নাটকীয়তা ছড়ানো ম্যাচে শেখ মেহেদির অলরাউন্ড নৈপুণ্য ও বোলারদের দারুণ পারফরম্যান্সে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সিরিজে এগিয়ে বাংলাদেশ।
Published : 16 Dec 2024, 10:24 AM
সেন্ট ভিনসেন্টে ম্যাচটি ১৫ ডিসেম্বর রাতে হলেও বাংলাদেশে ১৬ ডিসেম্বর সকাল। বাংলাদেশের জয় যখন মনে হচ্ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার, টিভি ধারাভাষ্যে সাবেক ক্যারিবিয়ান স্পিনার স্যামুয়েল বাদ্রি বললেন, “বাংলাদেশে আজকে বিশেষ দিন… বিজয় দিবস। তাদের ক্রিকেটাররাও খেলছে বিজয়ীর মতো, অদম্য চেতনায়….।” পরের দিকে অবশ্য দারুণ নাটকীয়তা ছড়িয়ে জমে উঠল ম্যাচ। তবে শেষ পর্যন্ত অদম্য মানসিকতার ছাপ রেখেই ম্যাচ জিতে নিল বাংলাদেশ।
শেষ ওভারের রোমাঞ্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭ রানে হারিয়ে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
সেন্ট ভিনসেন্টের আর্নস ভেল স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ২০ ওভারে তোলে ১৪৭ রান। ক্যারিবিয়ানদের ইনিংস শেষ হয় এক বল বাকি থাকতে ১৪০ রানে।
এক পর্যায়ে ৬১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে বড় পরাজয়ের দুয়ারে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু রভম্যান পাওয়েল ও রোমারিও শেফার্ডের আগ্রাসী জুটি বদলে দেয় ম্যাচের চিত্র। ম্যাচ প্রায় মুঠোয় পুরে ফেলেন তারা দুজন। শেষ ১৮ বলে প্রয়োজন পড়ে মাত্র ২০ রানের।
এরপর আবার বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। শেফার্ডকে ফিরিয়ে জুটি ভাঙেন তাসকিন আহমেদ। রানের গতি আসে কমে। শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দরকার পড়ে ১০ রানের। স্নায়ুর চাপ সামলে অসাধারণ বোলিং উপহার দেন হাসান। ওভারের তৃতীয় বলে এই পেসার ফিরিয়ে দেন বিধ্বংসী ইনিংস খেলা ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক পাওয়েলকে। পঞ্চম বলে আলজারি জোসেফকে বোল্ড করে দলকে এনে দেন তিনি দারুণ এক জয়।
শেষের নায়ক হাসান হলেও ম্যাচের নায়ক শেখ মেহেদি হাসান। ব্যাট হাতে ২৪ বলে তার ২৬ রানের অপরাজিত ইনিংসটা ছিল প্রশ্ন জাগানিয়া। আরেকটু দ্রুততায় তো খেলতে পারতেন! পরে বল হাতে তা পুষিয়ে দেন পুরোপুরি। ক্যারিবিয়ান টপ ও মিডল অর্ডারে ছোবল দিয়ে চার ওভারে ১৩ রান দিয়ে তিনি শিকার করেন চার উইকেট।
ছোট ছোট অবদান ছিল আরও কয়েকজনের। ব্যাটিংয়ে যেমন ইনিংসের শুরুতে দলকে টানেন সৌম্য সরকার। শেষ দিকে দারুণ এক ক্যামিও খেলেন শামীম হোসেন। তবে জয় ধরা দেয় মূলত বোলিং পারফরম্যান্সেই।
তানজিম হাসান ছাড়া বাংলাদেশের বোলিং গ্রুপের সবাই ভালো বোলিং করেন। এমনকি ১৯তম ওভারে একটি চারের পরও কেবল আট রান দিয়ে কিছুটা অবদান রাখেন তানজিমও। আলাদা করে বলতে হবে লিটন কুমার দাসের অধিনায়কত্বের কথাও। বেশ তৎপর ছিলেন তিনি মাঠে।
পুঁজি খুব বড় না হলেও রান তাড়ার শুরুতেই ক্যারিবিয়ানদের চেপে ধরে বাংলাদেশের বোলাররা। দারুণ প্রথম ওভারে কেবল এক রান দেন হাসান মাহমুদ। তাসকিন আহমেদ বোলিংয়ে এসে প্রথম বলেই বিদায় করেন ব্র্যান্ডন কিংকে। পরের ওভারে শেখ মেহেদির বলে স্টাম্পড বিপজ্জনক নিকোলাস পুরান।
তিন ওভার শেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান দুই উইকেটে তিন!
