চরম বিপর্যয়ের মধ্যে অসাধারণ সেঞ্চুরি করেন তাওহিদ হৃদয়, তবে শুবমান গিলের অপরাজিত সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অভিযান শুরু করল ভারত।
Published : 20 Feb 2025, 10:50 PM
হতাশায় দুহাতে মুখ ঢেকে পরে হাঁটুতে ভর দিয়ে নুইয়ে পড়লেন তাসকিন আহমেদ। টিভি ক্যামেরায় পরমুহূর্তে দেখা গেল রোহিত শার্মাকে। মাথায় হাত দিয়ে হাসতে হাসতে কিছু বলছিলেন ভারতীয় অধিনায়ক। হয়তো বলছিলেন, ‘বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম!’ ধারাভাষ্যে তখন রাভি শাস্ত্রি বলছেন, ‘এটিই কি বাংলাদেশের জন্য ছিল শেষ সুযোগ?’ উত্তরটি জানা গেল পরে। ওই যে তাসকিনের বলে লোকেশ রাহুলের সহজ ক্যাচ ছেড়ে দিলেন জাকের আলি, আর ম্যাচে ফিরতে পারল না বাংলাদেশ।
ম্যাচের শুরুটা ছিল বাংলাদেশের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। এরপর আসে স্বপ্নের মতো এক জুটি। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার একটি ইনিংস। স্কোরবোর্ডে মোটামুটি পুঁজি জমা হয়। তা নিয়ে লড়াইও করেন বোলাররা। কিন্তু ওই ক্যাচ পড়ার পর ম্যাচ জমানোর আশাও ছুটে যায়। ভারত জিতে যায় ৬ উইকেটে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায় সহজ জয়, তবে তাদেরকে পেরোতে হয় অনেকটা অস্বস্তিময় সময়।
সেই সময়টায় দুহাত বাড়িয়ে চাপকে আলিঙ্গন করে দলের ভার বয়ে নেন শুবমান গিল। উইকেট বুঝে, পরিস্থিতিকে সম্মান করে গোছানো আর নিয়ন্ত্রিত ব্যাটিংয়ে সেঞ্চুরি করে ভারতের জয়কে সঙ্গী নিয়ে ফেরেন ২৫ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হওয়ার পরদিনই দলের নায়ক তিনি অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংসে।
সেঞ্চুরির গুণে-মানে কোনো অংশে পিছিয়ে ছিলেন না তাওহিদ হৃদয়। বরং তার কাজটা ছিল আরও কঠিন। ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে প্রায় বিধ্বস্ত দলকে উদ্ধার করেন তিনি অসাধারণ ইনিংসে। তার প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির ইনিংসটায় ছিল পরিণত ব্যাটিংয়ের সব উপকরণ।
জাকের আলির সঙ্গে তিনি গড়েন ১৫৪ রানের জুটি। ষষ্ঠ উইকেটে যা বাংলাদেশের রেকর্ড, ভারতের বিপক্ষে যে কোনো জুটিতেই রেকর্ড। শঙ্কা উড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ২২৮ রান করতে পারে দল।
চোট কাটিয়ে ফেরার পর ছন্দ পাওয়ার লড়াইয়ে থাকা মোহাম্মদ শামি ৫ উইকেট শিকার করে বুঝিয়ে দেন, আইসিসি টুর্নামেন্ট মানেই তার রাজত্ব।
রান তাড়ায় ভারত শুরুটা দুর্দান্ত করলেও পরে রাশ টেনে ধরে বাংলাদেশ। কিন্তু গিলকে থামানো যায়নি।
ওই ক্যাচটি নিতে পারলে হয়তো চাপে ফেলা যেত তাদেরকে। রাহুলের রান ছিল তখন ৯। সেই রাহুল শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৪১ রানে। এরপর চেয়েও বড় কথা গিলের সঙ্গে তার ৮৭ রানের জুটিতেই শেষ হয় ম্যাচ।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশের শুরুটা ছিল বিভীষিকার মতো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্কোরবোর্ডে ফুটে ওঠে ২ উইকেটে ২ রান!
প্রথম ওভারেই শামির বলে নড়বড়ে ড্রাইভে উইকেট হারান সৌম্য সরকার। পরের ওভারে হার্শিত রানার অনেক বাইরের বলে ব্যাট ছুড়ে দিয়ে ক্যাচ দেন নাজমুল হোসেন শান্ত। দুজনের কেউ রানের মুখ দেখেননি।
মেহেদী হাসান মিরাজ অবশ্য রান করেছেন। তবে শূন্যের চেয়ে ৫ রানকে যদি ভালো বলা যায় আর কী!
