বিপর্যয়ের মধ্যে অসাধারণ সেঞ্চুরি করলেও একটুর জন্য দলকে জেতাতে পারেননি নুরুল হাসান সোহান, স্বীকৃত ক্রিকেটে ৪৫৮ ম্যাচের ক্যারিয়ারে প্রথমবার ৪ উইকেটের স্বাদ পেলেন মুমিনুল হক।
Published : 21 Mar 2025, 06:03 PM
টানা দুই বলে ছক্কায় সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন নুরুল হাসান সোহান। কিন্তু ব্যাট উঁচিয়ে ধরলেন না ব্যাট। মুখে ফুটে উঠল না হাসির রেখা। দেখা গেল না কোনো উদযাপন। জয় থেকে যে তখনও ২৪ রান দূরে ধানমন্ডি স্পোর্টস ক্লাব! দলকে দলকে জেতানোর প্রতিজ্ঞাই হয়তো ছিল অধিনায়কের। কিন্তু পারলেন না তিনি। টানা তৃতীয় ছক্কার চেষ্টায় ধরা পড়ে গেলেন সীমানায়। বীরোচিত ইনিংস খেলেও শেষ পর্যন্ত মাঠ ছাড়তে হলো তাকে হতাশায়।
সোহানের বিদায়েই শেষ হয় ম্যাচ। বড় পুঁজি না পেলেও দারুণ এক জয় পায় তামিম ইকবালের মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শুক্রবার আরেক ম্যাচে বল হাতে চমকে দেন মুমিনুল হক। এমনিতে বোলিং তিনি প্রায়ই করেন, উইকেটও পান মাঝেমধ্যেই। তবে এবার তিনি খানিকটা চমকেই দিলেন। স্বীকৃত ক্রিকেটে ৪৫৮ ম্যাচের ক্যারিয়ারে প্রথমবার পেলেন চার উইকেটের স্বাদ।
পরেও ব্যাটিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে আবাহনী লিমিটেডকে জেতালেন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার।
সোহানকে থামিয়ে মোহামেডানের জয়
মিরপুর শের-ই বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে লড়াইটটা ছিল যেন সোহান বনাম মোহামেডান। ২১৭ রানের পুঁজি নিয়েও দারুণ বোলিংয়ে জয়ের পথ দ্রুতই তৈরি করে নেয় তারা। কিন্তু প্রবল প্রতিরোধে বাধা হয়ে দাঁড়ান সোহান। বলতে গেলে একার লড়াইয়ে জিইয়ে রাখেন ধানমন্ডির জয়ের আশা। ৯২ বলে সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়েই শেষ পর্যন্ত ২৩ রানের জয় পায় মোহামেডান।
সাত ম্যাচে মোহামেডানের এটি পঞ্চম জয়। সমান ম্যাচে ধানমন্ডির জয় তিনটি।
মিরপুরে মেঘাচ্ছন্ন গুমোট দিনে দুই দলের বোলাররাই পেয়েছেন বাড়তি সুবিধা। ব্যাটিংয়ের জন্য বেশ কন্ডিশন ছিল বেশ কঠিন। বিশেষ করে সকালে বোলারদের জন্য সহায়তা ছিল যথেষ্টই।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে রানের জন্য ভুগতে হয় তামিম ইকবাল ও রনি তালুকদার। তবে পিচের আচরণ বুঝে উইকেট ধরে রাখায় মন দেন দুজনই। দল তাতে পায় মোটামুটি ভালো ভিত। প্রথম ১০ ওভারে কেবল ৩১ রান এলেও উইকেট পড়েনি।
তবে মাসুম খান টুটুল এক পর্যাঁয়ে আঁটসাঁট বোলিং করে আটকে রাখেন দুই ব্যাটসম্যানকে। ধৈর্য হারিয়ে সানজামুল ইসলামকে রিভার্স সুইপ খেলে ক্যাচ দেন তামিম। ২৬ রান করতে তিনি খেলেন ৫৩ বল।
আরেক ওপেনার রনির ব্যাট থেকে আসে ৬৪ বলে ৩৯ রান। তিন নম্বরে মাহিদুলও রানের চাকায় হাওয়া দিতে পারেননি। ৪৪ রান করতে তিনি খেলেন ৭৭ বল।
দ্রুত রান তোলার তাগিদেই হয়তো সাইফ উদ্দিনকে চার নম্বরে নামায় মোহামেডান। লাভ হয়নি কোনো। খালি হাতে ফেরেন সাইফ।
আরও একবার হতাশ করেন মুশফিকুর রহিম। দলের বিপদের সময়ে স্লগ সুইপ খেলার লোভ সংবরণ করতে পারেননি অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান (৬)। লিগের পাঁচ ইনিংসে কোনো ফিফটি নেই তার।
ছয় নম্বরে নেমে পরিস্থিতির দাবি কিছুটা মেটাতে পারেন তাওহিদ হৃদয়। ৫ চারে ৪৭ বলে ৫৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি। এর সঙ্গে মেহেদী হাসান মিরাজ ২৪ বলে ২৬ ও আবু হায়দারের ১৩ বলে ১৮ রানের সৌজন্যে দুইশ পেরোয় মোহামেডান।