পরের ওভারে প্রবল প্রতিআক্রমণ চালান জনসন চার্লস। ওয়াইড বলে বাই চারে ওভারের শুরু করেন তানজিম হাসান। পরে টানা দুটি ছক্কা ও একটি চার মারেন বিপিএলের নিয়মিত পারফরমার চার্লস। ওভার থেকে আসে ২৫ রান।
তবে পরের ওভারে একটি চার মেরেই শেষ তার অভিযান। তাকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে স্বস্তি দেন শেখ মেহেদি।
পাওয়ার প্লেতে ক্যারিবিয়ানরা তোলে ৩ উইকেটে ৩৬ রান।
পাওয়ার প্লে শেষে তাদের বিপদ বাড়ে আরও। তিন বলের মধ্যে শেখ মেহেদি ফিরিয়ে দেন আন্দ্রে ফ্লেচার (০) ও রোস্টন চেইসকে (১৩ বলে ৭)।
৩৮ রানে ৫ উইকেট হারানো ক্যারিবিয়ানরা পরে খাদের কিনারায় চলে যায় গুডাকশ মোটি ও আকিল হোসেনকে হারিয়ে।
দ্বাদশ ওভারে ৭ উইকেটে ৬১ রানে পরিণত হওয়া দলের অপেক্ষায় তখন বড় পরাজয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি পাওয়েল ও শেফার্ড। অষ্টম উইকেটে ৩৩ বলে ৬৭ রান যোগ করেন দুজন।
ত্রয়োদশ ওভারে রিশাদ হোসেনের ওভারে তিন বাউন্ডারিতে তাদের ঝড়ের শুরু। পরের ওভারে তাসকিনকে তিন ছক্কা মারেন পাওয়েল। তানজিমের করা পরের ওভার থেকে আসে ১২ রান। তিন ওভারেই ৫০ রান তুলে ম্যাচ জমিয়ে দেন দুজন। তবে শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি তারা।
তাসকিনের শর্ট বলে পুল করে সীমানায় ধরা পড়েন শেফার্ড (১৭ বলে ২২)। ওই ওভারে কেবল দুই রান দেন অভিজ্ঞ এই পেসার। পরের ওভারে আলজারি জোসেফ একটি বাউন্ডারি পান ব্যাটের কানায় লেগে। পরের চার বলে তিন রান দিয়ে তবু ওভারটি ভালোভাবে শেষ করে তানজিম।
শেষ ওভারে হাসান নিখুঁতভাবে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে পাওয়েলের রেঞ্জের বাইরে রাখেন বল। বাইরের বল তাড়া করেই আউট হন পাওয়েল (৩৫ বলে ৬০)। এক বল পর জোসেফের স্টাম্প এলোমেলো করে ম্যাচের শেষটাও করেন হাসান।
ম্যাচের প্রথম ভাগে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে নামে টস হেরে। প্রথম দুই ওভারে দুই ওপেনারের দুটি বাউন্ডারিতে শুরু হয় ম্যাচ। দুই ওভারে ১৫ রানের পর উল্টো যাত্রার শুরু। আকিল হোসেনের বল পুল করার চেষ্টায় বোল্ড তানজিদ হাসান (১১ বলে ৬)। পরের বলেই ফিরতি ক্যাচ দিয়ে বসেন অধিনায়ক লিটন কুমার দাস।
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এই নিয়ে ষষ্ঠবার শূন্যতে ফিরলেন লিটন।
প্রথম পাঁচ ওভারে ২১ রানের পর পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে রোস্টন চেইসকে একটি করে চার মারেন সৌম্য সরকার ও আফিফ হোসেন। তবে ওই ওভারেই রিভার্স সুইপ খেলে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন আফিফ (১১ বলে ৮)।
পাওয়ার প্লেতে ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ তোলে ৩২ রান।