আরেকপ্রান্তের এসব দেখেও তানজিদ হাসান নির্লিপ্তভাবে ছুটছিলেন সহজাত ব্যাটিংয়ের পথ ধরে। আকসার প্যাটেল আটকে দেন তাকে। বাঁহাতি স্পিনার আক্রমণে এসে দ্বিতীয় বলেই থামান তানজিদকে (২৫ বলে ২৫)। সেই রেশ থাকতেই একই পথ ধরেন মুশফিকুর রহিম। অনেক ম্যাচে বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা এবার আউট প্রথম বলেই!
৫ উইকেটে ৩৫ থেকে স্কোর ৬ উইকেটে ৩৫ হতে পারত পরের বলেই। যে কোনো বোলারের বহু আরাধ্য হ্যাটট্রিকের স্বাদ পেতে পারতেন আকসার। কিন্তু জাকের আলির সহজ ক্যাচ স্লিপে ফেলে দেন রোহিত শার্মা। হতাশায় মাঠে কয়েকটি চাপড় মেরে হাতজোড় করে ভারতীয় অধিনায়ক ক্ষমা চান বোলারের কাছে।
পরে অবশ্য এই ব্যর্থতায় আরও দুজন সঙ্গী পান রোহিত। ২৩ রানে মিড অফে হৃদয়ের সহজ ক্যাচ ছাড়েন হার্দিক পান্ডিয়া। শূন্য রানে বেঁচে যাওয়া জাকের আবার জীবন পান ২৪ রানে। এবার স্টাম্পিং করতে পারেননি লোকেশ রাহুল।
জীবন পেয়ে কাজে লাগাতে না পারার নজির তো কতই আছে! হৃদয় ও জাকের দেখান, কীভাবে তা কাজে লাগাতে হয় আর প্রতিপক্ষকে পোড়াতে হয়।
সহজাত ব্যাটিং তুলে রেখে বাউন্ডারি ভুলে গিয়ে জুটি গড়ায় মন দেন দুজন। দলের রান রেট ঘোরাফেরা করতে থাকে সাড়ে তিনের আশেপাশে। তবু তাড়াহুড়ো করেননি কেউ। নরম হয়ে আসা বল আর সহজ হয়ে আসা উইকেটে সুবিধে করতে পারেননি ভারতীয় স্পিনাররা।
আগে পঞ্চাশে পা রাখেন জাকের। বল খেলেন ৮৭টি। তার টানা দ্বিতীয় ফিফটি এটি। পরের ওভারে বাউন্ডারিতে পঞ্চাশে পৌঁছে যান হৃদয়। তার বল লাগে ৮৫টি।
দুজনের ফিফটির মাঝামাঝি সময়ে জুটির শতরানও চলে আসে।
ইনিংসের সেরা শটটি ফিফটির পরপরই খেলেন হৃদয়। এক্সট্রা কাভারের ওপর দিয়ে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন তিনি কুলদিপ ইয়াদাভকে। পরের ওভারে রাভিন্দ্রা জাদেজাকেও গ্যালারিতে পাঠিয়ে দেন তিনি স্লগ সুইপে।
২০২৩ সালের পর প্রথমবার মাঝের ওভারগুলোয় (১১-৪০) উইকেট নিতে ব্যর্থ হয় ভারত।
সেই উইকেট ধরা দেয় ৪৩তম ওভারে। জাকেরকে (১১৪ বলে ৬৮) ফিরিয়ে ২০০ ওয়ানডে উইকেট স্পর্শ করেন শামি। বলের হিসেবে এই মাইলফলকে তিনি ওয়ানডে ইতিহাসের দ্রুততম, ম্যাচ খেলার হিসেবে দ্বিতীয় দ্রুততম (রেকর্ডটি মিচেল স্টার্কের)।
রিশাদ হোসেন সময়ের দাবি মেটা দুই ছক্কায় ১২ বলে ১৮ করে। তানজিম হাসান ও তাসকিন আহমেদ অবশ্য পারেননি।
দ্রুত সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যেতে থাকা হৃদয়ের জন্য বাধা হয়ে আসে পায়ের ক্র্যাম্প। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোরকমে রান নিচ্ছিলেন তিনি। পায়ে টান লেগে অনেকটা সময় মাঠে শুয়ে থাকার পর উঠে দাঁড়িয়ে চার মারেন শামিকে। আরেকটি ডেলিভারি খেলতে গিয়ে আবার পড়ে যান ক্রিজে। এসবের মধ্যেই শতরানে পা রাখেন ১১৪ বলে।
