জমছে পশুর হাট, বাড়তি দামে পরের দিনের অপেক্ষাও

হাট থেকে হাটে বিস্তর ঘোরাঘুরি আর দেখাদেখি শেষে দরদামে বনিবনা হওয়ায় কেউবা কিনে ফেলছেন বাজেট একটু এদিক সেদিক করে; অনেকে আবার রাতে কিংবা শনিবার ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় কোরবানির পশুর হাট ছাড়ছেন। কারণ এবার দাম বাড়তি ঠেকছে তাদের কাছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2022, 02:52 PM
Updated : 8 July 2022, 03:31 PM

শুক্রবার আনুষ্ঠানিক বিক্রি শুরুর দুইদিন পর কোভিড মহামারীর দুই বছরের বিরতি শেষে রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে সেই চিরচেনা ভিড় আর হৈ হল্লা যেন ফিরে এসেছে।

ঢাকার সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীসহ বেশ কিছু হাট ঘুরে দেখা যায়, ক্রেতা বিক্রেতাদের হাঁকডাকে জমে উঠেছে কেনাবেচা। একের পর এক ক্রেতা দর্শনার্থীদের সঙ্গে অনবরত দামদর চলছে বেপারি, খামারি কিংবা ঈদকে কেন্দ্র করে মৌসুমী গরু ব্যবসায়ীদের।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার দাম বেশি থাকায় বেশির ভাগই মাঝারি ও ছোট গরুর খোঁজ করছেন। পশুর দড়ি হাতে নিয়ে যারা হাট থেকে ফিরছেন তারাও জানাচ্ছেন মাঝারি আকারের গরু কেনার তথ্য।

রাজধানীর ওয়ারী থেকে কলেজ পড়ুয়া একমাত্র ছেলে নিয়ে গাবতলী পশুর হাটে এসেছেন ইসলামপুরের কাপড়ের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "গতকাল (বৃহস্পতিবার) খোকা মাঠ, কমলাপুর ঘুরেছি। গরু পছন্দ হয়, দাম বেশি থাকায় কিনতে পারি নাই। আজকে এসেছি গাবতলী, এখানেও একই অবস্থা। আসছিলাম বড় গরু কিনতে এখন মাঝারি আকারের দেখছি।“

একটি গরু দামদর করার সময় কথা হয় আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, "মাঝারি আকারের এই গরুটা তারা আড়াই লাখ চাচ্ছে, আমি ১ লাখ ৯৫ হাজার বলেছি। আর বাড়ানো সম্ভব না।

“কী আর করা, না হলে আরও ছোট গরু কিনতে হবে।"

এবার দাম কিছুটা বেশি হওয়ার জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে দায়ী করেছেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দার খামারি মো. শরিফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, "পশুখাদ্যের দাম তো অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে, কিন্তু গরু কিনতে এসে গতবারের দামের সঙ্গে মিলিয়ে দাম বলে। আমরা কি আর গতবারের দামে বিক্রি করতে পারব? গতবার বহু লোকসান হয়েছে।"

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে চট্টগ্রামের সাগরিকা পশুরহাটে মানুষের ঢল। শুক্রবার বিকালে হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। ছবি: সুমন বাবু

ছোট আকারের ১৬টি গরুর নিয়ে বৃহস্পতিবার তিনি গাবতলী হাটে এসেছেন; ১২টি ইতোমধ্যে বিক্রি করে ফেলেছেন।

তিনি বলেন, "মনমতো দাম পাইনি, তবে লোকসান হচ্ছে না। ছোট গরুর চাহিদা একটু বেশি আছে, তাই ১২টি আজকেই বিক্রি হয়ে গেছে।"

এ হাটে গরু কিনতে এসেছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. কাইয়ুম। ঘণ্টা তিনেক ঘোরাঘুরি করেও কেনা শেষ করতে পারেননি। গতবারের তুলনায় এবার দাম একটু বেশি বলে কিছুটা ছোট আকারের গরু দেখছেন। বাজেটের সঙ্গে মেলাতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।

তিনি বলেন, গতবছর যেটির দাম ছিল ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা, তেমন গরুর দাম রাখালিরা চাইছেন ১ লাখ ৩০ থেকে দেড় লাখ টাকা।

রাজবাড়ী থেকে তিনটি গরু বিক্রি করতে গাবতলীতে আসা মাসুম শেখ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগের দুই দিনের চেয়ে ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। দুটি বিক্রি শেষ। একটা বিক্রি হয়েছে এক লাখ ৭৫ হাজার ও আরেকটা এক লাখ ৩২ হাজার টাকায়। 

"মাঝারি সাইজের গরুর চাহিদা একটু বেশি, বাকি গরুটার দামদর হচ্ছে, আশা করি বিক্রি হয়ে যাবে।"

আগারগাঁও থেকে গরু কিনতে আসা ইউসুফ মিয়া বলেন, "ছোট গরুর দাম মনে হচ্ছে বেশি। তাই আমি মাঝারি ধরনের গরু কিনেছি। দাম পড়েছে এক লাখ ৬০ হাজার টাকা।

