“ডিজিটাল পেমেন্টে সবসময় কিছু না কিছু ক্যাশব্যাক অফার থাকে। সে কারণে সুপার শপগুলোতে কেনাকাটায় নিয়মিত বিভিন্ন ডিজিটাল পেমেন্টের সাহায্য নিই,” বলছেন এক ক্রেতা।
Published : 31 Mar 2024, 12:19 AM
কেনাকাটা সেরে মোবাইল ব্যাংকিং বা কার্ডে মূল্য পরিশোধের সুযোগে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে ডিজিটাল লেনদেন।
রাজধানীর ফ্যাশন হাউজগুলোতে ডিজিটাল পেমেন্টের সুযোগ রয়েছে অনেক দিন ধরেই; ঈদের বাজারে এসে ক্রেতাদের একটি বড় অংশ নগদ টাকার বদলে দাম চুকাচ্ছেন কার্ডে বা এমএফএস এর মাধ্যমে।
ফ্যাশন হাউজগুলো বলছে, তাদের আউটলেটগুলোতে ঈদের সময় মোট লেনদেনের ‘৫০ থেকে ৭০ শতাংশই’ হয়েছে ডিজিটাল লেনদেন। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন ছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার দিচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ফ্যাশন হাউজগুলো।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে সরকার ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে কয়েক বছর ধরেই। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সেই কার্যক্রম। আগামী চার বছরের মধ্যে সরকার দেশের ৭৫ শতাংশ আর্থিক লেনদেন কাগজের টাকার পরিবর্তে ডিজিটালে নিতে নিয়ে আসতে চায়।
একসময় কেনাকাটায় এমএফএস কোম্পানি বিকাশ ও নগদের সাহায্য নিলেও বছর দুই ধরে ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করছেন আগারগাঁও এলাকায় মোখলেছুর রহমান শাহীন।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের এই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জামা-জুতাসহ অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে নগদ টাকার চেয়ে কার্ডে পে করাই সুবিধাজনক। আবার ডিজিটাল পেমেন্টে কিছু না কিছু অফার থাকে। সে কারণে সুপার শপগুলোতে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও আমি নিয়মিত বিভিন্ন ডিজিটাল পেমেন্টের সাহায্য নিই। এখন চায়ের দোকান ও কাঁচাবাজারেই নগদ টাকার লেনদেন বেশি।”
ফ্যাশন হাউজ প্লাস পয়েন্টের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বিপুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “বলতে গেলে আমাদের দৈনিক লেনদেনের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই এখন হচ্ছে বিকাশ, নগদ, বিভিন্ন ব্যাংকের ডেভিড-ক্রেডিট কার্ডসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে।”
প্রায় ২০ বছর ধরে দেশীয় ধারার ফ্যাশন পণ্য নিয়ে ব্যবসা করছে প্লাস পয়েন্ট। ঢাকায় ১৪টিসহ সারাদেশে ৩২টি শাখা রয়েছে তাদের।
বিপুল বলেন, “মানুষ এখন এইদিকেই ঝুঁকছে। আমরা ওটা মাথায় রেখেই এমআরপি ঠিক করছি। এতে করে ব্যবসায়িক লেনদেন আগের চেয়ে সহজ হয়ে আসছে।”
নগদ টাকা ও ডিজিটাল লেনদেনের ব্যবধান কেমন, জানতে চাইলে ফ্যাশন হাউজ রঙ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী সৌমিক দাস বলেন, “হারটা ফিফটি ফিফটি। ২০২০ সালে কোভিড মহামারী শুরুর আগে ডিজিটাল লেনদেনটা ছিল খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। গত চার বছরে ডিজিটাল পেমেন্টর হার ব্যাপকভাবে বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে গত দুই বছরে। এই সময়ের মধ্যে অনেক নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো।”
সারা দেশে ‘রঙ বাংলাদেশের’ ২০টি শাখা রয়েছে; সবগুলো আউটলেটেই তাদের ডিজিটাল পেমেন্টের সুযোগ রয়েছে।