জাকের আলি ব্যাটিংয়ে নামার একটু পর ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কায় ওড়ান চেইসকে। পরের ওভারে চোখধাঁধানো শটে রোমারিও শেফার্ডের বল স্টেডিয়ামের বাইরে পাঠান সৌম্য। টানা দু বলে তিনি ছক্কা মারেন গুডাকেশ মোটি আক্রমণে আসার পর।
এই দুজনের জুটি বিপদ থেকে টেনে তোলে দলকে।
তবে জুটি পোক্ত হওয়ার পর দুজনের কাছেই যখন দলের দাবি বড় কিছুর, মেটাতে পারেননি কেউই। শেফার্ডকে বিশাল এক ছক্কা মারার এক বল পর আরেকটি ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় রভম্যান পাওয়েলের দারুণ ক্যাচে পরিণত হন জাকের (২৭ বলে ২৭)। জুটি থামে ৪২ বলে ৫৭ রানে।
সৌম্যর ইনিংস থামে ওবেড ম্যাককয়ের স্লোয়ার কাটারে বোল্ড হয়ে। দুই চার ও তিন ছক্কায় ৩২ বলে ৪৩ রান করেন তিনি। ম্যাচের প্রেক্ষাপটে ইনিংসটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও টি-টোয়েন্টিতে তার ফিফটিবিহীন যাত্রা পৌঁছে গেল টানা ২৯ ইনিংসে।
ঘরের মাঠে ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ম্যাককয় পূরণ করেন ৫০তম টি-টোয়েন্টি উইকেট।
বাংলাদেশের ইনিংসের হাল বদলে দেওয়া জুটি আসে এরপরই। শামীম হোসেন ও শেখ মেহেদি যোগ করেন ২৯ বলে ৪৯ রান। সেখানে মূল অবদান শামীমের। তার ব্যাট থেকে আসে ১৩ বলে ২৭।
ক্রিজে গিয়ে দ্বিতীয় বলেই আলজারি জোসেফের শর্ট বলে ছক্কা মারেন শামীম। যদিও ব্যাটের কানায় লেগে কিপারের ওপর দিয়ে বল সীমানা পেরোয়, তবে ব্যাটসম্যানের ব্যাট স্পিডেরও বড় ভূমিকা ছিল সেটিতে। পরে ম্যাককয় ও জোসেফকে ছক্কা মারেন তিনি দারুণ দুটি শটে।
শেখ মেহেদি ততটা ঝড় তুলতে পারছিলেন না। তবে শেষ ওভারে ইনসাইড আউট শটে ম্যাককয়কে ছক্কায় ওড়ান তিনিও। বাংলাদেশ পৌঁছে যায় দেড়শর কাছে।
রানটাকে তখন একটু কম বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু বিজয় দিবসের সকালে শেষ পর্যন্ত হারেনি বাংলাদেশ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৪৭/৬ (তানজিদ ৬, সৌম্য ৪৩, লিটন ০, আফিফ ৮, জাকের ২৭, মেহেদি ২৬*, শামীম ২৭, রিশাদ ২*; আকিল ৪-১-১৩-২, ম্যাককয় ৪-০-৩০-২, জোসেফ ৪-০-২৬-০, চেইস ৪-০-২৯-১, শেফার্ড ৩-০-৩৩-১, মোটি ১-০-১৫-০)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৯.৫ ওভারে ১৪০ (কিং ১, চার্লস ২০, পুরান ১, চেইস ৭, ফ্লেচার ০, পাওয়েল ৬০, মোটি ৬, আকিল ২, শেফার্ড ২২, জোসেফ ৯, ম্যাককয় ০*; হাসান ৩.৫-০-১৮-২, তাসকিন ৪-০-২৮-২, শেখ মেহেদি ৪-০-১৩-৪, তানজিম ৪-০-৪৭-১, রিশাদ ৪-০-৩২-১)
ফল: বাংলাদেশ ৭ রানে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে।
ম্যান অব দা ম্যাচ: শেখ মেহেদি হাসান।