ধানমন্ডির রান তাড়ায় শুরুতে ঝড় তোলেন হাবিবুর রহমান। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। পঞ্চম ওভারে ড্রেসিং রুমে ফেরার আগে ৩ চার ও ২ ছক্কায় মাত্র ১৬ বলে ৩১ রান করেন তিনি।
চমক দিয়ে হাবিবুরের সঙ্গে সানজামুল ইসলামকে ওপেনিংয়ে নামায় ধানমন্ডি। তবে কাজে লাগেনি তা। তিন নম্বরে নামা ফজলে মাহমুদও ফেরেন দ্রুতই।
চার নম্বরে নেমে একপ্রান্ত ধরে রাখেন সোহান। ইয়াসির আলি, মইন খান, জিয়াউর রহমানও হতাশ করলে ৭৯ রানের মধ্যে ৬ উইকেট হারায় তারা।
সপ্তম উইকেটে মাসুম খানের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়েন ধানমন্ডি অধিনায়ক। দুজন মিলে যোগ করেন ৩৮ রান। ১৮ রান করা মাসুমের বিদায়ের পর দলের পুরো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেন সোহান।
তখনও জয় থেকে একশ রান দূরে ধানমন্ডি আর সোহান অপরাজিত ৪৩ রানে। দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ৫৫ বলে ফিফটি করেন তিনি। পরে লোয়ার অর্ডারদের নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। তবে কাউকে লম্বা সময় সঙ্গী পাননি।
শেষ ব্যাটসম্যান ক্রিজে যাওয়ার পর নিজের করণীয় বুঝে নেন সোহান। ৮৮ থেকে সাইফের টানা দুই বলে কাভারের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে পৌঁছে যান শতরানে। তার লিস্ট 'এ' ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ ও এবারের লিগে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি এটি।
বাকি পথটুকুর জন্যও বড় শটকেই বেছে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু টানা তৃতীয় ছক্কা আর হয়নি। সীমানায় তার ক্যাচ নেন হৃদয়, বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে ওঠেন বোলার সাইফ ও সতীর্থরা।
ম্যাচ-সেরা যদিও তিনিই। তবে ম্যাচের পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে ম্লান মুখে বললেন, “সবসময়ই বলি, আমার কাছে সবকিছুর ওপর দলে। দল জিতলে ভালো লাগত। যেহেতু দলকে জেতাতে পারিনি, এই সেঞ্চুরির কোনো মূল্য নেই আমার কাছে। এটা নিয়ে কথা বলারও কিছু নেই।”
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব: ৫০ ওভারে ২১৬/৬ (রনি ৩৯, তামিম ২৬, মাহিদুল ৪৪, সাইফ ০, মুশফিক ৬, হৃদয় ৫৩*, মিরাজ ২৬, আবু হায়দার ১৮*; এনামুল ৬-২-১৭-০, মইন ৫-০-১৭-০, কামরুল ১০-০-৫৪-৩, মুরাদ ১০-০-৩১-২, মাসুম ৯-১-৫১-০, সানজামুল ১০-০-৪৫-১)।
ধানমন্ডি স্পোর্টস ক্লাব: ৪৩.৩ ওভারে ১৯৩ (হাবিবুর ৩১, সানজামুল ৭, ফজলে মাহমুদ ০, ইয়াসির ১৪, সোহান ১০০, মইন ০, জিয়া ২, মাসুম ১৮, এন্মাউল ৯, মুরাদ ৫, কামরুল ০*; তাসকিন ৭-০-৫০-২, তাইজুল ১০-১-৪০-২, নাসুম ১০-০-৩১-১, আবু হায়দার ৩-১-১৪-১, সাইফ ৪.৩-০-৩৪-৩, মিরাজ ৯-০-২৪-১))
ফল: মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ২৩ রানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: নুরুল হাসান সোহান
মুমিনুল-মিঠুনের নৈপুণ্যে শীর্ষে আবাহনী
বোলিংয়ের কারণে ম্যান অব দা ম্যাচ হবেন, মুমিনুল হক কি ভাবতে পেরেছিলেন! ব্যাট হাতেও অবশ্য ছোট্ট একটি কার্যকর ইনিংস খেলেছেন। তবে আসল কাজ করেছেন বল হাতেই।
তার অলরাউন্ড নৈপুণ্যের পাশাপাশি মোহাম্মদ মিঠুনের দারুণ ইনিংস জয় এনে দেয় আবাহনী লিমিটেডকে।