ফিফটি থেকে সেঞ্চুরিতে যেতে কেবল ২৯ বল লাগে তার।
তবে শেষ দিকে তিনি নড়তেই পারছিলেন না। দলও তাই পায়নি প্রত্যাশিত রান।
শেষ পাঁচ ওভারে আসে কেবল ১৬ রান। শামি ঝুলিতে ভরেন পাঁচ শিকার। হৃদয়ের বিদায়ে শেষ ওভারে শেষ হয় বাংলাদেশের ইনিংস।
এই পুঁজিতে জিততে হলো প্রয়োজন ছিল শুরুতে দ্রুত উইকেট। কিন্তু রোহিত শার্মা ও শুবমান গিল ভারতকে এনে দেন উড়ন্ত শুরু। প্রথম ১০ ওভারে বাউন্ডারি আসে এক ডজন। রান জমা হয় ৬৯।
অতি আগ্রাসী হয়েই দশম ওভারে তাসকিনকে উইকেট উপহার দেন রোহিত (৩৬ বলে ৪১)। এর মধ্যেই ১১ হাজার ওয়ানডে রান পূর্ণ হয় ভারতীয় অধিনায়কের।
এই জুটি ভাঙার পর ফুটে উঠতে থাকে, উইকেট আদতে খুব সহজ নয়! সময়ের সঙ্গে মন্থর হতে থাকে উইকেট। ভিরাট কোহলির মতো ব্যাটসম্যানও রান করতে ধুঁকতে থাকেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করে নিজের করণীয় বুঝে নেন গিল। লম্বা ইনিংস খেলায় মন দেন তিনি।
প্রথম রান করতে ১০ বল খেলেন কোহলি। রিশাদ-মিরাজদের বোলিংয়ে জড়তা কাটাতে না পেরে তিনি আউট হন ৩৮ বলে ২২ রান করে। পরে শ্রেয়াস আইয়ার ও আকসার প্যাটেলও পারেননি গিলকে লম্বা সময় সঙ্গ দিতে।
আরেকজন স্পিনার থাকলে হয়তো ভারতকে আরেকটু বেগ দেওয়া যেত। রান রেটের চাপ তো এমনিতে ছিল না। গিল ও রাহুল তাই ফাঁস আলগা করে দলকে এগিয়ে নেন লক্ষ্যের দিকে। ক্যাচ ছেড়ে, রান আউটের 'হাফ-চান্স' হাতছাড়া করে তাদের কাজ সহজ করে দেয় বাংলাদেশ।
টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরিতে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠা উদযাপন করেন গিল। ৫১ ম্যাচেই তার ওয়ানডে সেঞ্চুরি হয়ে গেল ৮টি। তানজিমকে বিশাল এক ছক্কায় ম্যাচ শেষ করে দেন রাহুল।
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে আসর শুরু করা বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচেই পেল তেতো বাস্তবতার স্বাদ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৪৯.৪ ওভারে ২২৮ (তানজিদ ২৫, সৌম্য ০, শান্ত ০, মিরাজ ৫, হৃদয় ১০০, মুশফিক ০, জাকের ৬৮, রিশাদ ১৮, তানজিম ০, তাসকিন ৩, মুস্তাফিজ ০*; শামি ১০-০-৫৩-৫, হার্শিত ৭.৪-০-৩১-৩, আকসার ৯-১-৪৩-২, পান্ডিয়া ৪-০-২০-০, জাদেজা ৯-০-৩৭-০, কুলদিপ ১০-০-৪৩-০)।
ভারত: ৪৬.৩ ওভারে ২৩১/৪ (রোহিত ৪১, গিল ১০১*, কোহলি ২২, শ্রেয়াস ১৫, আকসার ৮, রাহুল ৪১*; তাসকিন ৯-০-৩৬-১, মুস্তাফিজ ৯-০-৬২-১, তানজিম ৮.৩-০-৫৮-০, মিরাজ ১০-০-৩৭-০, রিশাদ ১০-০-৩৮-২)।
ফল: ভারত ৬ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: শুবমান গিল।