করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবিলায় দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা পাওয়া সহজ করতে স্বত্বে ছাড়ের প্রস্তাবে চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিলেও বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর জোট জি-২০ আপাতত সে পথে হাঁটছে না।
Published : 19 May 2021, 01:37 PM
কোভিড-১৯ টিকার স্বত্ব ছাড়ের বদলে যুক্তরাষ্ট্রসহ ২০ দেশের এই জোট দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা তৈরির জন্য লাইসেন্স বিনিময়, প্রস্তুত প্রণালী ও প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে চায় বলে একটি শীর্ষ সম্মেলনের খসড়া প্রস্তাবকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে রয়টার্স।
শুধু তাই নয়, এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বাড়তি তহবিল জোগানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাও খসড়ার ‘হালে পানি পায়নি’।
শুক্রবার রোমে অনুষ্ঠেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ঘোষণাপত্র হিসেবে এই যে খসড়া প্রস্তাবটি গৃহীত হতে যাচ্ছে, তাতে জি-২০ জোটের সদস্য রাষ্ট্র ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য দেশের প্রতিশ্রুতিগুলোর নাম রয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
চলমান মহামারী মোকাবেলায় সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ নিয়ে এ বছরের অন্যতম বড় আয়োজন এটি।
রয়টার্সের বলছে, এই খসড়া প্রস্তাবটি পরিবর্তনের সুযোগ থাকলেও এর মধ্য দিয়ে টিকার পেটেন্ট ছাড়ে সমর্থন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) বাড়তি তহবিল যোগানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি, তার কার্যকারিতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
খসড়া ঘোষণাপত্রটি জি-২০ দেশগুলোর বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সমঝোতার ফল, যেখানে কোভিড-১৯ টিকার মেধাস্বত্ত্ব শিথিলের প্রস্তাবে মতভেদ রয়ে গেছে।
মে মাসের শুরুতে কোভিড-১৯ টিকার ‘পেটেন্ট’ সাময়িকভাবে শিথিলে ভারত ও সাউদ আফ্রিকার আনা প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছিল জো বাইডেন প্রশাসন। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য টিকা উৎপাদনকারী দেশ এ ব্যাপারে তাদের উৎকণ্ঠা জানায়।
তাদের ভাষ্য, টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া, টিকা উৎপাদনের কলা-কৌশল বিনিময় এবং টিকা উৎপাদকদের মধ্যে ‘স্বেচ্ছা সহযোগিতা’ নিশ্চিত হলেই বরং দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বজুড়ে টিকা উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে।
স্বাস্থ্য সম্মেলনের খসড়া সমাপনী ঘোষণাপত্রে এই মতভেদের বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে এবং ‘পেটেন্ট’ শিথিল করার ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি।
জি-২০ দেশের নেতারা বরং ‘পেটেন্ট-পুল’ তৈরি করার একটি প্রতিশ্রুতি দিতে যাচ্ছেন। এটাও ওষুধ কোম্পানিগুলোর জন্য ‘অবন্ধুসুলভ’ পদক্ষেপ হলেও পেটেন্ট শিথিল করার মতো কড়া পদক্ষেপের চেয়ে অনেক ভালো বলে ওষুধ শিল্পখাতের এক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন।
পেটেন্ট পুলের অধীনে দরিদ্র দেশগুলোতে উৎপাদনের জন্য স্বেচ্ছায় পণ্যের ‘নিবন্ধন বিনিময়’ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ওষুধ উৎপাদকেরা। আফ্রিকায় এইচআইভির ওষুধ সহজে উৎপাদনের জন্য এই পুল পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
সম্মেলনের সমাপনীতে জি-২০ জোটের নেতারা ‘স্বেচ্ছায় নিবন্ধন, প্রযুক্তি ও জ্ঞান স্থানান্তর এবং পেটেন্ট-পুল তৈরি’ বিষয়ে অগ্রাধিকার দেবেন বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।
ডব্লিউএইচওর জন্য হতাশা?
এই সম্মেলন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জন্য এবং বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ টিকা, ওষুধ ও পরীক্ষার সরবরাহ আরও দ্রুত করার উদ্যোগের জন্য হতাশার বার্তা নিয়ে আসতে পারে।
ডব্লিউএইচওর কর্মসূচিতে বিশ্বনেতারা সমর্থন জানালেও এর জন্য পুরো তহবিল যোগানোর বিষয়ে স্পষ্ট কোনো প্রতিশ্রুতি নেই বলেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
খসড়া ঘোষণাপত্রে দেখা যায়, তহবিলের যে ঘাটতি আছে তা ‘ন্যায্য ভাগাভাগির মাধ্যমে’ মেটানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন নেতারা এবং এই কর্মসূচির একটি ‘কৌশলগত পর্যালোচনার’ আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।
এর ফলে প্রাথমিক খসড়ায় ডব্লিউএইচওর এই কর্মসূচির বিষয়ে যে ‘ন্যায্য ও পূর্ণ অর্থায়নের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা বলেছিলেন নেতারা, তা থেকে এখন তারা সরে এসেছেন।
রয়টার্সের সংবাদকর্মীরা চাক্ষুষ যা দেখেছেন, তাতে মূল খসড়ায় সম্মেলনের আয়োজক ইউরোপীয় কমিশনের প্রভাব বেশি দেখা গেছে। তার সঙ্গে এ বছরের জি-২০ সম্মেলনের সভাপতি ইতালির সরকারের বাড়তি চাপ আছে। তবে এমন দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি কমিশনের মুখপাত্র।
ডব্লিউএইচওর কর্মসূচিটি ২০২০ সালের এপ্রিলে চালু করা হয়, যেটা মারাত্মক তহবিল সংকটে আছে। কোভিড-প্রতিরোধী টিকার উদ্ভাবন, ক্রয় ও সরবরাহের জন্য যে ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের তহবিলের চাহিদা ছিল, তাতে এখনও একহাজার ৯০০ কোটি ডলারের ঘাটতি রয়ে গেছে।
টিকার সংস্থানে এই কর্মসূচির মূলস্তম্ভ কোভ্যাক্সকে অবশ্যই টিকা লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা উচিত বলে খসড়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাথমিকভাবে কোভ্যাক্স গঠন করা হয়েছিল দরিদ্র্য দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে, কিন্তু ধনী রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজেদের জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোর টিকপ্রাপ্তিতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমনকি সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও এখন টিকা পাচ্ছে না।
চলমান পরিস্থিতিকে ‘টিকা বর্ণবাদ’ হিসেবে বর্ণনা করে ডব্লিউএইচও প্রধান বলেছেন, “বড় সমস্যাটি হলো বিনিময় না করা। সুতরাং একমাত্র সমাধানও হচ্ছে বেশি করে বিনিময়।”
রোম সম্মেলন-সমাপনীর মূল খসড়ায় বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতের স্বাস্থ্য সেবাজনিত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডব্লিউএইচওকে ‘যথাযথ, টেকসইভাবে ও অনুমানযোগ্যভাবে অর্থায়ন করা উচিত’।
‘সম্পূর্ণ অর্থায়ন সমৃদ্ধ, স্বাধীন ও কার্যকর’ করে ডব্লিউএইচওকে গড়ে তোলার আহ্বানের পাশাপাশি মূল খসড়ায় আরও অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথা ছিল, যেগুলো পরিবর্তিত এই চূড়ান্ত খসড়ায় জায়গা পায়নি।