তারল্য সংকটে আমানতে সুদ হার বাড়াল ইসলামী ব্যাংক

“ব্যাংকিং খাতে তো একটি তারল্যের ক্রাইসিস রয়েছে, এখন এই রেট হতে পারে,” বলছেন ব্যাংকটির এমডি।

শেখ আবু তালেববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Dec 2022, 06:49 PM
Updated : 27 Dec 2022, 06:49 PM

তারল্য সংকটে পড়ে সুদ হার বাড়িয়ে ৮ শতাংশে আমানত পেতে এক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানকে প্রস্তাব দিয়েছে ঋণ অনিয়মের ঘটনায় আলোচনায় থাকা ইসলামী ব্যাংক।

চলতি সপ্তাহে এমএফএস প্রতিষ্ঠান নগদকে নতুন আমানতের উপর ৮ শতাংশ সুদ দেওয়ার ‘অফার লেটার’ পাঠায় বেসরকারি ব্যাংকটি।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং নীতিমালায় পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকগুলো সুদের পরিবর্তে ‘প্রফিট বা মুনাফা’ বলে, যার হার বছর শেষে চূড়ান্ত হয়। অর্থাৎ ব্যাংকটির মুনাফার হার বছর শেষে কত হবে, তা আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর নির্ধারণ হয়।

১২ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের ঋণ দেওয়ার অনিয়মের খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই তারল্য সংকটে ভুগতে শুরু করায় দ্রুত আমানত সংগ্রহে সুদ হার বাড়ানোর পরিকল্পনা ধরে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে ইসলামী ব্যাংক।

৮ শতাংশ ‘মুনাফা’য় আমানত সংগ্রহের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মাওলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যাংকিং খাতে তো একটি তারল্যের ক্রাইসিস রয়েছে। তারল্যের ক্রান্চ (সংকুচিত) এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন এই রেট হতে পারে।”

“আমাদের তো ইস্টিমেটেড (প্রাক্কলিত) প্রফিট রেট (মুনাফার হার) থাকে, যা বছর শেষে হিসাব-নিকেশ শেষে ফ্ল্যাকচুয়েট করে, তখন প্রফিট রেট পরিবর্তন হবে,” যোগ করেন তিনি।

তাহলে বছর শেষে মুনাফার হার কি ৮ শতাংশের কম বা বেশি হলে সে অনুযায়ী গ্রাহককে দেওয়া হবে-এ প্রশ্নের উত্তরে মুনিরুল মওলা বলেন, “হ্যাঁ, এটি পরিবর্তন হবে।”

অন্যদিকে এ বিষয়ে ‘নগদ’র হেড অব কমিউনিকেশনস জাহিদুল ইসলাম সজল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ব্যবসায়িক নীতির অংশ হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে আমানত রাখাসহ লেনদেন করে থাকে নগদ। ইসলামী ব্যাংকের প্রস্তাবে দেওয়া ৮ শতাংশ আমানতের সুদহার নিয়ে এখনও নেগোশিয়েট চলছে, চূড়ান্ত হয়নি।”

Also Read: ইসলামী ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসাল বাংলাদেশ ব্যাংক

আমানত কমে তারল্য সংকটে পড়া ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে গেছে গত জুনেই।

ব্যাংকটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে টাকা ও বিদেশি মুদ্রা মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকের নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।

আর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেওয়া অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে তা নেমেছে ৯ হাজার ৩০৭ কোটি টাকায়। ৯ মাসে নগদ অর্থের প্রবাহ কমেছে ১৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ ধারাবাহিকভাবেই কমছে গত বছরের ডিসেম্বরের পর থেকে, যা গত সেপ্টেম্বরে ঋণাত্বক পর্যায়ে পৌঁছে।

গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির শেয়ার প্রতি নিট নগদ অর্থের প্রবাহ (নিট অপারেটিং ক্যাশফ্লো পার শেয়ার) ছিল ৫৭ টাকা ৩৩ পয়সা।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইতিবাচক ধারায় থাকা শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ কিছুটা কমে গত মার্চে ছিল ২৪ টাকা ২২ পয়সা।

এরপরই গত জুনে তা আরও কমে গিয়ে ঋণাত্মক ১২ টাকা ২৯ পয়সায় চলে যায়, যা গত সেপ্টেম্বরে শেয়ার প্রতি দাঁড়ায় ঋণাত্মক ৪৫ টাকা ৬ পয়সায়।

শেয়ার প্রতি নগদ অর্থের প্রবাহ কমে যাওয়ার ব্যাখ্যায় ব্যাংকটি আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, সেপ্টেম্বরের পূর্বের প্রান্তিকে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ ও গ্রাহক কর্তৃক আমানত তুলে নেওয়ার কারণে কমেছে নগদ অর্থের প্রবাহ।

ঋণ আলোচনায় আসার পর ব্যাংকটির আমানতে টান পড়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা।

সেখানে গত ২২ ডিসেম্বর দিন শেষে ব্যাংকটির আমানতের স্থিতি ১ লাখ ৪০ হাজার ২২১ কোটি টাকার ঘরে দাঁড়িয়েছে বলে জানান ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

অথচ বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে(বিএসইসি) দেওয়া ব্যাংকটির অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুন শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা।

যেখানে গত মার্চ শেষে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা। এভাবে ইসলামী ব্যাংকের আমানতের অবস্থানগত দিক দিয়ে গত মার্চ মাসের আগের অবস্থানে চলে গেছে।

গত সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা আমানতের সময়ে ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।

এরপর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ মিলিয়ে তা আরও বেড়েছে, যা ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত হওয়ার পর জানার সুযোগ পাবেন বিনিয়োগকারীরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের বিপরীতে নগদে দৈনিক ন্যূনতম ৩ শতাংশ ও দ্বি-সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ৪ শতাংশ হারে সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) রাখতে হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

আর আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ রাখতে হয় ‘বিশেষ বিধিবদ্ধ জমা- এসএলআর ’ হিসেবে।

সিআরআর ও এসএলআর সময় মতো সংরক্ষণ করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে জরিমানার মুখে পড়তে হয় ব্যাংকগুলোকে।

তারল্য সংকটে পড়ে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর কয়েকটি সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণ করতে পারছে না।

আমানত কমে আসায় সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণে হিমশিম খাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশও। এরকম পরিস্থিতিতে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহে নেমেছে ব্যাংকটি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ইসলামী ব্যাংকের আমানতের গড় সুদ হচ্ছে ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ আর ঋণের গড় সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। স্প্রেড (আমানত ও ঋণ সুদের ব্যবধান) হচ্ছে ৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ।

গত বছরের এপ্রিল থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর আমানতের সুদহার হবে মূল্যস্ফীতির পূর্বের তিন মাসের গড়ের চেয়ে বেশি।

গত অক্টোবর শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশের উপরে। গত তিন মাস ধরেই ৮ শতাংশের উপরে রয়েছে মূল্যস্পীতি।

আর ব্যাংকগুলোতে তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ বা কস্ট অব ফান্ড ২ থেকে ৩ শতাংশ। সেখানে স্প্রেড ১ শতাংশ হলে ব্যাংক কীভাবে লাভ করবে-এমন এমন প্রশ্নের উত্তরে মুনিরুল মাওলা বলেন, “সব ধরনের গ্রাহককে আমরা ৮ শতাংশে দিচ্ছি না। সব আমানতের গড় করলে তা অনেক কমে আসবে।”