“দেশে অনেক বড় বড় মিল-কারখানা চলে আসছে, এগুলো আসার আগে সিন্ডিকেট জাতীয় কোনো কথা আমরা আগে শুনিনি। তখন প্রতিযোগিতায় বাজার বাড়ত এবং কমত,” বলছেন চালকল মালিকদের এক নেতা।
Published : 16 Jan 2024, 11:44 PM
মাসখানেক আগে বাজারে আমন ধান আসায় এখন চালের দাম কমার কথা। অথচ বাজারের চিত্র তা বলছে না; এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা।
আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে ক্রেতারা বিস্ময় ও ক্ষোভের পাশাপাশি অসহায়ত্বের কথা বলছেন, আর বিক্রি-বাট্টা কমে যাওয়ার কথা জানাচ্ছেন খুচরা দোকানিরা। তারা অসময়ে চালের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য চালকল মালিকদের দুষছেন।
অন্যদিকে চালকল মালিকরা বাজারে ধানের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলছেন।
এমন প্রেক্ষাপটে চালের বাজার পরিস্থিতি বুঝতে ঢাকায় চারটি গোপন অভিযানকারী দল নামানোর ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। ঢাকার বাইরে ইতোমধ্যে নওগাঁয় জেলা প্রশাসন অভিযানে নেমে অবৈধভাবে চাল মজুদ করায় এসিআই অটো রাইস মিলকে জরিমানা করেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মহাখালীর খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহখানেক আগে খুচরায় পাইজাম, স্বর্ণাসহ যেসব মোটা চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা ছিল, তা এখন ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকায়।
পাইজাম ছিল ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজি, তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা। মাঝারি মানের চালের (বিআর ২৮) কেজি ৫০ থেকে ৫২ টাকায় ছিল, যা বেড়ে হয়েছে ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা।
মিনিকেট নামে পরিচিত যে সরু চালের কেজি ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ছিল, তা এখন হয়েছে ৭০ থেকে ৭২ টাকা। সরু চালের আরেক ধরন নাজিরশাইল মানভেদে ছিল ৬০ থেকে ৭৫ টাকা, তা এখন বেড়ে উঠেছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকায়।
মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের আহমেদ বিজনেস সেন্টারের দোকানি দেলোয়ার হোসেন বলেন, “এতদিন সরু চাল বিক্রি করেছি ৬২ থেকে ৬৪ টাকা কেজি, নির্বাচনের পরে দামটা বেশি হইছে। মিলাররা দাম চাচ্ছে কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি। তারা আমাদেরকেই বলছে সরু চাল ৬৮ টাকা কেজি।
“তাদের কথা অনুযায়ী, ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে বস্তা প্রতি। দাম বাড়ার কারণে বেচা-বিক্রিও কমে গেছে। পাইজাম চাল এখনও ২৩৫০ টাকা বস্তা বিক্রি করছি আমার দোকানে; কিছুদিন আগে ছিল ২৩০০ টাকা। আর মিলাররা আমাদের কাছেই এখন চায় ২৫০০ টাকা। সেটা এখনও আনি নাই, ক্রেতা এত দামে কিনবে না।”
এ বাজারের আরেক পাইকার মাস্টার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জালাল উদ্দিন বলেন, “মিনিকেট বৈশাখের সিজনে ওঠে, এখন পাওয়া যাবে না তাই দাম বাড়ছে। এখন পাইকারি বাজারে ৬৬ থেকে ৬৭ টাকা কেজি, এক সপ্তাহ আগে ছিল ৬২ টাকা থেকে ৬৩ টাকা কেজি। মাঝারি বি আর-২৮ আগে ছিল ৪৭ থেকে ৪৮ টাকা কেজি, এখন ৫১ থেকে ৫২ টাকা কেজি।
“৭ তারিখের নির্বাচনের আগে দাম কম ছিল, নির্বাচনের পরে থেকেই দাম বাড়ছে। মোটা চাল আগে ছিল ৪১ থেকে ৪২ টাকা কেজি, এখন এটা ৪৫ থেকে ৪৬ টাকা কেজি। সুতরাং সবগুলো ৫০ কেজির বস্তায় গড়ে ২০০ টাকার উপরে দাম বাড়ছে।”
কৃষি মার্কেটে চাল কিনতে এসে ক্ষোভ ঝেরেছেন সৈয়দা রউশন আরা নামের এক ক্রেতা। তিনি বললেন, “মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির কাছে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। জীবন চলে না এভাবে।
“আয়-ইনকাম তো মানুষের বাড়ে না, খালি পণ্যের দাম বাড়ে।”
কারওয়ান বাজারে এক বস্তা চাল কিনেছেন সরকারি চাকরিজীবী আজগর আলী। থাকেন ফার্মগেইট এলাকায়।