প্রায় তিন দশক আগে যাত্রা শুরু করা ফ্যাশন হাউজ অঞ্জন্সের ক্রেতাদের অন্তত ৬০ শতাংশ নিয়মিত ডিজিটাল কেনাকাটায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন বলে মনে করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার শাহীন আহমেদ।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ডিজিটাল ট্রানজেকশন ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের জন্যই লাভজনক। আমাদের এখন ৬০ ভাগ কেনাকাটা ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে চলছে। বিভিন্ন ব্যাংকের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড ছাড়াও বিকাশ, নগদ রকেটের মাধ্যমে এসব পেমেন্ট হচ্ছে।
“ডিজিটাল পেমেন্টের বেশ ভালো অগ্রগতি হয়েছে গত ৩/৪ বছরে। এই সময়ের মধ্যে ডিজিটাল পেমেন্টের জন্য অনেক কোম্পানি তৈরি হয়ে গেছে। পাশাপাশি অনেক আধুনিক প্রযুক্তিও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।”
২৫ বছর আগে কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ডের প্রচলন শুরুর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তখন টেলিফোন করে ব্যাংক থেকে অনুমোদন নিয়ে ক্রেডিট কার্ডের বিল তৈরি করতে হত। এখন বেশ আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে। খুব সহজেই পেমেন্ট সম্পন্ন হয়। ক্রেতাকে আর টাকা নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে না। আমাদেরকেও বার বার ব্যাংকে যেতে হচ্ছে না। সরকারও ঠিকঠাক মত তার রাজস্ব পেয়ে যাচ্ছে।”
আগ্রহ বাড়ছে যে কারণে
একগাদা বাজার করতে গিয়ে পকেটে বেশি টাকা নিয়ে চলাফেরাকে ঝুঁকি হিসেবে দেখেন অনেক ক্রেতা। তারা বলছেন, কার্ড বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা হারিয়ে যাওয়া বা ছিনতাইয়ের ভয় নেই। বিক্রেতাকে টাকা গুনে দেওয়ার ঝামেলাও নেই। লেনদেনে সময়ও লাগে কম।
সেইসঙ্গে ডিজিটাল লেনদেনে অনেক সময় ছাড় বা ক্যাশব্যাক অফার থাকে। এসব কারণেই ডিজিটাল পেমেন্টে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বেশিরভাগ ক্রেতা।
বাজারে কেনাকাটা করতে গেলে সুযোগ থাকলেই ডিজিটালি পেমেন্ট করেন রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ইসরাত জাহান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এতে টাকা চুরি হওয়া বা হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। আবার লেনদেন ও অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রেও এক ধরনের স্বচ্ছতা থাকে। কোম্পানিগুলো ক্রেতার কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়ার পর তা আর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পায় না।
“টাকা ক্যারি (বহন) করাটা অনেক রিস্কি। সেক্ষেত্রে ডিজিটাল লেনদেনকে বেশি সুবিধাজনক মনে হয়। যখন যা কিনলাম, কার্ডে পে করে দিলাম। এতে আবার টাকা গুনে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। অনেক সময় বেশি কেনাকাটা করলে হিসাব করতে ভুল হয়ে যায়। ডিজিটাল লেনদেনে সেই সমস্যায় পড়তে হয় না।”
ফারহান আহমেদ নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলছেন, “শপিং করতে গেলে একসঙ্গে অনেক টাকা নিয়ে মার্কেটে যেতে হয়। আবার চিন্তাও থাকে টাকা চুরি হয়ে যায় কিনা। কারণ অনেক সময়ই ভিড়ে কেনাকাটা করতে হয়। এজন্য ডিজিটালি পেমেন্ট করে থাকি।
“এতে আরামসে কেনাকাটা করা যায়। কার্ডে টাকা পেমেন্ট করাটা সহজ মনে হয়। আবার যেসব ক্ষেত্রে বিকাশে পেমেন্টে অফার থাকে, সেখানে বিকাশে টাকা পেমেন্ট করি। এতে চিন্তামুক্তভাবে কেনাকাটা করা যায়।”
