এসআইবিলের প্রতিবাদ এবং প্রতিবেদকের বক্তব্য

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক বলছে, ১৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার ব্যাক টু ব্যাক এলসি-দায়ের বিষয়টি ‘বানোয়াট ও অসত্য’।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Nov 2022, 05:46 PM
Updated : 29 Nov 2022, 05:46 PM

নিয়ম ভেঙে ‘ব্যাক-টু-ব্যাক’ এলসি খুলে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা লোপাটের বিষয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)।

মঙ্গলবার ওই প্রতিবাদলিপিতে ব্যাংকটি বলেছে, “কিছু পত্রিকায় সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি বিনিয়োগ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর, অসত্য ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ সংবাদের প্রেক্ষিতে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে, যা কারোরই কাম্য নয়।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ‘এলসিতে অনিয়ম: এসআইবিএলের সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা লোপাট’ শিরোনামে সোমবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানের বরাতে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুরের শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজের বন্ডেড ওয়্যার হাউজের লাইসেন্স হালনাগাদ করা হয়নি বহু বছর। অথচ ওই কোম্পানিকেই ৮৮৯টি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলে ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ ২৪ হাজার ডলারের পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে বন্ডেড ওয়্যার হাউজ না থাকার পরও গাজীপুরের ব্লাইথ ফ্যাশনস লিমিটেডকে ৩৫০টি ব্যাক-টু ব্যাক এলসির বিপরীতে পণ্য আনার সুযোগ দিয়েছে এসআইবিএল। এই সুবিধা নিয়ে প্রায় ৫৫ লাখ ৮ হাজার ডলারের কাঁচামাল আমদানি করেছে ওই কোম্পানি।

কিন্তু ওই পরিমাণ পণ্যের বিপরীতে সমপরিমাণ পণ্য রপ্তানি করেনি দুই কোম্পানি। ওই পরিমাণ অর্থের পণ্য তাদের ওয়্যারহাউজেও পাওয়া যায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে।

ফলে বিশাল অঙ্কের ওই দায় এখন ব্যাংকের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে, স্থানীয় অর্থমূল্যে যার পরিমাণ সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। (প্রতি ডলার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে।)

Also Read: এলসিতে অনিয়ম: এসআইবিএলের সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা লোপাট

ওই তথ্য ‘বানোয়াট’ দাবি করে এসআইবিএল এর প্রতিবাদলিপিতে বলা হয়, “মেসার্স শার্প নিটিং অ্যান্ড ডায়িং লিমিটেড ২০১৫ সালে চলতি হিসাব খুলে ব্যাংকের বনানী শাখায় লেনদেন করে আসছে। গ্রাহকের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে তাদের অনুকূলে একটি বিনিয়োগ লিমিট অনুমোদিত হয়। বর্তমানে গ্রাহকের কাছে হালনাগাদ মুনাফাসহ আমাদের পাওনা সর্বসাকুল্যে ১৬৩ কোটি টাকা। গ্রাহক নিট গার্মেন্টস ব্যবসায় জড়িত। শুরু থেকে এ পর্যন্ত তাদের অনুকূলে ৮৮১টি লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য ১৩৯ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা স্থানীয় এলসি সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর বিপরীতে বর্তমানে অনাদায়ী রয়েছে ২২ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা মাত্র। গ্রাহক ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৪৪ কোটি ২৪ লক্ষ টাকার পণ্য রপ্তানি করেছেন। এর অতিরিক্ত ১১৭ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকার প্রজেক্ট ফাইন্যান্স প্রদান করা হয়েছিল। সুতরাং ১৫৯ কোটি ১৩ লক্ষ ৭৪ হাজার ৩৯২ ডলার বা ১৬ হাজার ৬৩০ কোটি টাকার ব্যাক টু ব্যাক এলসি-দায়ের বিষয়টি একবারেই বানোয়াট ও অসত্য।

“গ্রাহক নিয়মিত দায় পরিশোধ না করায় ও ব্যাংকের দায় বকেয়া পড়ায় ইতোমধ্যেই এনআই অ্যাক্টের অধীনে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের প্রক্রিয়া চলছে। অধিকন্তু গ্রাহক বর্তমানে দায় পরিশোধের জন্য ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ রাখছেন।”

আর অন্য কোম্পানির বিষয়ে ব্যাংকের ব্যাখ্যায় বলা হয়, “ব্যাংকের মিরপুর শাখার অপর গ্রাহক ব্লাইথ ফ্যাশনস লিমিটেড এর বর্তমান দায় রয়েছে ১১ কোটি ২৮ লক্ষ টাকা মাত্র এবং ২০১৮ পর্যন্ত তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৯০ কোটি ৬৫ লক্ষ টাকা। উভয় গ্রাহকের দায়ের বিপরীতে তাদের কারখানার জমি ও ফ্যাক্টরি বিল্ডিং ব্যাংকের অনুকূলে বন্ধক রয়েছে।

“তদুপরি তাদেরকে স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল সরবরাহের জন্য লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা দেয়া হয়েছে। কোনরকম বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধা দেয়া হয় নাই। এই অবান্তর রিপোর্টের মাধ্যমে ব্যাংকের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এতে সাধারণ জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।”

প্রতিবেদকের বক্তব্য

স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক থেকে শার্প নিটিং ও ব্লাইথ ফ্যাশনসকে ব্যাক-টু ব্যাক এলসির বিপরীতে পণ্য আনার সুযোগ দেওয়া এবং নিয়মের গরমিলের বিষয়গুলো বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পরিদর্শনে উঠে এসেছে, যার ভিত্তিতে ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

বিষয়টি অবহিত করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠিও দিয়েছে বিএফআইইউ।

ওই দুই কোম্পানিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার সুযোগ দেওয়ার কথা এসআইবিএল তাদের প্রতিবাদলিপিতেই স্বীকার করেছে। এলসির যে সংখ্যা তারা সেখানে দিয়েছে, সেটাও বিএফআইইউর তথ্যের প্রায় সমান।

গ্রাহক নিয়মিত দায় পরিশোধ না করায় ও ব্যাংকের দায় বকেয়া পড়ায় মামলা করার কথাও এসআইবিএল তাদের প্রতিবাদলিপিতে বলেছে। তবে অনাদায়ী টাকার যে অংক সেখানে বলা হয়েছে, তার সঙ্গে বিএফআইইউর চিঠির পার্থক্য বিশাল।

এসআইবিএল এর দাবি অনুযায়ী, ওই দুই কোম্পানিকে স্থানীয় বাজার থেকে কাঁচামাল সরবরাহের জন্য লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা দিয়েছে তারা। এর বিপরীতে শার্প নিটিং ১৪৪ কোটি ২৪ লাখ এবং ব্লাইথ ফ্যাশনস ৯০ কোটি ৬৫ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানিও করেছে।

সেক্ষেত্রে এলসির বিপরীতে তাদের শতভাগ দায়ই মিটে যাওয়ার কথা, কারণ তাদের হিসাবে দুই কোম্পানির কাছে তাদের অনাদায়ী আছে ১৮৫ কোটি টাকা এবং রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি আয় ব্যাংকের মাধ্যমেই আসার নিয়ম। রপ্তানি আয় এলে ব্যাংকই তা নগদায়ন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মেও তাই বলা হয়েছে।

বিএফআইইউ বলেছে, ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে অধিকাংশ আমদানির বিপরীতে রপ্তানি হয়নি এবং আমদানি করা মালামালও ওয়্যারহাউজে পায়নি তাদের পরিদর্শকরা। এ বিষয়ে এসআইবিএল কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি তাদের প্রতিবাদলিপিতে। এনআই অ্যাক্টে মামলা করার কথা বললেও সেখানে কত টাকা দাবি করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য ব্যাংক দেয়নি।