লিটনের মতো শান্তকেও লম্বা দৌড়ের ঘোড়া মনে করেন মাশরাফি

ট্রল ও সমালোচনার ঝড় সামলে শান্ত দেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিতে পারবেন, বিশ্বাস সিলেট স্ট্রাইকার্স অধিনায়কের।

ক্রীড়া প্রতিবেদকসিলেট থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Jan 2023, 01:54 PM
Updated : 26 Jan 2023, 01:54 PM

লিটন কুমার দাসের সেই দিনগুলি খুব কাছ থেকে দেখেছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, যখন চারপাশ থেকে ধেয়ে আসত সমালোচনার ঝড়। এখন সেই একই অবস্থায় তিনি দেখছেন নাজমুল হোসেন শান্তকে। এই দুজনকে নিয়ে তার আশার জায়গাটায়ও দেখা গেল মিল। লিটনের সেই দুর্দিনেও পাশে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, এই ব্যাটসম্যানই বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ভবিষ্যৎ। সেই মাশরাফি এখন বলছেন, শান্তর কাছ থেকেও অনেক কিছু পাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট।

তিন সংস্করণ মিলিয়ে লিটনকে এখন বলা যায় বাংলাদেশের সেরা ব্যাটসম্যান। এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড গড়েছেন তিনি গত বছর। তবে পথটা তার সহজ ছিল না মোটেও। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলে পরে ঘরোয়া ক্রিকেটেও শুরুর দিকে রানের জোয়ার বইয়ে দিয়ে জাতীয় দলে আসেন তিনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পায়ের নিচে জমিন শক্ত করতে অনেকটা সময় লেগে যায় তার।

এই সময়টায় লিটন ছিলেন বেশ অধরাবাহিক। একটি-দুটি ইনিংসে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু হতাশ করতেন আরও অনেক বেশি। সেই সময় তার সমালোচনা যেমন হয়েছে, তেমনি সামাজিক মাধ্যমে ট্রল ও ব্যক্তিগত আক্রমণও হয়েছে প্রচুর।

লিটন সেই দুঃসময়ের স্রোত পেরিয়ে সুসময়ের ঠিকানা পেয়েছেন। তবে ব্যক্তিগত আক্রমণ থেমে নেই। নানা ক্রিকেটারের দিকেই তা ছুটে যায়। তবে এই সময়ে এসবের সবচেয়ে বেশি শিকার শান্ত। লিটনের সেই দিনগুলির মতো তিনিও নিজেকে এখনও পুরোপুরি মেলে ধরতে পারেননি।

মাশরাফির মতে, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ক্রিকেটারকে এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। বিপিএলের সিলেট পর্ব শুরুর আগের দিন সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বললেন, সামাজিক মাধ্যম থেকে দূরে থাকাই সবচেয়ে ভালো উপায়।

“বাংলাদেশে হাতেগোনা একজন-দুজন বা সর্বোচ্চ তিনজন ক্রিকেটার পেতে পারেন, যারা এই ধরনের আক্রমণ ছাড়াই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে লম্বা সময় টিকে থেকেছে। ওই সময় যদি সোশাল মিডিয়া থাকত (এখনকার মতো), তামিম তাহলে তামিম হতে পারত না। মুশফিক আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিল। মাহমুদউল্লাহও একই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট যদি দেখেন, যারা ১০-১২ বছর খেলেছে, এভাবেই সেটেলড হয়েছে।”

“লিটনের ক্ষেত্রেও একই জিনিস। তাকে তার ধর্ম টেনেও অনেক কিছু বলা হয়েছে একটা সময়। এইসব চলেছেই। এসবের ভেতর দিয়েই ক্রিকেটারদের খেলতে হবে। কিছু করার নেই। কারণ আপনি তো আরেকজনকে বদলাতে পারবেন না। যেটা করতে পারবেন, তা হলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং এসব থেকে দূরে থাকা। কারণ, এখানে শুধু যে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়েই হয়, তা নয়। যখন যাকে মনে হয়… দুটি কমেন্ট করে গেল, দুটি লাইক পেল…। এই দেশে নেতিবাচকগুলোই লোকে বেশি ধরে, পজিটিভ কিছু লিখে তো ফেইসবুকে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।”

বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই পারফর্ম করা কঠিন বলে মনে করেন মাশরাফি। জাতীয় দলে এসে তরুণদের শুরুর ভোগান্তি তাই অস্বাভাবিক নয় তার কাছে।