কার্ডে পেমেন্ট করাটাই সহজ মনে হয় মিরপুরের বাসিন্দা আবু হানিফের কাছে। তার ভাষ্য, “কিছু কিনতে গিয়ে সঙ্গে টাকা না থাকলেও পে করা যায়। প্রয়োজনে কারো কাছ থেকে ফোন করে সহজেই টাকা নিয়ে আসা যায়।
“এবার ঈদেও আমি কিছু টাকা কার্ডে পে করেছি। কেনাকাটা শেষে আমার সঙ্গে পুরো টাকাটা ছিল না, পরে বাকি টাকাটা কার্ডে দিয়ে দিই। এই সুবিধাটা না থাকলে হয়ত আমাকে টাকা তুলে আনতে হত, সময় নষ্ট হত কিংবা কেনাটাই হয়ত হত না।”
তবে ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করে ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা সমস্যায় পড়ার কথা জানালেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা এমকে রুমি।
“দেখা গেছে অনেক সময় নিজের টাকা না থাকলেও কিছু পছন্দ হলে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে গেট করে কিনে ফেললাম। মাস শেষে ক্রেডিট কার্ডের একগাদা বিল দিয়ে গিয়ে তখন টানাটানি শুরু হয়ে যায়, মনে হয় ক্রেডিট কার্ডে আর কেনাকাটা না করি।”
“তবে কিছুদিন পর বা কেনাকাটার সময় আর সেই কথা মনে থাকে না,” বলেন রুমি।
ডিজিটাল লেনদেনে অগ্রগতি কতটা?
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) ফিনটেক অ্যান্ড ডিজিটাল বেসিসের স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ফাহিম মাশরুর মনে করেন, শহরাঞ্চলের ফ্যাশন হাউজ, সুপার শপ, ইকমার্সসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানে ক্যাশলেস লেনদেন বেশ অগ্রগতি করলেও সামগ্রিকভাবে তা ৫ শতাংশের বেশি নয়।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “অনেক ক্ষুদ্র দোকান ও উদ্যোক্তারা এখনো এই সুবিধার আওতায় আসতে পারেননি। তাদের জন্য ডিজিটাল সেবা নেওয়ার খরচটাও খানিকটা বেশি রয়ে গেছে। মেইন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে…বিষয়টা এখনো ক্রেডিট কার্ড নির্ভর হয়ে গেছে। প্রতিটি ব্যাংকেরই মোবাইল অ্যাপ আছে, কিন্তু অ্যাপ দিয়ে পেমেন্টে সিস্টেম চালু হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলা কিউআর নিয়ে এসেছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো এখনো ব্যবহার শুরু করেনি।
“শুধু কার্ডের ওপর ভর করে চললে হবে না। ট্রানজেকশন কস্ট (খরচ) আরো কমাতে হবে। সেজন্য সরকারের দিক থেকে শুল্ক কমাতে হবে। প্রয়োজনে প্রণোদনা দিতে হবে। ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল সেবার আওতায় এলে সেখানে ভ্যাট-ট্যাক্সের লোকজন হানা দেয়। সেজন্য ছোট ছোট মার্চেন্টদের ভ্যাটের আওতার বহির্ভূত রাখতে হবে।”
২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সব লেনদেনের ৩০ শতাংশ ক্যাশলেস বা ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালনার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার।
সম্প্রতি ক্যাশলেস লেনদেন বাড়ানোর উপায় খুঁজতে একটি কর্মশালার আয়োজন করে বেসিস। সেখানে ক্যাসলেস পেমেন্ট বাড়ানোর জন্য কর্মশালায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।
এর মধ্যে রয়েছে গ্রাহক ও ক্ষুদ্র দোকানদার উভয় পর্যায়েই প্রণোদনা চালু করা; ক্যাশ টাকার ব্যবহার কমানোর জন্য প্রয়োজনে ক্যাশ লেনদেনের ওপর অতিরিক্ত চার্জ আরোপ করা; ব্যাংকগুলোকে শুধু বড় শহরে কাজ না করে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে কাজের সম্প্রসারণ; বাংলা কিউ আর পেমেন্ট জনপ্রিয় করতে প্রতিটি ব্যাংকে তার গ্রাহকদের জন্য মোবাইল অ্যাপ চালু করা; যাদের অ্যাপ আছে, সেগুলোর ব্যবহার বাড়ানোর জন্য আরো অনেক সহজ ও গ্রাহকবান্ধব করা।
আরো পড়ুন-