চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি
রাচিন রাভিন্দ্রার সেঞ্চুরিতে ৫ উইকেটে জিতে সেমি-ফাইনালে নিউ জিল্যান্ড, শেষ চারে তাদের সঙ্গী ভারতও, বাংলাদেশের সঙ্গে বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেল স্বাগতিক পাকিস্তানেরও।
Published : 24 Feb 2025, 10:44 PM
স্বপ্ন ছিল আকাশ ছোঁয়ার। কিন্তু বাংলাদেশ দল পারল না ডানা মেলতেই। দেশ ছাড়ার আগে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত জোর দিয়ে বলেছিলেন, লক্ষ্য তাদের চ্যাম্পিয়ন্স হওয়া। সেই তাড়নার কোনো প্রতিফলন পড়ল না তাদের পারফরম্যান্সে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বাংলাদেশের বিদায় নিশ্চিত হয়ে গেল স্রেফ ছয় দিন আর দুই ম্যাচেই।
টুর্নামেন্টে টিকে থাকতে জয়ের বিকল্প ছিল না। সেই ম্যাচে আরও একবার ব্যাটিং ব্যর্থতায় ডুবল বাংলাদেশ। ৫ উইকেটে জিতে সেমি-ফাইনাল নিশ্চিত করে ফেলল দুর্দান্ত ফর্মে থাকা নিউ জিল্যান্ড।
কিউইদের জয়ে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গেল ভারতও। বাংলাদেশের পরাজয়ে আসর থেকে ছিটকে গেল পাকিস্তানও। আগামী বৃহস্পতিবার এই দুই দলের লড়াই এখন কেবলই নিয়ম রক্ষার।
রাওয়ালপিন্ডি ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সোমবার বোলারদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স গড়ে দেয় নিউ জিল্যান্ডের জয়ের ভিত। উল্টো করে বললে, বাজে ব্যাটিংয়ের মহড়ায় নিজেদের পতন ডেকে আনে বাংলাদেশ। ক্যারিয়ার সেরা বোলিংয়ে ২৬ রানে চার উইকেট শিকার করেন মাইকেল ব্রেসওয়েল। তিনি অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানাতে পারেন মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহকে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে জঘন্য শটে দলকে বিপদে ঠেলে আউট হন বাংলাদেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ দুই ব্যাটসম্যান।
অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর ১১০ বলে ৭৭ আর পরের দিকে জাকের আলির লড়াইয়ে বাংলাদেশ তুলতে পারে ২৩৬ রান।
সেই পুঁজি নিয়েও লড়াইয়ের ইঙ্গিত ছিল বোলিংয়ের শুরুতে। কিন্তু রাচিন রাভিন্দ্রার দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে পিষ্ট হয় সব আশা।
যথারীতি, রাভিন্দ্রাও বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে পারেন বাংলাদেশের ফিল্ডারদের। ২৫ রানে তাকে সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট করার সুবর্ণ সুযেগ হাতছাড়া করেন তানজিদ হাসান। রাভিন্দ্রা তখন আউট হলে ম্যাচের চিত্র অন্যরকম হতেও পারত।
পরে ৯৩ রানে নাহিদ রানার বলে জীবন পান তিনি মেহেদী হাসান মিরাজ ক্যাচ নিতে না পারায়। ১০৫ রানে মুস্তাফিজুর রহমানের বলে সহজতম ক্যাচটি ছাড়েন মাহমুদউল্লাহ।
সেই রাভিন্দ্রা আউট হন ১১২ রানে। নিউ জিল্যান্ড তখন জয়ের কিনারায়। ফিফটি করা টম ল্যাথাম পরে রান আউট হয়ে যান। তবে জিততে সমস্যা হয়নি তাদের।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুটা ছিল ইতিবাচক। যদিও প্রশ্ন রয়ে যায় একাদশ নিয়ে। ফিট হয়ে ওঠা মাহমুদউল্লাহর একাদশে আসা অবধারিতই ছিল। কিন্তু তাকে জায়গা দিতে বাইরে রাখা হয় সৌম্য সরকারকে, ২০২৩ বিশ্বকাপের পর থেকে যিনি ওয়ানডেতে দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান। সবশেষ ১৩ ওয়ানডেতে এক ফিফটি করা ও আগের ম্যাচে শূন্যতে ফেরা মুশফিকুর রহিম টিকে যান দলে।