বিকেএসপির ৪ নম্বর মাঠে ৩৬ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্সকে ২ উইকেটে হারায় আবাহনী। ২০০ রানের লক্ষ্য ৬ বল বাকি থাকতে ছুঁয়ে ফেলে বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা। এক পর্যায়ে যদিও আরও সহজ জয়ের পথে ছিল তারা। শেষ দিকে দ্রুত কয়েকটি উইকেট হারিয়ে কমে যায় ব্যবধান
সাত ম্যাচে ছয় জয় নিয়ে শীর্ষস্থান আরও পোক্ত করল আবাহনী। হার দিয়ে যাত্রা শুরুর পর টানা পাঁচ ম্যাচ জিতেছিল গাজী গ্রুপ। তাদের এটি দ্বিতীয় পরাজয়।
উইকেট ভেজা থাকায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর শুরু হয় খেলা। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে ঝড় তোলেন এনামুল হক। ৭ ওভারের পাওয়ার প্লেতে ৫৯ রান করে গাজী গ্রুপ। পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার পর রানের জোয়ারে বাধ দিতে সক্ষম হয় আবাহনীর বোলাররা। এনামুলও গুটিয়ে যান।
একপর্যায়ে মাত্র ১৭ বলে ৩১ রান করে ফেলা এনামুল ফিফটি করতে খেলেন ৬৫ বল। অন্য প্রান্ত থেকে তেমন সহায়তাও অবশ্য তিনি পাননি।
পঞ্চম উইকেটে ওয়াসি সিদ্দিকির সঙ্গে গড়েন ইনিংসের সর্বোচ্চ ৫৭ রানের জুটি। মুমিনুলের বলে রিভার্স সুইপ করার চেষ্টায় পয়েন্টে ক্যাচ দেন এনামুল। ৬ চার ও ৩ ছক্কায় ৭৬ বলে করেন ৬৮ রান।
ওয়াসির ব্যাট থেকে আসে ৪২ রান। শেষ দিকে আব্দুল গাফফার সাকলাইন করেন ২৭ রান।
৬.১ ওভারে ৩৮ রানে ৪ উইকেট নেন মুমিনুল।
রান তাড়ায় প্রথম দুই ওভারে দুই ওপেনারের উইকেট হারায় আবাহনী। প্রথম ওভারে ছক্কা-চার মেরে ফেরেন জিসান আলম। পরের ওভারে ছক্কা মেরে অক্কা পান পারভেজ হোসেন।
শুরুর ধাক্কা সামলে তৃতীয় উইকেটে ১৩১ রানের জুটি গড়ে তোলেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও মোহাম্মদ মিঠুন। দুজনের ব্যাটে সহজ জয়ের পথেই এগোচ্ছিল আবাহনী। কিন্তু একই ওভারে দুজনের বিদায়ে রোমাঞ্চ জাগে ম্যাচে।
শান্ত ৬৩ বলে ৪৩ ও মিঠুন ৭৭ বলে ৭৬ রান করে ফেরেন। পরে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতও বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। পরের বলেই এসএম মেহেরব হাসানকে ফিরিয়ে গাজী গ্রুপের সম্ভাবনা জাগান শেখ পারভেজ রহমান।
দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে আবাহনীকে জয়ের কাছে নিয়ে যান মুমিনুল। কিন্তু ৫ রান বাকি থাকতে তিনিও আউট হয়ে যান। তবে বিপদ ঘটতে দেননি মাহফুজুর রহমান রাব্বি। ম্যাচ জিতিয়েই মাঠ ছাড়েন তরুণ অলরাউন্ডার।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
গাজী গ্রুপ ক্রিকেটার্স: ৩৫.১ ওভারে ১৯৯ (সাদিকুর ১৬, এনামুল ৬৮, শোভন ৯, তাহজিবুল ১, শামসুর ৬, ওয়াসি ৪২, তোফায়েল ০, সাকলাইন ২৭, হাশিম ৬, লিওন ১, পারভেজ ৭*; মেহেদি ২-০-১৯-০, মৃত্যুঞ্জয় ১-০-১৪-০, রকিবুল ৮-০-৪৮-২, মোসাদ্দেক ৭-১-১৮-২, রাব্বি ৭-০-২৪-২, মেহেরব ৪-০-২৬-০, মুমিনুল ৬.১-০-৩৮-৪)
আবাহনী লিমিটেড: ৩৫ ওভারে ২০০/৮ (জিসান ১০, পারভেজ ৬, শান্ত ৪৩, মিঠুন ৭৬, মোসাদ্দেক ১৮, মুমিনুল ২৪, মেহেরব ০, রাব্বি ৮*, রকিবুল ১, মৃত্যুঞ্জয় ১*; লিওন ৭-০-৪৫-২, পারভেজ ৮-০-৪৬-৩, হাশিম ৫-০-৩০-২, তোফায়েল ২-০-১১-০, শামসুর ২-০-৫-১, ওয়াসি ৬-০-৩২-০, সাকলাইন ৫-০-২২-০)
ফল: আবাহনী লিমিটেড ২ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মুমিনুল হক