ে নেই। এরপর ম‌্যাচে তা বাস্তবায়ন করি। কভার থেকে শুরু করে স্কয়ার লেগ, সব জায়গায় শট খেলার চেষ্টা থাকে। এতে আমার সফলতার হার বেড়ে যায়। আমি বিশ্বাস করি, আপনি মাঠে যতটা পরিশ্রম করবেন, নিজেকে যতটা ঝরঝরে করে তুলবেন, ততটা মাঠে নিংড়ে দিতে পারবেন। তাতে কাজটা সহজ হয়ে যায়।”