তানজিদ হাসানের সঙ্গে ইনিংস শুরু করেন নাজমুল হোসেন শান্ত। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে তানজিদ টানা দুই বলে চার ও ছক্কা মারেন দেড় বছর পর ওয়ানডে ক্রিকেটে ফেরা কাইল জেমিসনকে। শান্ত শুরুতে আড়ষ্ঠ ছিলেন বেশ। তবে সময়ের সঙ্গে তা কাটিয়ে ওঠেন আস্তে আস্তে।
তানজিদ পরে পুল করে আরেকটি ছক্কা মারেন ম্যাট হেনরিকে। জেমিসনের এক ওভারে তিনটি বাউন্ডারি মারেন শান্ত।
আগের ম্যাচে ৩৬ রানে প্রথম ৫ উইকেট হারানো দল এবার ৮ ওভারে ৪৫ রান তোলে কোনো উইকেট না হারিয়েই।
পেসে ব্যর্থ নিউ জিল্যান্ড অধিনায়ক হাত বাড়ান ব্রেসওয়েলের অফ স্পিনে। কাজও হয় হাতেনাতে। দ্বিতীয় বলেই শর্ট মিড উইকেটে ক্যাচ দেন ২৪ রান করা তানজিদ।
তিনে নেমে মেহেদী হাসান মিরাজ ব্রেসওয়েলকে ছক্কা মেরে শুরু করলেও একটু পর বিদায় নেন (১৩) উইল ও’রোকের বলে আলতো করে মিড অনে তুলে দিয়ে।
রান রেট তখনও ওভারপ্রতি প্রায় সাড়ে পাঁচ। কিন্তু এরপর থেকেই পিছু হটার শুরু বাংলাদেশের। আগের ম্যাচে সাহসী সেঞ্চুরি করা তাওহিদ হৃদয় যেন গোলকধাঁধায় পড়ে যান। রান করার পথই পাচ্ছিলেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত ছটফট করে ব্রেসওয়েলকে উড়িয়ে মারার চেষ্টায় উইকেট বিলিয়ে দেন। ২৪ বল খেলে তিনি করতে পারেন স্রেফ ৭ রান।
উইকেট ছুড়ে আসার খেলায় অবশ্য হৃদয়কে বিপুল ব্যবধানে হারিয়ে দেন দুই অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ।
দল যখন চাপে, তখন অবিশ্বাস্য এক বাজে শটে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন মুশফিক। আগের ম্যাচে প্রথম বলে আউট হওয়া ব্যাটসম্যান এবার ২ রান করে স্লগ সুইপ করে ধরা পড়েন মিড উইকেটে।
সেই বিপদ থেকে দলকে উদ্ধার করবেন কী, মাহমুদউল্লাহও দৃষ্টিকটূ শটে উইকেট হারিয়ে বিপর্যয় আরও বাড়ান।
২ উইকেটে ৯৭ রানে থাকা দল অল্প সময়ের মধ্যেই পরিণত হয় ৫ উইকেটে ১১৮ রানে।
শান্ত এর মধ্যেই ফিফটিতে পা রাখেন ৭১ বলে। যখন তার রানের গতি বাড়ানোর পালা, তখন তাকে আবার মন দিতে হয় জুটি গড়ায়। সঙ্গী পান তিনি জাকের আলিকে।
একটু একটু করে বিপর্যয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা রেন দুজন। টানা সাত ওভারের বেশি আসেনি বাউন্ডারি।
ধারাভাষ্যে নাসের হুসেইন বলছিলেন, ‘শান্তর এখন শেষ পর্যন্ত দলকে টানতে হবে, সেঞ্চুরি করে আরও এগিয়ে যেতে হবে।’ কিন্তু বাংলাদেশ অধিনায়ক তা পারেননি। ইনিংসজুড়ে সবচেয়ে ভালো খেলেছেন যে শট, সেই পুল খেলেই আউট হয়ে যান তিনি ৩৮তম ওভারে।
দুইশ রানও তখন বেশ দূরের পথ। জাকের আলি ও রিশাদ হোসেনের ৩৩ রানের জুটি দলকে দুইশর কাছাকাছি নিয়ে যায়। রান তোলার একটু তাড়া প্রথমবার দেখা যায় এই জুটিতেই। ২৫ বলে ২৬ রান আসে রিশাদের ব্যাট থেকে।
এরপর জাকের ও তাসকিন আহমেদের জুটিও লড়াইটা চালিয়ে যায়। ৩০ বলে ৩৫ রান যোগ করেন দুজন, ইনিংসের একমাত্র শতরানের স্ট্রাইকরেটের জুটি যা।
রান আরেকটু বেশি হতে পারত, কিন্তু অযথা ঝুঁকি নিতে গিয়ে জাকের রান আউট হন ৫৫ বলে ৪৫ রান করে।
