সবশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজের দল থেকে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সামনের সিরিজে তিনটি পরিবর্তন আছে বাংলাদেশ দলে, সেগুলোর কারণ ব্যাখ্যা করলেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন।
Published : 02 Nov 2024, 01:18 PM
বাংলাদেশের ওয়ানডে দল ঘোষণার পর সামাজিক মাধ্যমে ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেছেন এনামুল হক। হাসি ও তালির ইমোজি দিয়েছেন তাইজুল ইসলাম। মুখ বন্ধ রাখার ইমোজি দেখিয়েছেন শেখ মেহেদি হাসান। দলে জায়গা না পেয়ে তাদের অসন্তুষ্টি স্পষ্টই। প্রথমবার ওয়ানডে দলে সুযোগ পাওয়া নাহিদ রানা ও দলে ফেরা নাসুম আহমেদ আবার সামাজিক মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন উচ্ছ্বাস, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন স্রষ্টার প্রতি।
যে কোনো দল ঘোষণাতেই এরকতম বিপরীতিমুখি অনুভূতির দোলাচল থাকেই। নির্বাচকদের কাছেও তেমনি থাকে ব্যাখ্যা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের পরিবর্তনগুলোর পর পেছনেও নিজেদের ভাবনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানালেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন।
বাংলাদেশ সবশেষ ওয়ানডে খেলেছে সাড়ে সাত মাস আগে। অনেকেরই হয়তো মনে নেই, সেই সিরিজে ম্যান অব দা সিরিজ হয়েছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সৌম্য সরকার খেলেছিলেন ৬৬ বলে ৬৮ রানের ইনিংস। শেষ ম্যাচে সৌম্য চোট পাওয়ায় তার কনকাশন বদলি হিসেবে নেমে তানজিদ হাসান ৮১ বলে করেছিলেন ৮৪।
সেই শেষ ওয়ানডেতেই একাদশে জায়গা পেয়েছিলেন এনামুল। আউট হয়ে গিয়েছিলেন ২২ বলে ১২ রান করে। ওই সিরিজে এক ম্যাচ খেলেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের দল থেকে বাদ পড়েছেন ৩১ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের ওই তৃতীয় ওয়ানডের দল দিয়েই গাজী আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে নতুন নির্বাচক কমিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। তিনি অবশ্য জানালেন, এনামুলের বাদ পড়ার কারণ স্রেফ ওই এক ম্যাচ নয়। বিস্তারিত তিনি খোলাসা করেননি, তবে বাদ পড়ার কারণগুলো এই ক্রিকেটারকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে জানালেন প্রধান নির্বাচক।
“বিজয় (এনামুল) আমাদের আলোচনায় অবশ্যই ছিল। তবে সবশেষ যে ওয়ানডে ম্যাচটি হয়েছে, এর ঠিক আগে আমরা দায়িত্ব নিয়েছি। একটা শর্টকাট দল তখন গড়তে হয়েছিল। এখন ব্যাপারটার ভিন্ন। ওই ম্যাচে বিজয়ের খেলা এবং তার আগের নানা সময়ের পারফরম্যান্স দেখে কিছু পর্যবেক্ষণ আমাদের আছে, যেগুলো বিজয়ের সঙ্গে কথা বলে তাকে খুব ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছি।”
“এসব আমরা নিজেদের ভেতরই রাখতে চাই। তবে দলে না থাকা মানেই ভাবনার বাইরে চলে যাওয়া নয়। বিজয় এমনিতেই ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর রান করে। আমরা যে ব্যাপারগুলি বলেছি, সেগুলোয় উন্নতি দেখলে অবশ্যই তার ফেরার সুযোগ সবসময় থাকবে। এমনকি সামনে টেস্টেও ওর জন্য সুযোগ আসতে পারে। পারফর্ম করে গেলে সব সম্ভাবনাই আছে। আমরা চাই না বিজয় বা কোনো ক্রিকেটার আশাহত হোক।”
ওই সিরিজে না থাকা জাকির ফিরেছেন এবারের দলে। ক্যারিয়ারে একটি ওয়ানডে খেলেছেন ২৬ বছর বয়সী ক্রিকেটার। গত বছর বিশ্বকাপের ঠিক আগে নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচে তিনি আউট হয়েছিলেন ১ রান করে। সাম্প্রতিক সময়ে টেস্টে তার পারফরম্যান্স ভালো নয় মোটেও। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সদ্যসমাপ্ত চট্টগ্রাম টেস্টে তো দুই ইনিংসেই আউট হয়েছেন দৃষ্টিকটূ শটে।
আপাত চোখে মনে হতে পারে, এনামুলের জায়গাটি নিয়েছেন জাকির। তবে প্রধান নির্বাচক বললেন ভিন্ন কথা।
“বিজয়ের সঙ্গে আসলের জাকিরের লড়াইটা হয়নি। টপ অর্ডারে সৌম্য, তানজিদ এমনিতেই আছে। জাকির টেস্টে স্ট্রাগল করছে, এটা সত্যি। তবে ওয়ানডেতে ওকে আমরা পরিস্থিতির কারণেই নিয়েছি। এখানে জয় (মাহমুদুল হাসান) আসতে পারত। তবে ঢাকা লিগে জাকিরের রান, তার আগ্রাসন, সব বিবেচনায় নিয়ে একটা বিকল্প হিসেবে তাকে আমরা নিয়েছি। পাশাপাশি চেয়েছি যে, একজন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান থাকুক, প্রয়োজনে যে কিপিং করতে পারে।”
গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রায় ৫৫ গড় ও ৯৪ স্ট্রাইক রেটে ৫৪৯ রান করেছিলেন জাকির। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ১১৮ ম্যাচ খেলে ৪ সেঞ্চুরিতে ৩ হাজার ৩৫২ ররান করেছেন তিনি ৩২.৫৪ গড় ও ৮২.৫৪ স্ট্রাইক রেটে।
পেস আক্রমণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হাসান মাহমুদকে বাইরে রেখে নাহিদ রানাকে সুযোগ দেওয়া। প্রধান নির্বাচক জানালেন, হাসানকে মূলত বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। ফাস্ট বোলার নাহিদকে নেওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু ভাবনা থেকে।
“হাসান বাদ পড়েছে বলা যাবে না। তার ওয়ার্কলোডের কারণে বাইরে রাখা হয়েছে। আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন সে। তাকে সাবধানে সামলাতে হবে।”
“পাশপাশি আফগানিস্তানের বিপক্ষে আমরা নাহিদ রানাকে একটু দেখতে চেয়েছি। ওর গতি আছে, আগ্রাসন আছে। ব্যাটসম্যানকে চমকে দেওয়ার সামর্থ্য আছে। এতদিন শুধু টেস্ট ম্যাচ খেলেছে। তবে আস্তে আস্তে ওকে একদিনের ম্যাচের জন্য আমরা তৈরি করতে চাই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের পর আমাদের টেস্ট ম্যাচ অনেক দিন আর নেই। সামনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি আছে। সম্প্রতি আমরা ভারতের মায়াঙ্ক ইয়াদাভকে দেখেছি, পেস দিয়ে কতটা কার্যকর হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, এই সিরিজটায় নাহিদকে পরখ করে দেখতে পারি।”
গত আড়াই মাসে পাকিস্তানে, ভারতে ও দেশের মাঠে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে মিলিয়ে ছয় টেস্টের সবকটিতে খেলেছেন হাসান। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের ঠিক পরই ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ।
গতির ঝড় তুলে আলোচনায় আসা নাহিদ খেলেছেন এই ছয় টেস্টের চারটিতে। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তার সূচনাটা দারুণ হয়েছে। ১০ ম্যাচে ২৬ উইকেট নিয়েছেন ২২ বছর বয়সী ফাস্ট বোলার, ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২ বার।
