কোরবানির ঈদের আগে বেড়েছে ছুরি-বটির দামও; বিক্রেতারা বলছেন, কয়লার দাম বেশি।
Published : 28 Jun 2023, 08:53 PM
বৃষ্টিতে ভিজে কারওয়ান বাজারে কামারের দোকানের সামনে অপেক্ষা করছেন গৃহিণী জোবায়দা খাতুন। মাথার উপর হালকা পলিথিন দিয়ে কোনো মতে বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচার চেষ্টা।
ঘরের পুরুষ সদস্যরা কোরবানির পশু কেনায় ব্যস্ত থাকায় তিনি কামারপট্রিতে এসেছেন পুরনো ছুরি, বটি শান দিতে।
জোবায়দার মতো অনেকেই এসেছেন পুরনো চাকু, বটি, ধার দিতে; কেউবা এসেছেন জবাইয়ের কাজে ব্যবহৃত ছুরি, বটি, দা, চাপাতি, কুড়াল কিনতে। সারিবদ্ধভাবে দোকানে সাজানো রয়েছে এসব সরঞ্জাম।
কারওয়ান বাজারে দেশি সরঞ্জামের পাশাপাশি মিলছে বিদেশি পণ্যও। তবে বিক্রেতারা জানালেন, বিদেশিগুলো দেখতে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হলেও ভারী কাজে এসব উপযুক্ত নয়।
পশু জবাই ও পরবর্তী মাংস কাটার কাজের ধরন অনুযায়ী ক্রেতারা বেছে নিচ্ছেন চাপাতি, বটি, কুড়াল ও ছুড়ি।
লোহার এসব সরঞ্জাম তৈরির পাশাপাশি পুরনোগুলো কয়লার আগুনে গরম করে পিটিয়ে ব্যবহার উপযোগী করছেন কামাররা।
২৫ বছর ধরে এ পেশায় থাকা লিটন কর্মকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোরবানির ঈদের সময়েই সবচেয়ে বেশি কাজের চাপ থাকে। আজ সারারাত কাজ করব। সকালেও অনেকে আসবে ধার দিতে।”
কাঁচা-পাকার বিভ্রান্তি
এসব সরঞ্জামের দাম নির্ভর করে ওজন ও পণ্যটি কোন মানের লোহা দিয়ে তৈরি তার উপর। ‘কাঁচা’ লোহায় তৈরি সরঞ্জাম অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও বেশিদিন টেকসই হয় না। অন্যদিকে তুলনামূলক একটু বেশি দামের ‘পাকা’ লোহার তৈরি সরঞ্জাম টেকে বছরের পর বছর।
দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে নতুন করে কেবল শান দিয়ে নিতে হয়।
কামাড়পট্টিতে জাফর ট্রেডার্সের পরিচালক জাফর আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এক কেজি ওজনের একটি দা কিনতে দাম পড়বে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। যদি বেশি লম্বা হয় তাহলে আরেকটু বেশি দাম দিতে হবে।
‘‘জবাইর কাজে ব্যবহৃত লম্বা ছুরির দামও ৮০০-৯০০ টাকা প্রতিটি। পশুর চামড়া ছড়ানোর ছোট, হালকা ও তীক্ষ্ণ আগার ছুড়ি ১৮০ থেকে ২২০ টাকা। পাকা লোহায় তৈরি একটু বড় আকৃতির হলে তা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।’’
গাড়ির স্প্রিং, রেল লাইনের লোহা দিয়েও তৈরি হয় বিভিন্ন ছুড়ি, বটি, দা ও চাপাতি। কোন লোহা দিয়ে তৈরি তার উপর নির্ভর করে ওই পণ্যটির দাম।
এরমধ্যে গাড়ির স্প্রিং দিয়ে তৈরি ছুরির দাম বেশি। আর রেল লাইনের লোহায় তৈরি চাপাতি ও দা’র দাম বেশি হয় বলে জানালেন জাফর আহমেদ।
আর মাংস কাটার ছুরিগুলোর দাম চাওয়া হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত।
