বাইডেনের আশ্বাসের পরও বিশ্বব্যাপী ব্যাংকের শেয়ারে দরপতন

দুই ব্যাংকের পতনের ধাক্কায় অন্য ব্যাংকও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 March 2023, 04:24 AM
Updated : 14 March 2023, 04:24 AM

যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থা নিরাপদে আছে বলে আশ্বস্ত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংকের পতনের ধাক্কায় সোমবার বিশ্বজুড়ে ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন ঘটেছে।

মূলধন সংকট ও আমানত ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার কারণে গত শুক্রবার ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)।

তিন দিন না যেতেই রোববার নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন।

এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের এমন আতঙ্ক দূর করতে সোমবার বক্তব্য দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, ব্যাংকে গচ্ছিত গ্রাহকদের অর্থ পুরোপুরি নিরাপদ এবং সেজন্য যা যা দরকার, সবই তার সরকার করবে।

কিন্তু এই পতনের ধাক্কায় অন্য ব্যাংকও ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। আর তাতেই বিশ্বজুড়ে ব্যাংকের শেয়ারের ব্যাপক দরপতন হয় বলে জানিয়েছে বিবিসি। 

সোমবার দিনের শুরুতে স্পেনের সানতানদার এবং জার্মানির কমার্জব্যাংকের শেয়ার একটা সময় ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

ইউরোপের ব্যাংকগুলোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ব্যাংকগুলো আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের তরফ থেকে বার বার বলা হচ্ছে, এ ধাক্কা সামাল দেওয়ার মত যথেষ্ট তারল্য বাজারে আছে।

এ পরিস্থিতির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদ হার বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত করতে পারে বলে একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল রিজার্ভ সুদ হার বৃদ্ধির ওই পরিকল্পনা সাজিয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন আশ্বাস দিয়েছিলেন, সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকে যাদের আমানত রয়েছে, তারা সবাই সোমবার থেকে তাদের অর্থ তুলতে পারবেন। তাদের পুরো অর্থ যেন নিরাপদ থাকে, সরকার সেই ব্যবস্থা নিয়েছে। 

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বিশেষ করে প্রযুক্তিখাতের কোম্পানিগুলোকে ঋণ দিত। শুক্রবার ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রাহকের টাকা আটকে যায়। ফলে কর্মীদের বেতন আর ভেন্ডরদের পাওনা পরিশোধের পথ বন্ধ হয়ে যায় ওই ব্যাংকের গ্রাহক কোম্পানিগুলোর জন্য।

বিবিসি লিখেছে, তাদের উত্তর আমেরিকার প্রযুক্তি প্রতিবেদক জেমস ক্লেটন সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্কে ওই ব্যাংকের শাখার সামনে টাকা তোলার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা। ব্যাংক ইলেক্ট্রনিক ট্রান্সফার বন্ধ রাখায় তাদের চেক ভাঙিয়ে টাকা তুলতে হচ্ছিল। 

যেভাবে ডুবল দুই ব্যাংক

গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির সম্পদ ছিল প্রায় ২০৯ বিলিয়ন ডলারের এবং আমানত ছিল ১৭৫ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এর চাকা ঘোরা বন্ধ হতে থাকে গত বুধবার।

সেদিন এক ঘোষণায় জানানো হয়, কিছু সম্পদ বিক্রি করে তাদের ১৮০ কোটি ডলার ক্ষতি হয়েছে। ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী করতে ২২৫ কোটি ডলারের নতুন শেয়ার বিক্রি করবে তারা।

ওই ঘোষণার পর প্রধান কোম্পানিগুলোর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নেওয়া শুরু হয়। এতে সিলিকন ভ্যালি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপের শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ পড়ে যায়। শুক্রবার পুঁজিবাজার খোলার আগেও ৬০ শতাংশ দরপতন হয় শেয়ারের। ফলে দুই দিনে দরপতন হয় ৮৪ শতাংশ।

এ পরিস্থিতিতে সব মিলিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে শুক্রবার সকালে ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে ক্যালিফোর্নিয়া ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল প্রটেকশন অ্যান্ড ইনোভেশন।

বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে দ্বিতীয় বড় পতনের ঘটনা এটা। এর আগে ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার মধ্যে অর্থ সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংকের কার্যক্রম স্থগিত করেছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যার সম্পদমূল্য ছিল ৩০৭ বিলিয়ন ডলার।

সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের পতনে বড় ধাক্কা খায় প্রযুক্তি খাত। এর প্রভাব শুধু আমানতে নয়, ঋণ কার্যক্রম ও অন্যান্য অর্থায়নেও পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়।

এর মধ্যেই রোববার সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করে এর নিয়ন্ত্রণ নেয় ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এফডিআইসি)। 

নিউ ইয়র্কের ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বলছে, গত বছরের শেষ নাগাদ সিগনেচার ব্যাংকের সম্পদ ছিল ১১০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। হঠাৎ করে এই ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণায় বিপাকে পড়েন আমানতকারীরা।

বাণিজ্যিক ব্যাংক সিগনেচারের অফিস রয়েছে নিউ ইয়র্ক, কানেটিকাট, ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা এবং নর্থ ক্যারোলিনায়। রিয়েল এস্টেট এবং ডিজিটাল অ্যাসেট ব্যাংকিংসহ নয়টি শাখায় ব্যবসা পরিচালিত হত এ ব্যাংকের অধীনে।

গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ব্যাংকের আমানতের প্রায় এক চতুর্থাংশ এসেছে ক্রিপ্টোকারেন্সি খাত থেকে। কিন্তু ডিসেম্বরে তারা ক্রিপ্টোরস ৮ বিলিয়ন ডলারের আমানত কমানোর ঘোষণা দেয়।

গত ফেব্রুয়ারি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এক ঘোষণায় জানায়, এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জোসেফ দে পাওলো ২০২৩ সালে সিনিয়র উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করবেন এবং তার স্থলাভিষিক্ত হবেন ব্যাংকের চিফ অপারেটিং অফিসার এরিক হোয়েল। ২০০১ সালে ব্যাংকের যাত্রা শুরুর সময় থেকে দে পাওলো সিইও এবং প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং তার পরিবারের সঙ্গে সিগনেচার ব্যাংকের দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল। ট্রাম্পের ব্যবসা ও তার পরিবারের বেশকিছু ব্যবসায়িক কাজেও অর্থায়ন করেছে এ ব্যাংক। কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার পর ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

Also Read: মূলধন সংকট, যুক্তরাষ্ট্রে এক ব্যাংকের পতন

Also Read: যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দিনের মধ্যে বন্ধ আরেক ব্যাংক

Also Read: ১ পাউন্ডে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের যুক্তরাজ্য শাখা কিনল এইচএসবিসি