আজগর বললেন, “আগের তুলনায় এখন বস্তা প্রতি দাম বেড়েছে ২০০ টাকার মতো। এটা খুবই হতাশার ব্যাপার। আমাদের ইনকাম কিন্ত বাড়ে না। শুধু জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। একটা নাভিশ্বাস অবস্থা পার করতেছি আমরা।”
কৃষি মার্কেটে চাল কিনতে আসা দিনমজুর শাফায়াত হোসেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বললেন, “দিনে কয় টেকা ইনকাম করি? খুব কম টেকা। এই টেকায় এই বাজারে খুব খারাপ অবস্থায় আছি।
“চাইলের দাম কেজিতে ২ থেইক্কা ৩ টেকা কমব কই, আরও ৪ থেইক্কা ৫টা করে বাড়তাছে। আসলে আমাগো দেহুনের কেউ নাই।”
ঢাকার মহাখালীর মুদি দোকানি আবুল কালাম জানান, পাইজাম এক সপ্তাহ আগে প্রতিকেজি ৫০ টাকা থেকে ৫২ টাকা ছিল, যা এখন ৫৫ টাকা থেকে ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিআর ২৮ চালও কেজিতে ৪ টাকা বেড়ে এখন ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দামও বাড়ার তথ্য দেন তিনি।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
ধানের দাম বেড়ে যাওয়া এবং শীতের কারণে চাতাল মিলগুলোর ধান শুকাতে না পারার তথ্য দিয়ে কুষ্টিয়া জেলা রাইস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুস সামাদ বলেন, “অটো রাইস মিল যেগুলো আছে তারা বাজারের চাহিদা মেটাতে পারছে না, তাই দাম বেশি। এখানে সরবরাহ ঘাটতি পড়ে গেছে।”
ধানের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ওই বৈশাখ মাসের ধান এখন এই মাঘ মাসে আইসে দাম তো একটু বাড়েই। এটা তো স্বাভাবিক।”
সরকারের গুদামে থাকা চাল দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ তার।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার কৃষক গোলাম কিবরিয়া বলেন, “ধান আগের থেকে কিছু বেশি দামে বিক্রি করছি এটা সত্য, কিন্তু এতেও তো দাম পোষাতে পারছি না। আমাদের কাছে সারসহ কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা জিনিস একটু কম দামে পৌঁছে দিতে হবে সরকারকে।
“কৃষক যদি কম খরচে আবাদ করতে পারে তাহলে দাম অটোমেটিক কমবে। খরচ বেশি হয়, লাভ কম হয়; তাই আবাদ করাও কমিয়ে দিয়েছি। এই সিজনে মাত্র দেড় বিঘা জমি চাষ করেছি। আর বর্ষার সিজনে ৪ বিঘার উপরে চাষ করি।”
আলোচনায় সিন্ডিকেট
সিন্ডিকেটের কারণে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে গত বছর খোদ দুই মন্ত্রীই স্বীকার করেছিলেন। এখন চালকল মালিকদের কেউ কেউ সিন্ডিকেটকে দুষছেন।
নওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসাইন চকদার বলছেন, “আমাদের দেশে অনেক বড় বড় মিল কারখানা চলে আসছে, এগুলো আসার আগে সিন্ডিকেট জাতীয় কোনো কথা আমরা আগে শুনিনি।
“তখন প্রতিযোগিতায় বাজার বাড়ত ও কমত। এখন রাতারাতি ১০০ টাকা বাড়ে, ১০০ টাকা কমে। আমি মনে করি বড় বড় মিল ও করপোরেট ব্যবসায়ী এজন্য অন্যতম দায়ী।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “যেহেতেু ধানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই চাউলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের নওগাঁর মোকামে পাইকারি মার্কেটে স্বর্ণা ধান ছিল ৪৪ থেকে ৪৫ টাকা কেজি, সেটির বাজার আজ ৪৬ থেকে ৪৭ টাকা। কেজিতে ২ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।
“কাটারি ধানের দাম ছিল ৫৮ থেকে ৬২ টাকা, সেটির দাম আজ ৬৫ টাকা। সর্বোচ্চ ৩ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধানের দাম কেজিতে বেড়েছে কমপক্ষে আড়াই টাকা। সে হিসেবে চাউলের দাম আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্ত আমাদের হাতে আগের ধান আছে, দুইটা এভারেজ করে বিক্রি করছি।”
ধানের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে ফরহাদ বলেন, “কৃষকরা ধান বিক্রি করে খুশি না। তাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। সারের দাম বেড়েছে, তেলের দাম বেড়েছে, আর কীটনাশক যেটা দুয়েকবার ব্যবহার করলেই হতো সেটা এখন পাঁচবারের বেশি ব্যবহার করলেও কাজ হচ্ছে না।
“আর দাম বেড়েছে দ্বিগুনেরও বেশি। কিন্ত ধানের দাম সে তুলনায় বাড়েনি। আর একজন কৃষকেরও তো সংসার চালাতে হয়।…তবে আশা করা যাচ্ছে সামনের সপ্তাহে ধানের সরবরাহ বাড়বে আর দাম স্থিতিশীল হবে।”