পশু জবাইয়ে ব্যবহৃত প্রায় ১৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের লোহার স্প্রিংয়ের তৈরি ছুরির দাম চাওয়া হচ্ছে এক হাজার টাকা, ছোট চাইনিজ কুড়াল ৭০০ টাকা, একটু বড় কুড়াল ৯০০ টাকায় দরদাম করতে দেখা গেছে বিক্রেতাদের।
পশুর হাড় কাটতে ব্যবহৃত চাপাতির দামও আকার ভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায় দাম চাচ্ছেন বিক্রেতারা।
কারওয়ান বাজারে ছোট আকৃতির বটি কিনতে এসেছেন মোহাম্মদ সোলায়মান। ‘পাকা’ লোহায় তৈরি দাবি করে দোকানদার বটির দাম চাইলেন এক হাজার টাকা।
এক কেজি ওজন দাবি করায় ক্রেতা সোলায়মানও মেপে দেখতে চাইলেন। বিক্রেতা পাশের দোকানে নিয়ে গিয়ে ওজন করে দেখালেন প্রায় এক কেজি ওজন।
দরদাম ঠিক করে ৯০০ টাকায় কিনে নিয়ে গেলেন তিনি। আর বড় আকৃতির একটি বটি কিনতে হলে গুনতে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
বাজার ঘুরে দেখা গেল, বিভিন্ন প্রকার পণ্যের দাম ও আকার দেখে লোহার মান কেমন তা যাচাই করাটা কঠিন ঠেকছে। কাঁচা ও পাকা লোহার মধ্যে পার্থক্য করতে জানেন না অনেক ক্রেতা।
দোকানির সঙ্গে পেরে না ওঠা আব্দুর রহিম বললেন, ‘‘বড় ঝামেলার মধ্যে পড়ে গিয়েছি কাঁচা ও পাকা লোহার ছুড়ি ও বটি চিনতে। আমি পাকা লোহার জিনিস চাই। সবই পাকা লোহা দাবি করছে। এজন্য বাজার ঘুড়ে দা-বটির লোহা চিনতে চেষ্টা করছি।’’
কারওয়ান বাজারের এ কামাড়পট্টিতে ডজন খানের বেশি দোকান রয়েছে, যার মধ্যে বেশির ভাগেরই নিজস্ব কামার আছে।
বংশ পরম্পরায় ১৬ বছর ধরে কামারের কাজ করা মোহাম্মদ সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ঈদের সময়ে হাজিরা একটু বেশি থাকে। দিন-রাত মিলিয়ে কাজ করতে হয়। কাল রাতেই আগুনের পাশে বসেই কাজ করছি। বৃষ্টিতে একটু কম গরম লাগছে। নইলে আগুনের এ তাপে টেকা যায় না।’’
পণ্যর দাম গতবারের চেয়ে বেশি হওয়ার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “গত বছর যে কয়লার বস্তা ৮০০ টাকায় কিনছি, এবার তা ১১০০ টাকায় কিনতে হয়েছে। এরসঙ্গে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি।”
তবে অন্যান্য জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় ভাঙারি ও পুরনো লোহা দিয়ে তৈরি হওয়া এসব সরঞ্জামের দাম তেমন বাড়েনি বলে জানালেন ব্যবসায়ী জাফর আহমেদ।
কামাররা জানিয়েছেন, তারা পণ্য তৈরিতে ব্যবহার করেন জাহাজের স্ক্র্যাপ লোহা এবং নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত লোহার উচ্ছিষ্ট অংশ।
বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান পড়ে যাওয়ায় লোহার রডের দামও বেড়েছে গত এক বছরে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর বাজার দরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ৬০ ও ৪০ গ্রেডের এসএস রডের দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ।