মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের মঙ্গলবার বৈঠকে ডেকেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
Published : 14 Nov 2023, 12:25 AM
ব্যাংকের পাশাপাশি খোলা বাজারের জন্যও বাফেদা-এবিবি দর নির্ধারণ করে দিলেও সেই দরে ডলার মিলছে না মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোতে। এমনকি বাড়তি দরেও অনেক ক্রেতা চাহিদা অনুযায়ী ডলার না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
তবে ঢাকার মতিঝিল ও পল্টনে মানিচেঞ্জার কোম্পানিগুলোতে না মিললেও এর আশপাশে ভ্রাম্যমাণ ডলার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে ঠিকই আরও চড়া দামে পাওয়া যাচ্ছে ডলার। এতে খোলা বাজার হিসেবে পরিচিত মানি এক্সেচেঞ্জ ও ভ্রাম্যমাণ এসব বিক্রেতাদের কাছে ডলারের ভিন্ন দর হয়ে গেছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রবি ও সোমবার মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোতে ডলার বিক্রির দর ছিল বিক্রিতে ১১৭ টাকা এবং কেনায় ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা। মানি চেঞ্জারের বাইরে ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতারা সোমবার ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১২৫ টাকা ৫০ পয়সায় ডলার কেনাবেচা করেছেন। এর আগে ২০২২ সালের অগাস্টে এ দর উঠেছিল সর্বোচ্চ ১২১ টাকায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ মানি চেঞ্জারগুলোর জন্য নিয়মিত ডলারের দর নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এরপরও গত দুই দিনে আনুষ্ঠানিকভাবেই সংগঠনের সদস্য মানি চেঞ্জারগুলোর মধ্যে ডলারের দরে অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এর বাইর গত কয়েক দিন ধরেই ডলার দরে উথাল-পাতাল চলছে। হঠাৎ করেই বাড়ছে এবং দুদিন পর কমে যাচ্ছে।
গত রোববার দুই দফায় ডলারের দর দেওয়া হয় সংগঠনের পক্ষ থেকে; দুপুরের পর দ্বিতীয় দফায় দর তিন টাকা বাড়িয়ে বিক্রয় দর করা হয় সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা। সেদিন ক্রয় দর ঠিক করে দেওয়া হয় ১১৭ টাকা।
সোমবার সকালে সেই দর আরও কমিয়ে বৃহস্পতিবারের দরে ফিরিয়ে আনে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন। সোমবার ১১৭ টাকায় বিক্রি ও ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে কেনার নির্দেশনা দেওয়া। তবে ওই দরে কেনাবেচা হয়নি বেশিক্ষণ।
মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হেলাল শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘রোববার দুপুরে দ্বিতীয়বার বাফেদা দর দেওয়ায় আমরাও দর বাড়িয়ে ১১৮ টাকা ৫০ পয়সা বিক্রি এবং ১১৭ টাকা কেনার রেট জানিয়ে দেই সদস্যদের। আমরা ভেবেছিলাম ডলারের দর বাড়ানোর উদ্যোগ এটি। সোমবার সকালে তা বাদ দিয়ে ডলারের দর কমানোর নির্দেশনা আসে।’’
তিনি বলেন, ‘‘রোববার বিকালে এজন্য মানি চেঞ্জারগুলোতে ডলারের রেট বেড়ে যায়। সোমবার ফের দাম কমিয়ে কিনতে ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা ও বিক্রিতে ১১৭ টাকা করতে সদস্যদের চিঠি দিয়েছি।’’
গত কয়েকদিন ডলারের দর এমন হার কমা ও বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার ফের মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের বৈঠকে ডেকেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতা কমাতে ১৬টি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন গভর্নর।
মানি চেঞ্জার কোম্পানিগুলোর ডলারের উৎস হচেছ বাংলাদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি পর্যটক ও প্রবাসী। সময় বেশি, কাগুজে প্রক্রিয়া পূরণ করা ও বেশি দর পাওয়ায় ব্যাংকের পরিবর্তে এ বাজারেই ডলার বিক্রি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তারা। তবে এখন সেখানেও ডলারের সরবরাহ কমে যাওয়ায় দরে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে গভর্নরের ওই বৈঠককে কেন্দ্র করে ডলারের দর ফের বাড়বে বলে গুঞ্জন উঠেছিল। এতে খোলা বাজারে ডলার বিক্রি প্রায় বন্ধ রাখে মানি এক্সচেঞ্জগুলো। সেই গুঞ্জনের রেশ ধরে গত রোববার দুপুরের পরও ডলারের দর বাড়ে।
তবে সেই বর্ধিত দর ও সোমবারের কমিয়ে আনা দরেও কোনো ডলার কিনতে পারেনি ঢাকার পল্টনের মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান নিউট্রাল মানি এক্সচেঞ্জের বিক্রয়কর্মী শরীফ আক্তার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘এখন পাসপোর্ট ছাড়া ডলার ক্রয়-বিক্রয় কোনোটাই করতে পারি না- সরকারের নির্দেশ। এজন্য আগে যা ডলার পাওয়া যেত-এখন তাও পাওয়া যায় না। বাইরে বেশি দাম হওয়ায় সমিতির দেওয়া দামে কেউ ডলার বিক্রি করতে আসে না।’’
পাফ মানি এক্সচেঞ্জের পরিচালক ফারুক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ডলার নেই। অ্যাসোসিয়েশন যে দর ঠিক করে দেয় তা নিয়েই বসে আছি। কম্পিউটাল খুলে বসে আছি। পাইলে যা কিনি-তাই বেচে দেই, না পাইলে তো বিক্রি করুম ক্যামনে।’’
ডলারের দরে অস্থিরতা চলছে বেশ অনেক দিন ধরেই। কোভিডের প্রভাব কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার মধ্যে ইউক্রেইন-রাশিয়ার যুদ্ধের পর আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের দর চড়তে থাকে। এখনও তা কাটেনি।
সম্প্রতি বাজারভিত্তিক করার অংশ হিসেবে ডলারের দর নির্ধারণ বাফেদা ও এবিবির উপর ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর চাহিদা অনুযায়ী ডলারের দর আরও বাড়তে থাকে। সেই থেকে ব্যাংকের সঙ্গে খোলা বাজারে এখনও ডলারের দর বাড়ছে কিছু দিন পরপরই।
বিনিময় হার একটি কাঠামোতে আনতে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন মেনে ব্যাংকের জন্য ডলারের দর ঠিক করে দিচ্ছে বাংলাদেশ ফরেইন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশ (এবিবি)।
ব্যাংকের পাশাপাশি মানি চেঞ্জারদের জন্যও ডলারের দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত মেনে তখন থেকে বাফেদা’র দেওয়া ডলার দর দেখে খোলা বাজারে দর র্নিধারণ করে সদস্যদের প্রতিদিন সকালে জানিয়ে দিচ্ছে মানি চেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন।
সেই সিদ্ধান্তের ৯ মাস পর গত মে মাসে ব্যাংকের সঙ্গে খোলা বাজারে ডলারের দরের ব্যবধান ১০ টাকা থেকে কমে আড়াই টাকায় নেমেছিল। এরপর ফের তা বাড়তে শুরু করে।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে রেমিটেন্স ছাড়া ডলার কেনা হচ্ছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় এবং বিক্রয় দর সর্বোচ্চ ১১১ টাকা। রেমিটেন্সে প্রণোদনাসহ সর্বোচ্চ দর ১১৬ টাকা।
ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সোনালী ও রূপালী ব্যাংকে নগদ ডলারের বিক্রয় দর ছিল ১১৩ টাকা ২৫ পয়সা। বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট (এমটিবি) ব্যাংক বিক্রি করেছে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সা ও ব্র্যাক ব্যাংকে তা ছিল ১১৫ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ হিসাবে খোলা বাজারে ডলারের বিক্রয় দর হওয়ার কথা সর্বোচ্চ ১১৬ টাকা ৫০ পয়সা। কিন্তু বাফেদা মানিচেঞ্জারদের জানিয়েছে ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনে ১১৭ টাকায় বিক্রি করতে।
এরপরও গত শনিবার নির্ধারিত দরে ডলার না পেয়ে ফের সোমবার রাজধানীর পল্টন এলাকার মানিচেঞ্জারগুলোতে ঘুরেছেন শবনম আক্তার। চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতে ছোট ভাইকে সঙ্গে করে ডলার কিনতে এসেছেন অবরোধের মধ্যে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘ফোন করে সময় নিয়ে আসছি দুইবারই। এখানে এসেও ডলার পেলাম না। শুনেছি দাম বেড়েছে-কিন্তু বোর্ডে তো লেখা ১১৭ টাকা।’’
তিনি বলেন, ‘‘বাইরে রাস্তায় ১২৫-১২৬ টাকা চাচ্ছে এক ডলারে। নেওয়ার সাহস করছি না, না জানি কারও প্রতারণার মধ্যে পড়ে যাই কি না।’’
পল্টনের ওয়েস্টার্ন মানি চেঞ্জারের বিক্রয় কর্মী আমিন উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমাদের কাছে সরকারের দেওয়া দরে ডলার পাওয়া যাবে না। বাইরে এখন ডলার বিক্রি হচ্ছে বেশি দরে। যে যেভাবে পারছে বিক্রি করছে। আমরা তো শুধু পাসপোর্ট দেখে বিক্রি করি যা পারি। আইজকাল কোনো বিক্রি-বাট্টা নাই।’’
গুলশান ২ এর লর্ডস মানি চেঞ্জারের পরিচালক হাসান জামিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘আমরা সরকারের ঠিক করা ১১৭ টাকা দরেই ডলার বিক্রি করছি পাসপোর্টে এন্ডোর্স করে। ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা দরে কিনতে পারলে ১১৭ টাকাই বিক্রি করছি। এখন তো ডলার বিক্রি করতে শুধু কিছু বিদেশিরাই আসেন।’’