এলসিতে অনিয়ম: এসআইবিএলের সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা লোপাট

বন্ডেড ওয়্যার হাউজের লাইসেন্স না থাকার পরও বছরের পর বছর ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধায় পণ্য আনার সুযোগ পেয়েছে শার্প নিটিং ও ব্লাইথ ফ্যাশনস।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Nov 2022, 06:56 AM
Updated : 28 Nov 2022, 06:56 AM

নিয়ম না মেনে দুই কোম্পানিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধায় বছরের পর বছর ধরে পণ্য আনার সুযোগ দিয়ে এখন আটকে গেছে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) প্রায় ১৫৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গাজীপুরের শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজের বন্ডেড ওয়্যার হাউজের লাইসেন্স হালনাগাদ করা হয়নি বহু বছর। অথচ ওই কোম্পানিকেই ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলে ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ ২৪ হাজার ডলারের পণ্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে বন্ডেড ওয়্যার হাউজ না থাকার পরও গাজীপুরের ব্লাইথ ফ্যাশনস লিমিটেডকে ৩৫০টি ব্যাক-টু ব্যাক এলসির বিপরীতে পণ্য আনার সুযোগ দিয়েছে এসআইবিএল। এই সুবিধা নিয়ে প্রায় ৫৫ লাখ ৮ হাজার ডলারের কাঁচামাল আমদানি করেছে ওই কোম্পানি।

কিন্তু ওই পরিমাণ পণ্যের বিপরীতে সমপরিমাণ রপ্তানি করেনি দুই কোম্পানি। ওই পরিমাণ অর্থের পণ্য তাদের ওয়্যারহাউজেও পাওয়া যায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে।

ফলে বিশাল অঙ্কের ওই দায় এখন ব্যাংকের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে, স্থানীয় অর্থমূল্যে যার পরিমাণ সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। (প্রতি ডলার ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে।)

রপ্তানিকারকরা তাদের রপ্তানি আদেশের বিপরীতে ব্যাংকে ঋণপত্র (এলসি) খুলে কাঁচামাল আমদানি করতে পারেন। রপ্তানি আদেশ দেখে গ্রাহকের পক্ষে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ‍সুবিধায় পণ্য এনে দেয় ব্যাংক।

আমদানি হওয়া পণ্যের মূল্য তখন গ্রাহকের পক্ষ থেকে ব্যাংকেই পরিশোধ করে। পরে ওই কোম্পানির রপ্তানি আয় দেশে এলে তা নগদায়ন করে ব্যাংক তার অর্থ বুঝে নেয়।

এ সুবিধা দিতে গ্রাহকের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ জামানত নেয় ব্যাংক। আর রপ্তানিকারকরা নামমাত্র শুল্ক দিয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে পারেন।

কিন্তু শর্ত হচ্ছে, কোম্পানির অনুমোদিত বন্ডেড ওয়্যারহাউজ থাকতে হবে। কোনো কারণে পণ্য রপ্তানি না হলে বা বন্ডের সুবিধা নিয়ে আনান্য কাঁচামাল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে চাইলে সাধারণ আমদানির মত উচ্চ হারে শুল্ক পরিশোধ করতে হয় কোম্পানিকে।

কাঁচামাল আমদানির ৬ মাস পরই পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সুবিধার কারণে কাঁচামাল আমদানির মূল্য পরিশোধে এক বছর পর্যন্ত সময় পায় গ্রাহক। কিন্তু রপ্তানি হয়ে গেলে তার বিপরীতে এ সুবিধা পাওয়া যায় না।

কোম্পানি পণ্য রপ্তানিতে ব্যর্থ হলে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি ‍সুবিধায় আনা পণ্যের দায় ব্যাংকের ওপর বর্তায়। ব্যাংক তখন ওই গ্রাহকের নামে ফোর্সড (বাধ্যতামূলক) ঋণ তৈরি করে।

শার্প নিটিং ও ব্লাইথ ফ্যাশনের ক্ষেত্রে অনাদায়ী ওই অর্থের পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা।

স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কারর্যালয়, বনানী ও মিরপুর শাখার মাধ্যমে শার্প নিটিং ও ব্লাইথ ফ্যাশনসকে ওই সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন এসআইবিএল এর ওই আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে নেমেছে। রাষ্ট্রের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইইউ) ওই অর্থের গন্তব্য জানতে কাজ শুরু করেছে।

পণ্য আমদানির নামে ওই পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে গেল কি না, এর সুবিধাভোগী কারা– সেসব জানতে তদন্ত করছে বিএফআইইউ। ইতোমধ্যে বিষয়টি অবহিত করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।

আর এসআইবিএল এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বলেছেন, তারা ওই গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি সম্পত্তি বিক্রি করে দায়-দেনা আদায় করার কথা ভাবছেন।

শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং

ঢাকার পাশে গাজীপুরের টঙ্গীতে পাগার এলাকায় শার্প নিটিং এন্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের বনানী শাখা সাত বছরের বেশি সময় ধরে ৮৮৯টি ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খুলে পণ্য আমদানির সুযোগ দিয়েছে শার্প নিটিংকে।

এর বিপরীতে মোট পণ্য আমদানি দেখানো হয়েছে ১৫৮ কোটি ৫০ লাখ ২৪ হাজার ডলারের। কিন্তু এক টাকার পণ্যও রপ্তানি হয়নি।

ওই সময়ে শার্প নিটিং ব্যাংকের কোনো অর্থও পরিশোধ করেনি। তারপরও ওই কোম্পানিকে নিয়মিত শুল্ক রেয়াতি সুবিধায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে কাঁচামাল আমদানি করার সুযোগ দিয়েছে ব্যাংক।

রপ্তানি না হলে আমদানি করা কাঁচামাল কোম্পানির ওয়্যারহাউজ বা কারখানায় থাকবে নয়ত, উৎপাদিত পণ্য আকারে মজুদ থাকবে। এক্ষেত্রে কোনোটিই হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লাইসেন্সিং বিধিমালা অনুযায়ী, শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে লাইসেন্সের মেয়াদ ২ বছর এবং ৫ হাজার টাকা ফি দিয়ে প্রতি ২ বছর পরপর তা  নবায়ন করতে হয়। আর পণ্য প্রস্তুতের পর ২৪ মাস এবং বিশেষ পণ্যের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরও বেশি সময় তা ওয়্যারহাউসে রাখার সুযোগ রয়েছে।

শার্প নিটিংয়ের নামে বন্ডের ওয়্যারহাউসের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল ২০০৩ সালে। এরপর তা আর নবায়ন করা হয়নি।

নবায়ন করা না হলেও ২০১৫ সাল পর্যন্ত একাধিকবার হাতবদল হয়েছে। লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ওই কোম্পানি আর বন্ডের অধীন শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

তারপরও বন্ডেড সুবিধার আওতায় শার্প নিটিংকে ব্যাক-টু-ব্যাকস এলসি ‍সুবিধায় কম শুল্কে পণ্য আমদানি সুবিধা দিয়ে গেছে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত তিন মাস ধরে পুরো বন্ধ রয়েছে শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানা। সেখানে কেবল ৭-৮ জন কর্মীকে নিরাপত্তার দায়িত্বে পাওয়া গেছে।

ব্লাইথ ফ্যাশনস

স্যোশাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ও মিরপুর শাখা থেকে একই পদ্ধতিতে ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি সুবিধা নিয়েছে গাজীপুরের বড় ভবানীপুরের গোবিন্দবাড়ি এলাকার ব্লাইথ ফ্যাশনস লিমিটেড।

কোম্পানিটি গেঞ্জি তৈরি করতে। বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লাইসেন্স না থাকলেও ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্যাক-টু-ব্যাক ৩৫০টি এলসির মাধ্যমে প্রায় ৫৫ লাখ ৮ হাজার ডলারের কাঁচামাল আমদানি করে। ওই পণ্য আমদানিতে অর্থায়ন করে প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি মিরপুর শাখাও।

ওই সময় ১২৩টি এলসির বিপরীতে কাঁচামাল আনা হয় ৬৭ লাখ ৪০ হাজার ৪১৬ ডলারের, যার মধ্যে ৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৬৩ কোটি ডলারের কাঁচামালের বিপরীতে কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি।

ওই কারখানা ও ওয়্যারহাউজ পরিদর্শনের সময়ে এক টাকা মূল্যর পণ্যও সেখানে পায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দল। পরিদর্শনের সময় কারখানাটি তারা পান বন্ধ অবস্থায়।

শার্প নিটিং অ্যান্ড ডাইংয়ের কারখানায় নিরাপত্তা কর্মী ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি। ব্লাইথ ফ্যাশনের কারখানার সামনে একটি বেসরকারি নিরাপত্তা সেবার কর্মীদের পাহারায় থাকতে দেখা গেছে।

২০১৮ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া এ কোম্পানির মালিক দুই ভাই এম সামসুল আরেফিন ও শাহরিয়ার পারভেজ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তাদের আরেক ভাই কবির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমি এখন আর ব্লাইথ ফ্যাশনে নেই। আমি যখন ছিলাম তখন এক-দেড়শ লোক কাজ করত।”

এলসির বিপরীতে আনা কাঁচামাল বা পণ্য না থাকা ও অনিয়মের বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাফর আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,“আমি গত ডিসেম্বরে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নিয়েছি। এ বিষয়গুলো আগের।

“তবে আমরা এনআই অ্যাক্টে ওই গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া শেষ করছি। ঋণের বিপরীতে জামানত রাখা হয়েছে। সম্পত্তি বিক্রি করে দায়-দেনা আদায় করা হবে।’’