ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলার দরের ব্যবধান নামল আড়াই টাকায়

যদিও আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা দেড় টাকা হওয়ার কথা।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 May 2023, 03:25 AM
Updated : 15 May 2023, 03:25 AM

বিভিন্ন পক্ষের একাধিক পদক্ষেপের সুফল হিসেবে ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের দরের বড় ধরনের পার্থক্য অবশেষে অনেকটা কমেছে; ৯ মাসের মধ্যে বিনিময় হারে ১০ টাকার ব্যবধান কমে আড়াই টাকায় নেমেছে।

ডলারের সরবরাহ সংকটে প্রধান এ বিদেশি মুদ্রার দর ২০২১ সালের শেষ দিকে যখন চড়তে থাকে তখন ডলার কেনাবেচার এ দুই উৎসের মধ্যে ফারাক বাড়তে থাকে। ২০২২ সালের অগাস্টে তা এক পর্যায়ে ১০ টাকাও ছাড়িয়ে যায়।

নানা প্রচেষ্টার পর বিভিন্ন সময় ওঠানামার পর খোলা বাজারে গত সপ্তাহে ডলারের বিনিময় মূল্য ১১০-১১১ টাকায় নেমেছে। আর ব্যাংকে পর্যায়ক্রমে দর বাড়ার পর ব্যাংকে নগদ অর্থে ডলার কেনার মূল্য এখন ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১০৯ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।

এতে খোলা বাজার ও ব্যাংকে ডলারের দরের ব্যবধান আড়াই টাকায় নেমেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মানি চেঞ্জারদের বৈঠকে নেওয়া এ বিষয়ক নীতি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা দেড় টাকা হওয়ার কথা।

২০২২ সালের জুলাই-অগাস্টে ডলার নিয়ে টানাপড়েনের সময়কালে চাহিদা বাড়তে থাকার সময়কালে অগাস্টে খোলা বাজারে ডলারের দর ওঠে সর্বোচ্চ ১২১ টাকা। সেসময় এক পর্যায়ে ব্যাংকে বিক্রি হয় সর্বোচ্চ ১১১ টাকায়।

ব্যাংকার ও মানি চেঞ্জার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিনের প্রচলিত ডলারের দর বেঁধে দেওয়ার নীতি থেকে সরে তা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার দিকে এগোলে টাকার মান পড়তে থাকে। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত মেনে বাফেদা ও এবিবি ডলারের দর কেনাবেচায় দর নির্ধারণ করলে ব্যাংকে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে ১০৭-১০৮ টাকা হয়।

পাশাপাশি খোলা বাজারে ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তা সর্বোচ্চ ১২১ টাকা থেকে নেমে ১১০-১১১ টাকার কাছাকাছি দরেই ঘুরপাক খেতে থাকে। এ দুই কারণেই মূলত ব্যাংকে ও খোলা বাজারে নগদ দরের ব্যবধান কমে আসে। খোলা বাজার থেকে ডলার কেনার চাহিদা কমে আসাও একটি কারণ বলে মনে করছেন মানি চেঞ্জাররা।

ঢাকার পল্টনের মেক্সিমকো মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোশারফ হোসেইন জানান, গত তিন দিন ধরে ১১০ টাকা দরেই ডলার বিক্রি করেছেন তিনি। গত সপ্তাহজুড়ে এক জায়গাতেই আছে ডলারের দর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘গত বৃহস্পতিবার ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রি করছি এবং কিনছি ১০৯ টাকা ও ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায়। রোববার বিক্রি করলাম ১১০ টাকায়। চাহিদা যা আছে সে পরিমাণ ডলার পাওয়া যাচ্ছে। আমরাও দিতে পারছি।’’

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রা বিনিময় হারের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত এক বছর ধরে বাড়তে থাকা ডলারের আমদানি পর্যায়ে বিনিময়মূল্য চলতি মে মাসে বেড়ে হয়েছে ১০৭ টাকা ৮৩ পয়সা। এক বছর আগে ২০২২ সালের ১০ মে যা ছিল ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা; এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ২১ টাকা ১৩ পয়সা বা ২৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।

