নারী ক্রিকেটে আইসিসির নতুন ভবিষ্যৎ সফর সূচিতে (এফটিপি) প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড সফর আছে বাংলাদেশ দলের, পাশাপাশি সফর আছে নিউ জিল্যান্ড ও ভারতেও।
Published : 04 Nov 2024, 06:24 PM
প্রায় ১৩ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছে বাংলাদেশের মেয়েরা। এখনও পর্যন্ত ইংল্যান্ডে পা পড়েনি তাদের। অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ খেললেও কখনও দ্বিপাক্ষিক সিরিজের জন্য সফর করা হয়নি। সব অপেক্ষা শেষের বার্তা নিয়ে এসেছে আইসিসির নতুন ভবিষ্যৎ সফর সূচি (এফটিপি)। উইমেন’স এফটিপির নতুন চক্রে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড সফর আছে বাংলাদেশ দলের।
কদিন আগে আইসিসির সভায় চূড়ান্ত করা হয় ২০২৫ সালের মার্চ থেকে ২০২৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত নারীদের ভবিষ্যৎ সফর সূচি। আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রকাশ করা হয় সোমবার।
চার বছরের এই চক্রে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে দ্বিপাক্ষিক সিরিজে ২৭টি ওয়ানডে ও ৩০টি টি-টোয়েন্টি খেলবে বাংলাদেশ। এর বাইরে আইসিসি ও এসিসির টুর্নামেন্টগুলো তো আছেই। পাশাপাশি অন্য দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতায়ও আরও খেলা আয়োজন করার সুযোগ থাকবে বরাবরের মতোই।
টেস্ট মর্যাদা পেলেও নতুন ভবিষ্যৎ সফর সূচিতেও কোনো টেস্ট ম্যাচ নেই বাংলাদেশের। দেশের মেয়েদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটই এখনও চালু করতে পারেনি বিসিবি।
বর্তমান চক্রে আর দুটি সিরিজ বাকি আছে বাংলাদেশের। এই মাসের শেষে দেশের মাঠে তিনটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। রোববার এই সিরিজের সূচি ঘোষণা করেছে বিসিবি।
এরপর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে তিনটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাবেন নিগার সুলতানা, নাহিদা আক্তার, রিতু মনিরা। বিশ্ব আসরে আগে মুখোমুখি হলেও ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হবে এটি।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম দ্বিপাক্ষিক সিরিজটি এই বছরই বাংলাদেশ খেলেছে দেশের মাঠে। প্রথমবার অস্ট্রেলিয়া সফরে যাবেন তারা ২০২৬ সালের অক্টোবরে, প্রথমবার ইংল্যান্ড সফরে ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বরে।
এছাড়াও আগামী বছরের ডিসেম্বরে ভারত সফরে যাবে বাংলাদেশ, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে আছে নিউ জিল্যান্ড সফর, ২০২৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে পাকিস্তান সফর। প্রতিটি সফরেই আছে তিনটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ম্যাচ।
এই চক্রে দেশের মাঠে আয়ারল্যান্ড ছাড়াও বাংলাদেশ খেলবে শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, নিউ জিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এর মধ্যে নিউ জিল্যান্ড খেলবে শুধু তিনটি টি-টোয়েন্টি। অন্য সিরিজগুলোয় তিনটি করে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি।
কতটা তৈরি বাংলাদেশ
একটা সময় আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য হাপিত্যেশ করতে হতো বাংলাদেশকে। সেই দিনগুলি এখন অতীত হয়ে গেছে উইমেন’স চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ হওয়ার পর এবং ভবিষ্যৎ সফর সূচি তৈরি হওয়ায়। এখন খেলা প্রচুর। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলিতেও সফর থাকছে সামনে। এতে অফুরান সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি থাকছে কিছুটা শঙ্কাও। এই চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য কতটা তৈরি বাংলাদেশ?
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে আশার বার্তা খুব একটা নেই। কিছুদিন আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়টি ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোয় খুব বাজে ছিল নিগার সুলতানার দলের পারফরম্যান্স।
সামনে অপেক্ষায় আরও কঠিন সব পরীক্ষা। সেই আঁচ ঠিকই টের পাচ্ছেন বিসিবির নারী বিভাগের প্রধান হাবিবুল বাশার। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বললেন, স্রেফ সূচি দেখে উচ্ছ্বসিত হচ্ছেন না তিনি।
“আপাতত আমাদের ভাবনায় আছে সামনের ছয়টি ওয়ানডে, আয়ারল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। বিশ্বকাপ কোয়ালিফিকেশনের জন্য ম্যাচগুলিতে ভালো করা খুব জরুরি।”
“এফটিপিও আমি দেখেছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের কথা তো জানাই ছিল। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে সফর আছে, ভারত-নিউ জিল্যান্ডেও আছে। আমাদের মেয়েদের জন্য এটা সুখবর যে অনেক খেলা আছে এবং বড় বড় দেশগুলিতে খেলা। তবে শুধু সফর করে তো লাভ নেই। পারফর্ম করতে হবে, সফরগুলি অর্থবহ করতে হবে। সেটা আমাদের জন্য হবে বড় চ্যালেঞ্জ।”