উল্লেখযোগ্য একটি পরিবর্তন আছে স্পিন আক্রমণেও। বাঁহাতি স্পিনার তাইজুল ইসলামকে বাদ দিয়ে ফেরানো হয়েছেন আরেক বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদকে।
সবশেষ শ্রীলঙ্কা সিরিজে দুটি ম্যাচ খেলে তাইজুল একটি উইকেট নিতে পেরেছিলেন ওভারপ্রতি প্রায় সাড়ে সাত করে রান দিয়ে। তবে স্রেফ পারফরম্যান্সই নয়, তাকে না নেওয়ার পেছনে অন্য ভাবনার কথাও বললেন প্রধান নির্বাচক।
“তবে আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছি, সাকিব যেহেতু টেস্টে নেই, তাইজুল আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই ফরম্যাটে। ওয়ানডেতেও সে ভালো করতে পারে, কিন্তু টেস্টে আমাদের জন্য বেশি জরুরি সে। তাকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে আমাদের।”
নাসুম সবশেষ ওয়ানডে খেলেছেন গত বছর বিশ্বকাপে। ভারতে সেই আসরে তিন ম্যাচ খেলে উইকেটশূন্য ছিলেন তিনি ওভারপ্রতি সাতের বেশি রান দিয়ে। তবে বাংলাদেশ টাইগার্সের ক্যাম্পে নাসুমের মধ্যে উন্নতির ছাপ ও ভালো করার তাড়না চোখে পড়েছে নির্বাচকদের।
“আমাদের মনে হয়েছে, নাসুমকে আবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। নাসুম অনেক দিন জাতীয় দলে নেই। গত বিশ্বকাপে (ওয়ানডে) খুব একটা ভালো করেনি। তবে অনেক পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আমাদের টাইগার্স পোগ্রামে অনেক খেটেছে। আমরা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণও করেছি। দিনের পর দিন সুযোগ না পেলে আশাহত হয়ে যেতে পারে। আমরা ভেবেছি, আরেকটা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারি।”
গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও নাসুমের পারফরম্যান্স ছিল ভালো। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে ওভারপ্রতি চারের কম রান দিয়ে ২৪ উইকেট নিয়ে তিনি ছিলেন আসরের পঞ্চম সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।
তাইজুল-নাসুমের সঙ্গে আরেক বাঁহাতি স্পিনার তানভির ইসলাম
“নাসুম যদি ওয়ানডেতে ভালো করতে পারে, তাহলে সামগ্রিক চিত্রটা খুব ভালো হয়। সাদা বলের ক্রিকেটে তানভিরও আমাদের ভাবনায় আছে, বিশেষ করে টি-টোয়েন্টিতে। সেখানে ভালো করলে ওয়ানডেতেও আসতে পারে। তেমনি নাসুম ওয়ানডেতে ভালো করলে টি-টোয়েন্টিতেও ফিরতে পারে।”
“দুই ফরম্যাটেই কেউ চোট-টোট পেলে আরেকজনকে কাজে লাগানো যাবে। তাইজুল তো টেস্টে আছেই। প্রয়োজনে তাকেও সীমিত ওভারে কাজে লাগানো যাবে। তিন সংস্করণের জন্য আমাদের অপশনগুলো তাহলে খুব ভালোভাবে থাকে।”
আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজের তিন ম্যাচ আগামী বুধবার, শনিবার ও ১১ নভেম্বর। সব ম্যাচই হবে শারজাহতে।
বাংলাদেশ ওয়ানডে দল: নাজমুল হোসেন শান্ত (অধিনায়ক), মেহেদী হাসান মিরাজ (সহ-অধিনায়ক), সৌম্য সরকার, তানজিদ হাসান, জাকির হাসান, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ, তাওহিদ হৃদয়, জাকের আলি, রিশাদ হোসেন, নাসুম আহমেদ, তাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, নাহিদ রানা।