গত রোববার এক ব্যাংক আরেক ব্যাংকের কাছে ডলার বেচাকেনা করেছে ১০৮ টাকায়। ডলারের এ দরের সঙ্গে ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে কমিশন আকারে ১০ থেকে ৫০ পয়সা পর্যন্ত যোগ করে।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে বর্তমানে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে। চলতি অর্থবছরে ১০ মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধ, কোভিড মহামারীর প্রভাব কাটিয়ে ঘুড়ে দাঁড়ানোর চেষ্টায় থাকা অর্থনীতিতে আমদানি চাহিদা বাড়তে থাকলে ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকলে বিনিময় মূল্যও বাড়তে থাকে। ওই সময় অনেক দেশের মতো টাকাও ডলারের বিপরীতে দর হারাতে থাকে।

বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ দৃশ্যমান কারণের সঙ্গে ডলারের দর বাড়াতে সেসময় কারসাজিও ছিল বলে অভিযোগ আসে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে।

ওই সময়ই এতদিন ধরে ডলারের দর নির্ধারণ করে আসা বাংলাদেশ ব্যাংক তা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পথে যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শ মেনে এখন একক বিনিময় মুদ্রা নির্ধারণের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

ডলারের দর বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাস্তবায়ন শুরু করে বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন (এবিবি)।

ওই সময় দর নির্ধারণের পাশাপাশি ব্যাংকের নগদ অর্থে ডলার বিক্রির দরের চেয়ে খোলা বাজারে ডলার কেনাবেচার দরের ব্যবধান সর্বোচ্চ দেড় টাকা করার নীতিগত সিদ্ধান্তও আসে।

তখন দেশে আসা রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে ডলারের আলাদা বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়, যা এখন সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা এবং একইভাবে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পৃথক দর নির্ধারণ করা হয়, যা এখন সর্বোচ্চ ১০৬ টাকা করা হয়েছে।

বাফেদা-এবিবির সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্সের দরের পার্থক্য দুই টাকা থাকবে।

গত সেপ্টেম্বরের সিদ্ধান্তের পর থেকে বাফেদার দেওয়া ডলারের দর দেখে খোলা বাজারে দর র্নিধারণ করে আসছে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ। তবে চাহিদা যখন বেশি ছিল তখন এর চেয়ে বেশি ১১৪-১১৫ টাকা দরে খোলা বাজারে ডলার হাতবদল হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা কমলে তা কমে ১১০-১১১ টাকার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।

রোববার মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক মো. হেলাল উদ্দিন শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা এখনও প্রতিদিন সকালে সদস্যদের বাফেদার রেট চার্ট দেখে ডলারের দাম বলে দিচ্ছি। চাহিদা বেশি না থাকায় এখন ডলারের দর ১১০-১১১ টাকার মধ্যেই রয়েছে।’’

ঢাকার গুলশানের কর্নিকা মানি এক্সচেঞ্জারের স্বত্বাধিকারী আতাউর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘দাম এক জায়গায় আটকে আছে। চাহিদা খুব একটা নেই। গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে পারছি।”

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল করপোরেট শাখার ব্যবস্থাপক রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রোববার ব্যাংকে নগদ ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৮ টাকা ৭১ পয়সায়।

আগে কার্ড ও ছাত্রদের পড়ালেখা বাবদ বিদেশে অর্থ পাঠাতে ডলারের দর পৃথক হলেও এখন আর পার্থক্য নেই বলে জানালেন তিনি।

ব্যাংকে নগদ অর্থে বিক্রি করা দরেই কার্ড ও শিক্ষার্থীদের জন্য একই দর নিচ্ছে বেসরকার ব্যাংকগুলোও।

ডলারের দর আকাশ ছুঁতে শুরু করলে ২০২২ সালে কার্ডে অর্থ পরিশোধে ডলারের খরচ কিছুটা কম ছিল। এজন্য কার্ডের ব্যবহারও বাড়তে শুরু করেছিল। তবে সেই ব্যবধান আর নেই।

ব্যাংকের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবারের মত রোববারও বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড নগদ ডলার বিক্রি করেছে ১০৯ টাকা দরে ও কিনেছে ১০৮ টাকায়। ব্র্যাক ব্যাংক নগদে প্রতি ডলার বিক্রি করছে ১০৯ টাকায় ও কিনছে ১০৭ টাকা ৫০ পয়সায়।