এর সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে আনাদায়ী অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদনে।
Published : 11 Jul 2024, 10:14 AM
আর্থিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা থাকার পরও পর্ষদ সভার সিদ্ধান্ত না মেনে ঝুঁকি নিয়ে পিপলস লিজিংয়ে বিনিয়োগ করে সুদে-আসলে ৬৩ কোটি টাকা ‘ধরা খেয়েছে’ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক।
মেয়াদ শেষ হওয়ায় এই টাকা এখন অনাদায়ী হয়ে আছে বলে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি জাতীয় সংসদে জমা দেওয়া হয়েছে।
পিপলস লিজিংয়ে এই টাকা বিনিয়োগের সময় সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও ছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।
ব্যাংকটির বর্তমান সিইও মো. আফজাল করিম নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হলেও বলেছেন, টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা চলছে।
সংসদে জমা দেওয়া কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মো. নুরুল ইসলামের সই করা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, পিপলস লিজিংয়ে ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে ও ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাতটি এফডিআর এর মাধ্যমে ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে ৪০ কোটি এবং কল লোন খাতে ১৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সোনালী ব্যাংক। এ বিনিয়োগে ব্যাংকটির তৎকালীন এমডি ও সিইও ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের অনুমোদন ছিল।
২০১৯ সালের ২১ জুলাইয়ে এসে ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে সুদ-আসলসহ পিপলস লিজিংয়ের কাছে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪৫ কোটি ২ লাখ টাকা। আর ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত পিপলস লিজিংয়ে কল লোন খাতে বিনিয়োগ থেকে সুদ-আসলে ১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা পাওনা ছিল সোনালী ব্যাংকের।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে দুই খাতে বিনিয়োগ করে সোনালী ব্যাংকের মোট ৬৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা গচ্চা যেতে বসেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই অবস্থা হয়েছে ‘অনিয়মের কারণে’। এর সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে আনাদায়ী অর্থ আদায়ের ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে সেখানে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক যখন ৬৩ কোটি ৯১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে, তখন ঝুঁকির বিচারে (স্ট্রেস টেস্টিংয়ে) পিপলস লিজিং ছিল ‘রেড জোনে’, অর্থনৈতিক লেনদেনেও (ফিন্যান্সিয়াল পারফর্মেন্সও) ছিল দুর্বল।
১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরুর পর থেকে গ্রাহকের কাছ থেকে মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা ধার করে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (পিএলএফএসএল)।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন। পিপলস লিজিং এগুলোর একটি।
পি কে হালদার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই, অর্থাৎ ২০১৫ সালের পর থেকে অনিয়ম ও ঋণ জালিয়াতির কারণে কোম্পানির অবস্থা ধারাবাহিকভাবে খারাপ হতে থাকে। খেলাপি প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা আদায় করতে না পেরে আমানতকারীদের টাকাও তারা ফেরত দিতে পারেননি। এই ঋণ কেলেঙ্কারির ‘হোতা’ পি কে হালদার ভারতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন সেখানকার জেলে আছেন। দেশেও তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা চলছে।
২০১৯ সালের ১৪ জুলাই পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের জন্য আদালতে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই দিনই মামলার শুনানি শেষে অবসায়নের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয় আদালত।
পরে আমানতকারীদের আন্দোলনের মুখে ২০২১ সালের জুন মাসে শুরু হওয়া অবসায়ন প্রক্রিয়া স্থগিত করে কোম্পানি পুনরুজ্জীবিত করতে ১০ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয় উচ্চ আদালত। সেই সঙ্গে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাসহ পর্ষদের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানকে একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে পিপলস লিজিংয়ের অপারেটিং প্রফিট ছিল ঋণাত্মক ৩০ দশমিক ৫৫ কোটি টাকা, নেট প্রফিটও ছিল ঋণাত্মক ৪৯ দশমিক ৩৬ কোটি টাকা। তখন শ্রেণিকৃত ঋণ ছিল ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