“আমাদের প্রজন্ম অনেক সৌভাগ্যবান যে আমাদের সময় সোশাল মিডিয়া ওরকম ছিল না। এখন যারা খেলছে, তাদের মধ্যে যারা মানসিকভাবে শক্তিশালী, যারা এসব সোশাল মিডিয়া থেকে দূরে থাকে কিংবা কে কী বলছে বা লিখছে, এগুলো যারা না দেখে, তাদের জন্য কাজটা সহজ হবে। কারণ, বাংলাদেশে যারা তৃণমূল থেকে উঠে আসছে, তাদের ভিত এতটা শক্তিশালী নয়। আমাদের সিস্টেমই ওরকম নাই যে শক্তিশালী হয়ে উঠে আসবে।”

“এই ধরনের টুর্নামেন্টে… একটি বা দুটি আসরে ভালো খেলেই অনেকে জাতীয় দলে খেলে ফেলে। কিন্তু জাতীয় দলে খেলা মানেই তার ভিত শক্ত নয়। জাতীয় দলে যেটা হয়, প্রতিপক্ষে থাকে সেরা পাঁচ বোলার, সেটা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে খেললেও তাদের সেরা ৫ জন বোলিং করে। সেক্ষেত্রে ওই চ্যালেঞ্জটা সবসময় থেকে যায়। অন্যান্য দেশে যেটা হয়, ভারতে রঞ্জি ট্রফি বলেন বা অস্ট্রেলিয়ায় শেফিল্ড শিল্ড, ইংল্যান্ডের কাউন্টি খেলে যারা আসে, তারাও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে শুরুতে স্ট্রাগল করে। আমাদের সেখানে ভিত এতটা শক্তই নয়। চার-পাঁচ বছর তাই লাগাটা স্বাভাবিক (আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থিতু হতে)।”

লিটনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুর দিনগুলোয় অনেক সমালোচনার মধ্যে তার ওপর আস্থা রেখেছেন তখনকার অধিনায়ক মাশরাফি। সুযোগ দিয়েছেন ম্যাচের পর ম্যাচ। এমনকি বিপিএলেও ধুঁকতে থাকা সময়টায় অধিনায়ক হিসেবে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

“লিটনের কিন্তু এটাই হয়েছে। আজকে সবাই ওকে বাহবা দিল। শুরুতে তো সোশাল মিডিয়ায় আরও জঘন্য অবস্থায় ছিল ও। আজকে বাংলাদেশ দলে থিতু হয়েছে। আমি যখন অধিনায়ক ছিলাম, তখন বিশ্বাস করতাম, লিটনের যে বেসিকস আছে… আজকে অনেকেই বলেন যে, লিটন যতক্ষণ ব্যাটিং করে, টিভির সামনে থেকে উঠতে ইচ্ছে হয় না… কিন্তু ওই সময় হাথুরুসিংহে ছিলেন, আমি অধিনায়ক ছিলাম, আমরা বিশ্বাস করতাম যে এই ছেলেটা বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে বড় ভবিষ্যৎ। আজকে লিটন তা প্রমাণ করেছে।”

“কে জানে, কালকে লিটন আবার খারাপ খেললে একই জিনিস আবার হতে পারে। তবে লিটন এমন একজন, আমাদের বিশ্বাস যে দীর্ঘদিন পর একজন ওপেনার পেয়েছি, এখন যারা সিনিয়র হয়েছে, তারা যাওয়ার পর লিটন ওই জায়গাটা কাভার করতে পারবে।”

লিটনের সময় যেমন সমালোচনায় ঢাল হওয়ার চেষ্টা করেছেন মাশরাফি, একইভাবে তিনি আগলে রাখছেন শান্তকেও। বাংলাদেশের সফলতম ওয়ানডে অধিনায়কের মতে, শান্তর ক্যারিয়ার হবে অনেক লম্বা।

“শান্তর ক্ষেত্রে কিন্তু একই জিনিস হয়েছে। যদি বিশ্বকাপ দেখেন, শান্ত কিন্তু পুরো দেশের, আমাদের সবার বিপক্ষে গিয়ে প্রায় দুইশ রান করে এসেছে। পরে আবার স্ট্রাগল করেছে, এখন আবার রান করছে। শান্তকে কিছুটা এসবের (ট্রল) ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। মানসিকভাবে শক্ত থাকা গুরুত্বপূর্ণ।”

“শান্তর ক্ষেত্রে আমি দেখেছি যে, লিটনের মতোই বাইরের জিনিসগুলো ওকে ভাবায় না। সেইক্ষেত্রে আমার কেন জানি বিশ্বাস হয়, যে এই ছেলেটা লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। এটা আমার মনে হয়। তবে দিনশেষে সবকিছুতে ওপরওয়ালার রহমত প্রয়োজন হয়। আমি বিশ্বাস করি, এই ছেলেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনেক কিছু দিতে পারবে।”