রাওয়াপিন্ডিতে সবশেষ ম্যাচটিতে ৩৩৬ রানের পুঁজি নিয়েও নিউ জিল্যান্ড ৭ উইকেটে হেরে গিয়েছিল পাকিস্তানের কাছে। এই ম্যাচে অবশ্য উইকেট যতটা ব্যাটিং স্বর্গ মনে করা হচ্ছিল, ততটা ছিল না। বোলিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটাও ছিল চমকপ্রদ।
নিজের প্রথম তিন ওভারের দুটিই মেডেন নেন তাসকিন। প্রথম ওভারে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে শূন্য রানে বোল্ড করে দেন আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান উইল ইয়াংকে। নাহিদ রানার প্রায় ১৪৮ কিলোমিটার গতির আউট সুইঙ্গারে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন নিউ জিল্যান্ডের বড় ভরসা কেন উইলিয়ামসন।
চার ওভারের মধ্যে দুই উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশ তখন বেশ উজ্জীবিত। ডেভন কনওয়ে ও রাচিন রাভিন্দ্রা কয়েকটি শট খেলে দ্রুত কিছু রান বাড়ান বটে। তবে তানজিদ যদি দ্বাদশ ওভারে রান আউট করতে পারতেন রাভিন্দ্রাকে, কিউইরা তখন প্রবল চাপেই পড়ত।
রক্ষা পেয়ে রাভিন্দ্রা ছুটতে থাকেন দারুণ গতিতে। ওয়ানডেতে হাজার রান পূরণ হয় তার ২৬ ইনিংসে ও প্রায় ১১০ স্ট্রাইক রেটে। কনওয়ের সঙ্গে জুটি পেরিয়ে যায় ফিফটি।
সেই জুটি থামে ৫৭ রানে। মুস্তাফিজের বলে কনওয়ে (৩০) ডিফেন্স করলেও বল গড়িয়ে লাগে স্টাম্পে।
এরপরই ম্যাচ জেতানো জুটি। রাভিন্দ্রা ও টম ল্যাথাম ১২৯ রান যোগ করেন ১৩৬ বলে।
জুটি গড়তে ও রান তুলতে তেমন কোনো ঝুঁকি নিতে হয়নি দুজনকে। তাদেরকে চাপে রাখার মতো কেমন কিছু করতে পারেনি বাংলাদেশের বোলার-ফিল্ডাররা। টানা কয়েকটি ভালো ডেলিভারির পর একটি-দুটি আলগা ডেলিভারিতে সুযোগ করে দিয়েছেন বাউন্ডারির।
এই টুর্নামেন্টের আগে ত্রিদেশীয় সিরিজে ক্যাচ নিতে গিয়ে কপালে আঘাত পেয়ে মাঠের বাইরে ছিটকে যান রাভিন্দ্রা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম ম্যাচেও খেলতে পারেননি। এই ম্যাচে ফিরে ছন্দ পেতেও সময় লাগল না একটুও। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি ৯৫ বল খেলে।
আগের তিনটি সেঞ্চুরি ছিল ২০২৩ বিশ্বকাপে। এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অভিষেকেও করলেন সেঞ্চুরি। বলার অপেক্ষা রাখে না, বড় মঞ্চের চাপ বলে কিছু নেই তার।
দলকে জয়ের কাছে নিয়ে রিশাদের বলে ছক্কার চেষ্টায় শেষ হয় তার ১০৫ বলে ১১২ রানের ইনিংস। ৫৫ রান করা ল্যাথাম রান আউট হন রান চুরির চেষ্টায়।
গ্লেন ফিলিপস ও মাইকেল ব্রেসওয়েল শেষ করেন বাকি কাজ। বোলিংয়ের নায়ক ব্রেসওয়েলের বাউন্ডারিতে জয় ধরা দেয় ২৩ বল বাকি রেখেই।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৩৬/৯ (তানজিদ ২৪, শান্ত ৭৭, মিরাজ ১৩, হৃদয় ৭, মুশফিক ২, মাহমুদউল্লাহ ৪, জাকের ৪৫, রিশাদ ২৬, তাসকিন ১০, মুস্তাফিজ ৩*, নাহিদ ০*; হেনরি ৯-০-৫৭-১, জেমিসন ৯-১-৪৮-১, ব্রেসওয়েল ১০-০-২৬-৪, ও’রোক ১০-১-৪৮-২, স্যান্টনার ১০-১-৪৪-০, ফিলিপস ২-০-১০-০)
নিউ জিল্যান্ড: ৪৬.১ ওভারে ২৪০/৫ (ইয়াং ০, কনওয়ে ৩০, উইলিয়ামসন ৫, রাভিন্দ্রা ১১২, ল্যাথাম ৫৫, ফিলিপস ২১*, ব্রেসওয়েল ১১*; তাসকিন ৭-২-২৮-১, নাহিদ ৯-০-৪৩-১, মিরাজ ১০-০-৫৩-০, মুস্তাফিজ ১০-০-৪২-১, রিশাদ ৯.১-০-৫৮-১, শান্ত ১-০-১২-০)
ফল: নিউ জিল্যান্ড ৫ উইকেটে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: মাইকেল ব্রেসওয়েল