এ অবস্থার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ‘দুর্বল’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়।
সোনালী ব্যাংকের স্বার্থের বাইরে গিয়ে দুর্বল আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়মিতভাবে ফান্ড প্লেসমেন্ট ও কল লোন খাতে বিনিয়োগ করা হয় বলে অডিটর জেনারেল পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।
প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে পিপলস লিজিংয়ের ক্যামেলস রেটিং ছিল ৪ (প্রান্তিক)। ফলে ক্যামেলস রেটিং অনুযায়ী বিভিন্ন আর্থিক প্যারামিটারে কোম্পানির আর্থিক ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা অসন্তোষজনক ও প্রান্তিক হওয়া সত্ত্বেও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করা হয়েছে।
ব্যাংকিং কার্যক্রমের মূলধন পর্যাপ্ততা, সম্পত্তির গুণমান, ব্যবস্থাপনা, আয় ও তারল্য- এ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার ওপর নির্ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্যামেলস রেটিং করে থাকে। আবার পাঁচটি শ্রেণিতে এই রেটিং করা হয়, যেখানে শক্তিশালী রেটিংয়ের প্রতিষ্ঠানকে রাখা হয় ১ নম্বরে। এভাবে সন্তোষজনক হলে ২, ভালো হলে ৩, মোটামুটি হলে ৪ ও অসন্তোষজনক হলে সেই প্রতিষ্ঠানের রেটিং হয় ৫।
২০১৬ সালে সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের ৪৯৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিবেদন ও ক্রেডিট রেটিং অনুযায়ী আর্থিক বিবরণী এবং ক্যামেলস রেটিং বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পর্ষদের ওই সিদ্ধান্ত পরিপালন না করে দুর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে।
কেন দুর্বল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হল, অডিট অধিদপ্তরের প্রশ্নে তখন সোনালী ব্যাংকের বক্তব্য ছিল, বিভিন্ন সূচক অবনমিত হওয়া শুরু হলে তাদের অনুকূলে নতুন বিনিয়োগ না করে ২০১৭-২০১৮ পর্যন্ত সময়ে এফডিআর বাবদ ৪০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগকৃত অর্থ আদায় করার পর ৪০ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ নবায়ন করা হয়। বিদ্যমান বিনিয়োগ আদায়ের লক্ষ্যে উকিল নোটিস দেওয়া হয়। পরে কোম্পানি অবসায়নে গেলে পর্যায়ক্রমে পাওনা ফেরত দেবে বলে জানায় তারা।
তবে অডিট অধিদপ্তর সোনালী ব্যাংকের এই জবাবকে আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য ‘সহায়ক নয়’ বলে সিদ্ধান্তে আসে, যা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে।
অডিটর জেনারেলের দপ্তর বলছে, ২০১৬ সালে অপারেটিং প্রফিট, নেট প্রফিট ঋণাত্মক এবং শ্রেণিকৃত ঋণ বেশি হওয়ার পরও সোনালী ব্যাংকের স্বার্থ বিবেচনায় না নিয়ে দুর্বল প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, এসব বিষয় জানিয়ে সোনালী ব্যাংকের প্রধানকে এআইআর জারি করা হয়, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবকে অবহিত করা হয়। এ বিষয়ে কোনো জবাব না পেয়ে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাগিদপত্র দেওয়া হয়। জবাব না পাওয়ায় ২০২২ সালের ৮ মার্চ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে আধা সরকারিপত্র দেওয়া হয়, তবে এবারও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে “উল্লিখিত অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণসহ অনাদায়ী অর্থ আদায় করা আবশ্যক” বলে সুপারিশ করেছেন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল নূরুল ইসলাম।
পিপিলস লিজিংয়ে বিনিয়োগের জন্য নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী দায় যাচ্ছে সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি মাসুদের ঘাড়ে। এ বিষয়ে তার অবস্থান জানতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও ফোন ধরেননি তিনি। পরে মোবাইল ও হোয়টসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সোনালী ব্যাংকের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আফজাল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অডিট অবজারভেশন নিয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই।
অর্থ আদায়ের বিষয়টি কোন পর্যায়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে সব রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যেখানে অনিয়ম হচ্ছে, সেখানে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনিয়ম প্রমাণ হলে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগেও এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতেও নেওয়া হবে।”