“আটটা আইআইজি একটা টাওয়ারে থাকবে, কিংবা ২৫টা আইএসপি একটা টাওয়ারে গিয়া বইসা থাকবে, দুইটা আইসিএক্স এক জায়গায় হবে, এটা কল্পনার বাইরে,” বলছিলেন মোস্তাফা জব্বার।
Published : 01 Nov 2023, 01:03 AM
রাজধানীর বহুতল এক বাণিজ্যিক ভবনে আগুন লাগার খবর আসে ২৬ অক্টোবর বিকেলে; কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিস তা নিভিয়েও ফেলে। বাঁচার চেষ্টায় নামতে গিয়ে এবং ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তিনজনের। কিন্তু সেই অগ্নিকাণ্ড যে পুরো বাংলাদেশের মানুষকে ভোগাবে তা কে জানত!
মহাখালীর ‘খাজা টাওয়ারে’ আগুন লাগার পর থেকেই ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বেশি গ্রাহকের মোবাইল অপরাটের গ্রামীণফোনের কল ড্রপ করার পাশাপাশি অন্য অপারেটরে সংযোগ পেতে সমস্যা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে গুগল ও ফেইসবুকের সেবাও বিঘ্নিত হয়েছে।
কেবল একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এত সমস্যা কেন হচ্ছে? কারণ সেখানে রয়েছে বড় কয়েকটি কোম্পানির ডেটা সেন্টার, যারা অনেকগুলো আইআইজি ও আইএসপি কোম্পানিকে সেবা দেয়। আইসিএক্স সেবার কোম্পানিও সেখানে রয়েছে, যে কারণে বিভ্রাট হচ্ছে মোবাইল যোগাযোগে। বলা হচ্ছে, দেশের মোট ব্যান্ডউইথের অর্ধেকই যাচ্ছে ওই ভবনের আইআইজিগুলোর মাধ্যমে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলছেন, ‘কানেক্টিভিটির’ জন্য গুরুত্বপূর্ণ এতোগুলো কোম্পানি যে ওই ভবনে অফিস পেতে বসেছে, তা তিনি জানতে পারেন আগুন লাগার পর!
“আগুন লাগার পর যখন আমরা সব জানলাম, তখন একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হয়েছে। প্রায় পাঁচশর মত আইএসপি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।”
এরকম একটি ভবনে সামগ্রিক এবং স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা কেন ছিল না, তা নিয়েও মন্ত্রী বিস্মিত। ক্ষতি হয়ে যাওয়ার পর এখন গুরুত্বপূর্ণ ওই ভবনের অগ্নি নিরাপত্তায় অবহেলার বিষয়গুলো সামনে আসছে।
ভবনে থাকা অফিসগুলোর কারো কারো নিজস্ব অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। সে অনুযায়ী তাদের কম বা বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আগুন লাগার পর পুরো ভবনে একসাথে কাজ করে– এমন কোনো সমন্বিত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা যে সেখানে ছিল না, সে কথা ফায়ার সার্ভিসও বলেছে।
খাজা টাওয়ারের বিভিন্ন অফিসের কর্মীরা জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর ভবনে ‘ফায়ার এলার্ম’ বেজেছে। কিন্তু তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। অনেকে জানতেনই না যে ভবনে একটি ‘জরুরি নির্গমন পথ’ বা ফায়ার এক্সিট আছে।
টেলিকম হাব
খাজা টাওয়ারের মালিকের নাম এস এম আব্দুল হক ভূঁইয়া। তিনি ঢাকাতেই থাকেন। মহাখালীতে তার আরও কয়েকটি বহুতল ভবন রয়েছে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম চেষ্টা করেও অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে আব্দুল হকের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। তবে ভবন মালিকের প্রতিনিধি জিএম মনিরুল হক বিভিন্ন তথ্য দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন।
তিনি জানান, তিন হাজার বর্গফুটের বেশি ফ্লোর আয়তনের এই ভবনের মাঝে একটি সিঁড়ি আর পেছনে একটি জরুরি সিঁড়ি রয়েছে। ভবনে ওঠা-নামার জন্য রয়েছে দুটি লিফট।
খাজা টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। দুই বছর পর ভাড়াটেরা উঠতে শুরু করেন। অবস্থানগত সুবিধার কারণে ২০১০ সালের পর বিভিন্ন আইটি কোম্পানি খাজা টাওয়ারে অফিস নিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সবার অজান্তেই খাজা টাওয়ার হয়ে ওঠে দেশের ইন্টারনেট ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সেবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র।
১৪ তলা ভবনটির প্রথম তলায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামি ব্যাংকের অফিস। বাকি ১৩টি তলায় রয়েছে তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকগুলো কোম্পানির কার্যালয়।
দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম এবং দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ তলায় সাইফ পাওয়ারটেক এবং বিভিন্ন সাবসিডিয়ারি কোম্পানির অফিস।
চতুর্থ তলায় রয়েছে গ্রামীণ ফোনের ডেটাসেন্টার, আগুনে সেটার ক্ষতি হয়েছে বেশ।
ষষ্ঠ তলায় ফার্স্ট টেলিকম, সপ্তম তলায় গ্যাটকো টেলিকমিউনিকেশনস, অষ্টম তলায় সেবা আইসিএক্স, নবম তলায় আর্থ কমিউনিকেশন, দশম তলায় ঢাকা কলো ডেটা সেন্টার, একাদশ তলায় এনআরবি টেলিকমিউনিকেশনের ডেটা সেন্টার রয়েছে।
ক্ষতি কতটা
অগ্নিকাণ্ডে ১৪ তলা ভবনটির নবম তলা থেকে উপরের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। দশম তলার ‘ঢাকা কলো’ ডেটা সেন্টার এবং একাদশ তলার এনআরবি টেলিকমের ডেটা সেন্টার– দুটোই বেশ বড়। অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) এবং ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি) এ দুটি বড় ডেটা সেন্টারের গ্রাহক।
ইন্টারনেট ট্রাফিকের জন্য আন্তর্জাতিক গেটওয়ে হিসাবে কাজ করে আইআইজি কোম্পানিগুলো। অর্থাৎ, দেশ ও বাকি বিশ্বের মধ্যে তথ্যের প্রবাহ এই গেটওয়ে দিয়েই যায়। আটটি আইআইজি সেবাদাতা কোম্পানির অফিস রয়েছে খাজা টাওয়ারে।
সাবমেরিন কেবলের মধ্য দিয়ে দেশে আসা ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ এই আইআইজিগুলো থেকে কিনে নিয়ে সারা দেশে সরবরাহ করে আইএসপি বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডাররা। খাজা টাওয়ারে রয়েছে ২৫টি বড় আইএসপির অফিস। যাদের সঙ্গে সব মিলিয়ে দেশের পাঁচ শতাধিক আইএসপি যুক্ত থাকায় খাজা টাওয়ারে আগুনের পর সারা দেশেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের সমস্যা হচ্ছে।
দুটি আইসিএক্স বা ইনটারকানেকশন এক্সচেঞ্জও রয়েছে খাজা টাওয়ারে। মোবাইলের এক অপারেটর থেকে আরেক অপারেটরে কলের ক্ষেত্রে এই আইসিএক্সগুলো আন্তঃসংযোগ হিসেবে কাজ করে। এ কারণেই খাজা টাওয়ারে আগুনের পর মোবাইলে কলের ক্ষেত্রেও সমস্যা হচ্ছিল, এখনও তা পুরোপুরি মেটেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই ভবনে প্রথমে ডেটা সেন্টার স্থাপন করে এনআরবি টেলিকম। তারা সেখানে পিওই (পয়েন্ট অব এক্সচেঞ্জ) সেবা দিত, যেখানে টেলকো অপারেটরগুলো পরস্পরের সঙ্গে (হ্যান্ডশেক) যুক্ত হতে পারে।
পরবর্তীতে সেখানে কয়েকটি আইআইজি কোম্পানি তাদের সরঞ্জাম বসায়। এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মোট ব্যান্ডউইথের ৫০ শতাংশের বেশি আসছে এই ভবনের আইআইজিগুলোর মাধ্যমে। যার কারণে সারা দেশের ইন্টারনেট ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলছেন, ডেটা সেন্টারগুলোর নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকায় মূল সরঞ্জাম ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সরঞ্জামগুলো পাশের আরেকটি ভবনে বসানোর কাজ শেষ হলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এখানের একটি ডেটাসেন্টারে গুগল ও ফেইসবুকের মত সেবার ক্যাশ সার্ভার ছিল জানিয়ে নাজমুল করিম বলেন, “ওগুলোরও তেমন সমস্যা হবে না। দ্রুত সব আপ হয়ে যাবে।”
তবে এর মধ্যেই ওই ভবনের আইটি কোম্পানিগুলো সেবাগ্রহীতারা বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। খাজা টাওয়ারের ডেটা সেন্টারগুলো বিভিন্ন কোম্পানিকে ‘ক্লাউড সেবা’ দিয়ে থাকে। সেই সেবাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এরকম একটি সেবাগ্রহীতা কোম্পানির প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডেটা সেন্টার কোম্পানি তাদের নিরবচ্ছিন্ন সেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেইভাবেই তারা বিলিং করছিল। কিন্তু আগুন লাগার পর তারা জানাচ্ছে, তাদের ব্যাকআপ সার্ভার থেকে কোনো তথ্য আপ করা যাচ্ছে না।
ডেটা সেন্টার বন্ধ থাকার কারণে তারা বিদেশের যেসব কোম্পানিকে আমদানি-রপ্তানিতে সেবা দিয়ে আসছিলেন, সেই সেবাও বন্ধ রাখতে হয়েছে, কারণ সব তথ্য ওই সার্ভারে। এখন এই ‘কস্ট অব ডাউন টাইম’ তাদেরকেই বহন করতে হচ্ছে, যা হয়ত কয়েক হাজার ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে। আর এর মধ্যে ক্লায়েন্ট ‘ছুটে গেলে’ সেটাও ব্যবসায় বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে জানালেন ওই প্রতিনিধি।
আগুন নেভানোর কী ব্যবস্থা ছিল
ভবনের দশম তলায় আর্থ গ্রুপের ‘ঢাকা কলো’ ডেটাসেন্টার ডিজাইন ও নির্মাণে যুক্ত ছিলেন ডেটাসেন্টার কনসালটেন্ট সরোয়ার মোর্শেদ পরাগ। তিনি বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সমন্বয়ে পুরোপুরি ‘কমপ্লায়েন্ট’ করে ওই ডেটা সেন্টার তৈরি করা হয়েছিল। সে কারণে ভবনে আগুন লাগলেও ডেটাসেন্টার অক্ষত রয়েছে, তবে ফাইবার কেবল পুড়ে যাওয়ার কারণে কানেক্টিভিটির সমস্যা হয়েছে।
পরাগ বলছেন, ওই ডেটাসেন্টারে আগুন শনাক্তের জন্য সিমেন্সের এসপিরেশন ফায়ার ডিটেকশন সিস্টেম বসানো ছিল। আর আগুন নেভানোর জন্য ছিল সিমেন্সেরই ‘সিনোরিক্স ২২৭ গ্যাস-বেইজড ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেম’। আগুন লাগলে এই সিস্টেম নিজে থেকে আগুন শনাক্ত করে তা নিভিয়ে ফেলতে সক্ষম।
প্রায় তিন হাজার বর্গফুটের ওই ডেটা সেন্টারে ফায়ার রেটেড ডোর ও হোল সিলিং করা। অর্থাৎ এর দরজা ও ছাদের সিলিংগুলো অগ্নিনির্বাপক সামগ্রী দিয়ে এমনভাবে তৈরি, যার কারণে এর ভেতরে ধোঁয়াও তেমন ঢোকেনি। সেই মাত্রায় ধোঁয়া না ঢোকার কারণে সিমেন্সের ফায়ার সাপ্রেসসন সিস্টেম চালুই হয়নি।
পরাগ বলেন, “খাজা টাওয়ারের মত ভবন, যেখানে অনেকগুলো কোম্পানির অফিস ও সরঞ্জাম বসানো রয়েছে, সেখানে আগুনের ওপর ঢাকা কলোর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অন্য ফ্লোরে আগুন লাগায় ঢাকা কলোর কিছু করার ছিল না, কারণ সেই ফ্লোরগুলো তাদের নয়। এই সমস্ত ভবনের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ফায়ার ডিটেকশন ও হাইড্রেন্ট ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয়।”
এত গুরুত্বপূর্ণ ভবনে টুকরো টুকরো কিছু অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকলেও সমন্বিত কোনো অগ্নিপ্রতিরোধক ব্যবস্থা ছিল না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
তিনি বলছেন, “যদি ফায়ার সেইফটি প্ল্যানের কথা বলি, তাহলে সামগ্রিকভাবে এখানে কোন ফায়ার সেইফটি প্ল্যান ছিল না। তবে বিভিন্ন ফ্লোরে আমরা ফায়ার এক্সটিংগুইশার পেয়েছি, সেগুলো কার্যকর ছিল। এখানে থাকা ব্যাটারি, প্রচুর কেবল-সুইচ অফিসগুলোর সুসজ্জিত ‘ইন্টেরিয়র’ আগুন জ্বলতে বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। যার জন্য এখনো আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে।”
ডেটা সেন্টার ডিজাইন কনসালট্যান্ট পরাগ বলেন, ডেটা সেন্টারের জন্য বিশেষ ধরনের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। সাধারণ স্প্রিংকলার (পানি ছেটানো) ব্যবস্থা এখানে ব্যবহার করা যায় না। এখানে ব্যবহার করা হয় গ্যাস ভিত্তিক অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া শনিবার সকাল থেকে খাজা টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে ডেটা সেন্টারের মালামাল সরানোসহ অন্যান্য কাজের তদারকি করছিলেন।
তিনি বলেন, “ডেটা সেন্টারগুলো ‘ফায়ার প্রটেক্টেড’ ছিল। অফিসগুলো পুড়লেও ডেটাসেন্টারগুলোতে আগুন লাগেনি। আমাদের ডেটা সেন্টারের একটা ডিভাইসও পোড়েনি। তবে কানেক্টিভিটি কেবলগুলো নষ্ট হয়েছে। এখানে ব্যাকআপ জেনারেটরও রয়েছে, প্রথম দিন থেকেই সেটি দিয়ে কাজ করা সম্ভব ছিল।”
পাশের আরেকটা ভবনে ডেটাসেন্টারের যন্ত্রপাতিগুলো বসানো হচ্ছে জানিয়ে নাজমুল বলেন, “ডেটা সেন্টারে যাদের প্রডাক্ট ছিল, দুই একটা ছাড়া তেমন কোন সমস্যা হয়নি। ‘ঢাকা কলো’ একেবারেই অক্ষত রয়েছে। এনআরবিরও তেমন কিছু পোড়েনি, হাতে গোণা দুই-তিনটা ডিভাইস নষ্ট হয়েছে। তাও সেগুলো ধোঁয়া ও আগুন নেভাতে ছোঁড়া পানির কারণে নষ্ট হয়েছে।”
এনআরবি টেলিকমের ডেটাসেন্টার ভাড়া নিয়ে কার্যক্রম চালানো উইন্ডস্ট্রিম কমিউনিকেশনের মালিক মাহাবুব আলম বলেন, আগুনে ডেটাসেন্টার পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি, তবে ক্ষতি একেবারে কমও হয়নি। এখন সরানোর কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
মন্ত্রীর বিস্ময়
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমরা কখনো ভাবতেই পারিনি… এটা আমাদের জন্য বিস্ময়কর যে আটটা আইআইজি একটা টাওয়ারে থাকবে, কিংবা ২৫টা আইএসপি একটা টাওয়ারে গিয়া বইসা থাকবে, দুইটা আইসিএক্স এক জায়গায় হবে, এটা কল্পনার বাইরে।
“আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায় বলব, কখনো ভাবিই নাই এ ধরনের কনসেনট্রেশন হতে পারে এক জায়গায়। আমাদের কেউ বিন্দুমাত্র কিছু জানাননি যে এই জায়গাটার মধ্যে আমাদের কানেক্টিভিটির এতগুলো অর্গানাইজেশন আছে। তাহলে হয়ত আমরা বিটিআরসিকে ইনভলভ করে চেকআপ করতাম। এখানে যারা আছেন সবাই কিন্তু আমাদের লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করেন। কিন্তু আমাদের কোনো ধারণাই ছিল না যে একটা টাওয়ারের মধ্যে এরকম একটা কনসেনট্রেশন হয়েছে।”
মন্ত্রী বলেন, “কে কোথায় অফিস করতেছে এবং তার অফিসের নিরাপত্তা কী আছে সেটা কিন্তু আমাদের দেখার বিষয় না। কিন্তু এই ধরনের এতোগুলো ইনস্টলেশন এক সাথে, ওরা চাইলে এটাকে ‘কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন (কেপিআই)’ ঘোষণা করে নিরাপত্তা দিতে পারতাম। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ করে নাই।”
বহুতল বাণিজ্যক ভবনে বহু কোম্পানির অফিস থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খাজা টাওয়ারে যে ধরনের কোম্পানিগুলো অফিস পেতে বসেছে, সেখানেই তৈরি হয়েছে বিপদ।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, “অন্য দশটা অফিস থাকা আর কানেক্টিভিটি রিলেটেড অফিসগুলো থাকা এক জিনিস না। আপনারা দেখেন বঙ্গবাজারে এর চেয়ে বহুগুণ বড় আগুন লেগেছিল। কিন্তু বঙ্গবাজারের কনজিউমার প্রোডাক্ট এফেক্টেড হয়েছে। আর আমাদের এখানে পুরো দেশের কানেক্টিভিটি এফেক্টেড হয়েছে।
“আইসিএক্স দুটো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে মোবাইল কানেক্টিভিটিরও সমস্যা হচ্ছে। গ্রামীণ ফোন আমাকে জানিয়েছে যে তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই আগুনে। কিন্তু এখানে সরকারের কিছু করণীয় ছিল না।”
মন্ত্রী বলেন, “এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ ইনস্টলেশন। এখানে এমন সব ব্যবস্থা থাকা উচিৎ ছিল যে ধোঁয়া দেখামাত্র আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠবে। এরকম একটা ব্যবস্থা থাকাতো স্বাভাবিক। এটাতো বড় কিছু না। আর এখনকার দিনে এগুলো কোনো হাইফাই টেকনোলজি না। সেই টেকনোলজি কেন তারা ব্যবহার করল না এটা আমরা বুঝি না।”
যে কোম্পানিগুলোর অফিস খাজা টাওয়ারে আছে, তারা কেউ আর্থিকভাবে দুর্বল নয় মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “তারা নিজেরাই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার মত আর্থিকভাবে যথেষ্ট সক্ষম। এরা কিন্তু স্টার্টআপ না, এরা প্রত্যেকেই মার্কেটে প্রতিষ্ঠিত।
“তবে নরমালি যেটা হয়ে থাকে, যেখানে জুতার দোকান হয় সেখানে জুতার মার্কেট হয়ে যায়। যেখানে চশমার দোকান চলে সেখানে একই পণ্যের বাজার হয়ে যায়। মানে ওখানে ব্যবসাটা ক্লিক করেছে, বাকিরা ওখানে গিয়ে যুক্ত হয়েছে। ওরা তো পরস্পর রিলেটেডই থাকে। একজন হয়ত বলছে যে এখানে সব সুবিধা ঠিকমত পাওয়া যাচ্ছে, আরেকজন সেটা শুনে সেখানে গিয়েছে। সে ফায়ারের কথা হয়ত চিন্তাই করেনি।”
খাজা টাওয়ারের আগুনকে ‘বড় ধরনের সতর্ক সংকেত’ হিসেবে দেখার কথা জানিয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, “এরপর আমরা খোঁজ খবর নেব, কার কোথায় অফিস হচ্ছে, সেখানে নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা।”
ফায়ার এলার্ম বেজেছিল, তবু…
এরকম একটি বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, যেখানে বৈদ্যুতিক উৎস আর দাহ্য বস্তুর ছড়াছড়ি, সেখানে কেন সমন্বিত অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না, সে প্রশ্নের স্পষ্ট কোনো উত্তর মেলেনি মালিক পক্ষের কাছে।
ভবনের মালিকের প্রতিনিধি জিএম মনিরুল হক বলছেন, ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম ব্যবস্থা ছিল এবং আগুনের সময় সেটা কাজও করেছে। তাছাড়া ভবনে ফায়ার হোস পাইপ, এক্সটিংগুইশার সবকিছুই দৃশ্যমান স্থানে ছিল।
কিন্তু সেখানে বিভিন্ন অফিসে কর্মকর্তারা জানালেন, ফায়ার ড্রিলের অভিজ্ঞতা না থাকায় তাদের অনেকেই ফায়ার অ্যালার্ম বাজার পরও প্রথমবারেই সাড়া দেননি।
নয় তলার রেইস অনলাইন লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা জানান, তিনি নয় তলায় তাদের কক্ষে বসে কাজ করছিলেন। তাদের অফিস ফ্লোরের মধ্যে অনেকগুলো কম্পার্টমেন্ট বানানো। এরকম একটি কম্পার্টমেন্টে বসে কাজ করছিলেন তারা, যেখানে বাইরের শব্দ তেমন শোনা যায় না। ফায়ার অ্যালার্ম বাজার পর তাদের একজন সহকর্মী সেটা খেয়াল করেন। আরেকজনকে বিষয়টি দেখতে পাঠানো হয়। তিনি ফিরে এসে জানান আগুন লেগেছে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে।
ততোক্ষণে কক্ষের সিলিঙের ওপর থেকে ঘরে ধোঁয়া ঢুকতে শুরু করেছে। দ্রুত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তারা যখন নামার জন্য সিঁড়ির দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেন, ততোক্ষণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো সিঁড়ি।
কেউ একজন তখন জানায়, ভবনে একটি ‘ফায়ার এক্সিট’ আছে। তিনি বিষয়টি দেখতে গিয়ে আর ফেরেননি। পরে ওই ব্যক্তিকে ওপর থেকে নিচে রাস্তায় দেখতে পেয়ে ফোন করলে তিনি জরুরি সিঁড়িটির পথ বাতলে দেন।
ওই ব্যক্তি বলেন, “আমাদের ফ্লোরে দুইশর মত মানুষ থাকে। ফায়ার এলার্ম বাজছে যখন বুঝতে পারছি তখন আর সময় ছিল না। আমাদের অন্য ডিপার্টমেন্টের লোকেরা নেমে গেছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি। আমাদের ঘরটা একদম বদ্ধ ঘর, অফিসের ভেতরের শব্দও ওখানে শোনা যায় না। আমরা যখন ফায়ার এলার্ম শুনেছি তখন নিজেরা বলছিলাম ‘এটা সিসের সাউন্ড’। আমি দৌড়ায়া সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে না পেরে ব্যাক করছি।”
তিনি বলেন, “পুরা অফিস ধোঁয়ায় ভইরা গেল। আমরা শ্বাস নিতে পারতাছিলাম না। পরে একটি লোহার পাইপ দিয়ে চারপাশের কাচ ভাঙলাম। নাইলে তো আমারে এইহানে দেখতেন না। পরে ফায়ার সার্ভিস আইসা চারতলায় কিছু কাজ করছে, তাতে ফায়ার এক্সিটের ধোঁয়া একটু কমলে আমরা সেদিক দিয়া বাইর হইছি।”
নয়তলায় কর্মরত আরেকজন নারী আগুন লাগার পরপর ফুটপাথে বসে বসে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, আগুন লাগার সময় তিনি গিয়েছিলেন ওজু করতে, আসরের নামাজ পড়বেন। বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখেন পুরো অফিস ধোঁয়ায় ভরা। এরপর অনেক কষ্টে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ফায়ার এক্সিট দিয়ে তিনি নেমে আসেন।
অগ্নিকাণ্ডের দিন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছিলেন, ‘বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে’ খাজা টাওয়ারে আগুনের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।
তবে এ বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলতে রাজি নয় ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি।
তদন্ত দলের সদস্য সচিব ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, ভবনের ১৩ ও ১৪ তলা সবচেয়ে বেশি পুড়েছে। নিচের তলাগুলোতে তেমন ক্ষতি হয়নি। তারা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেননি।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক ছালেহ উদ্দিন বলছেন, মহাখালীর এই ভবনটি 'কমপ্লায়েন্ট' হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। সেখানে ফায়ার ড্রিলও হয়েছে।
“কিন্তু জরুরি অবস্থায় তারা সেগুলোর কোনোটাই কাজে লাগাতে পারেননি। বিষয়টা হচ্ছে যে আপনার কাছে অস্ত্র আছে কিন্তু আপনি সেটা সময়মত চালাতে পারেননি।"
এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন বনানী থানার ওসি মোস্তাফিজুর রহমান।