বাংলাদেশ দলের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সে হতাশাটা হাবিবুলের কথায় ফুটে উঠল স্পষ্ট। সবশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেও তার উপলব্ধি, বৈশ্বিক মানদণ্ডে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।
“অন্য দলগুলির সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবধান ক্রমেই বাড়ছে। এবারের বিশ্বকাপেও তা বোঝা গেছে আরও ভালোভাবে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ডের মতো দলগুলি তো বটেই, ভারত- দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাও বেশ ওপরে। গত দুই বছরের মেয়েদের ক্রিকেট অনেক বদলে গেছে।”
“একটা ছোট্ট উদাহরণ দেই। রিভার্স সুইপ তো এখন খুব সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। সব দলই খেলে। আমাদের মেয়েরা কজন এটা ভালো খেলতে পারে? ওই দলগুলি এখন অনেক আধুনিক ক্রিকেট খেলছে। ওভার দা টপ খেলে, পাওয়ার ক্রিকেট খেলে, ইম্প্রোভাইজেশন করে অনেক। আমরা এখনও আগের ঘরানাতেই খেলছি। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবধান বাড়তেই থাকবে।”
সেই ব্যবধান কমানো বা খেলার ধরনের পরিবর্তন আনার সম্ভাব্য কিছু পথও বললেন নারী দলের প্রধান।
“অবশ্যই স্কিল লেভেল বাড়াতে হবে। কোচদের সঙ্গে স্পেশালাইজড কাজ করতে হবে। পাশাপাশি স্ট্রেংথ বাড়ানোর জন্য ট্রেনারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মেয়েরা দারুণ অ্যাথলেট। আমাদের মেয়েদের ফিটনেস লেভেল অনেক বাড়াতে হবে।”
“দ্বিতীয় ব্যাপার হলো, ক্রিকেটার পুল বাড়াতে হবে। খুব ভালো একটা ‘এ’ দল লাগবে। মানসম্পন্ন ক্রিকেটারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। নইলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারব না। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারতের মতো দেশগুলিতে গত কয়েক বছরে মেয়েদের ক্রিকেটের অবকাঠামোও অনেকটা ছেলেদের মতো হয়ে গেছে। সারা বছর নানা প্রোগ্রাম থাকে। বাংলাদেশে অতটা সম্ভব না হলেও যতটা সম্ভব, তা চেষ্টা করতে হবে।”
বাংলাদেশের মূল সমস্যাগুলোর একটি নতুন প্রতিভার ঘাটতি। অনেক বছর ধরে খেলেও অভিজ্ঞ অনেক ক্রিকেটার ধারাবাহিক নন মোটেও। তার পরও জাতীয় দলে তাদেরকে নিতে হচ্ছে যথেষ্ট বিকল্প না থাকায়। ঘরোয়া ক্রিকেটের পর্যাপ্ত খেলা না থাকাতেই নতুন প্রতিভা উঠে আসছে না। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ও জাতীয় লিগ ছাড়া আর কোনো শীর্ষ পর্যায়ের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট নেই। জাতীয় লিগও আবার নিয়মিত হয় না।
ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলা বাড়ানোর কিছু পরিকল্পনার কথা বললেন হাবিবুল বাশার।
“ঘরোয়া ক্রিকেটে আরও দুটি টুর্নামেন্ট বাড়ানোর চেষ্টা করছি আমরা। আশা করি তা পারব। মূল ঘরোয়া টুর্নামেন্ট ঢাকা লিগ হয় সাধারণত মে-জুন মাসে। বৃষ্টি হয় তখন। এবার ফেব্রুয়ারিতে করার চেষ্টা করছি। অনূর্ধ্ব-১৮ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চালুর ভাবনা আছে আমাদের। পরিকল্পনা তো আরও অনেক করা যায়। কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতাও কম নয়।”
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট এখনও পর্যন্ত মূলত চলছে ঢাকা কেন্দ্রিক। সারা দেশে খেলা ছড়িয়ে দিতে বিসিবির তেমন কোনো উদ্যোগও চোখে পড়ে না।
হাবিবুল সেটা মেনে নিয়েই বললেন, অন্তত জেলা পর্যায়ে কিছু করা খুব জরুরি।
“ঢাকার বাইরে তো লিগ বলে কিছু নেই। অন্তত দু-একটি জেলায় যদি লিগ চালু করা যায়, তাহলে আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। শ্রীলঙ্কায় ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক খেলা হয়। মেয়েদের স্কুল ক্রিকেটে দুইশ স্কুল খেলে। আমাদের এখানে তো স্কুলগুলিতে মেয়েদের ক্রিকেট হয়ই না। আপাতত জেলার কোচ ও ট্রেনারদের যদি মেয়েদের ক্রিকেটে সম্পৃক্ত করা যায়, তাহলে ধীরে ধীরে ক্রিকেটার বেরিয়ে আসতে পারে। এভাবে ছোট ছোট পদক্ষেপ নিলেও কাজ হতে পারে।”
নারী ক্রিকেটারদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে বড় একটি পদক্ষেপ চূড়ান্ত হয়ে গেছে বলেই জানালেন বিসিবির নারী বিভাগের প্রধান।
“চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটারের সংখ্যা আমরা অনেক বাড়াচ্ছি। ছেলেদের ক্রিকেটে যেমন কেন্দ্রীয় চুক্তির বাইরেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটারদের চুক্তি আছে, মেয়েদের ক্রিকেটেও তেমন কিছু করতে যাচ্ছি আমরা। আশা করি এতে অনেক বেশি সংখ্যক মেয়ে ক্রিকেটে আসতে ও ক্যারিয়ার গড়তে উৎসাহী হবে।”
নারী ক্রিকেটে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে। কিন্তু টেস্ট খেলার কাছাকাছিও নেই এখনও। আগামী অনেক দিন অন্তত সেই সম্ভাবনা নেই বলে নিশ্চিত করলেন হাবিবুল।
“টেস্ট খেলতে হলে আগে দুই বছর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে হবে দেশে। আমরা তো এখনও মেয়েদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চালু করতে পারিনি। আগামী বছর আশা করি এটা আমরা শুরু করতে পারব। দুই মৌসুম খেলার পর অবস্থা বুঝে বিবেচনা করা যাবে।”