বড় গরুর চাহিদা কম থাকলেও বিক্রি খারাপ না বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে আসা খামারি হাফিজুর রহমান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ২০টি বড় গরু গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকালে হাটে তুলেছি, এরমধ্যে গতকালই চারটি বিক্রি হয়েছে। আজকে গেছে ছয়টি। কাস্টমার একেবারেই কম। তবে আমার গরু দেখে বেশির ভাগের পছন্দ হয়, তাই সহজে বিক্রি করতে পারছি। লাভ কম হলেও ছেড়ে দিচ্ছি, বাজার ভালো হলে আজকে আবার কিছু নামাব।"

সর্বনিন্ম সাড়ে তিন লাখ ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ পর্যন্ত দাম পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

গাজীপুর সদরের খামার ভি অ্যাকুয়ার এর কর্মী মো. মামুন হোসেন ১৯টি বড় গরু হাটে আনার তথ্য দিলেন। এর মধ্যে দুইদিনে সাতটি বিক্রি হয়েছে জানিয়ে বলেন, "সর্বোচ্চ চার লাখ বিশ হাজারে বিক্রি করেছি। বেচাকেনা মূলত কাল (বৃহস্পতিবার) রাত থেকে শুরু হয়েছে। গতকাল চারটি আর আজ সকালে তিনটি বিক্রি হইছে।“

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে চট্টগ্রামের সাগরিকা পশুরহাটে মানুষের ঢল। শুক্রবার বিকালে হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি ফিরছেন ক্রেতারা। ছবি: সুমন বাবু

গরু খাশির চাহিদা বেশি থাকলেও ভেড়া আর দুম্বার চাহিদা একেবারেই নেই গাবতলীর হাটে।

দুইদিন আগে দুটি দুম্বা নিয়ে এ হাটে আসা মাইনুল বলেন, "সবাই দেখতে আসে, দাম জিগায় কিন্তু কেনার জন্য কম লোকই দাম কয়। দেখে দেখে চলে যায়।"

খিলগাঁও নন্দীপাড়া নেওয়াজ তাসিফা এগ্রো ফার্মের ইনচার্জ দেলোয়ার হোসেনের দাবি হাটের সবচেয়ে বড় দুই দুম্বা নিয়ে এসেছেন তিনি। অনেকে আগ্রহ দেখালেও কেনার মত দাম বলছে না।

তিনি বলেন, “জোড়া পাঁচ লাখ হলে ছেড়ে দেব। তিন লাখ পর্যন্ত বলছে অনেকে, অনেকে একটা লাখ বলছে।"

ঢাকার সবচেয়ে বড় এ হাটে পর্যাপ্ত কোরবানির পশু রয়েছে জানিয়ে হাট পরিচালনা কমিটির সদস্য সাহানুর হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "হাটে প্রচুর গরু ছাগল আছে, কাল রাত থেকেই বেচাকেনা হচ্ছে। আজকে আরও গরু নামবে।“

এ হাটের মত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় ২১টি অস্থায়ী হাটে বসেছে গরুর হাট। এর বাইরে পাড়া মহল্লার অলিতে গলিতেও বেচাকেনা হচ্ছে কোরবানির জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনা গরু ও ছাগল।

অন্য হাটগুলোতে আসা ক্রেতারাও এবার দাম বেশি বলে জানাচ্ছেন। শুক্রবার বিকাল থেকে কেনাবেচা শুরু হয়েছে পুরান ঢাকার লালবাগের রহমতগঞ্জ পশুর হাটে। সেখান থেকে চকবাজারের বেচারাম দেউরি থেকে আসা ব্যবসায়ী কায়সার আহমেদ ৯৬ হাজার টাকায় একটি গরু কিনেছেন।

তিনি বলেন, "এবার মনে হয় দাম একটু বেশি। গতবার এমন গরু কিনেছি ৮৫ হাজার টাকায়। বাচ্চারা গরু কেনার জন্য অস্থির হয়ে গেছে, তাই আজকেই কিনে ফেলেছি।"

এ হাটে সিরাজগঞ্জ থেকে ১৭টি গরু নিয়ে এসেছেন খামারি মো. হাসান। তিনি বলেন, "পাঁচটি বিক্রি হইছে। দাম পাচ্ছি মোটামুটি।"

পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় খোকা মাঠের আশপাশজুড়ে হচ্ছে গরু ও ছাগল কেনাবেচা। শুক্রবার দুপুরের পর থেকে প্রচুর ভিড়ও দেখা যায়। সেখানে সূত্রাপুরের ডাল পট্টি থেকে স্কুল পড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে গরু কিনতে এসেছেন বাড়ির মালিক বাদল মিয়া।

তিনি বলেন, "ঘণ্টা খানেক সময় ধরে আসছি, গরু পছন্দ হয়। কিন্তু দাম বেশি থাকার কারণে কিনতে পারছি না। দেখি আর কিছুক্ষণ, না হলে চলে যাব। রাতে আবার আসব।"

সামসুদ্দিন নামের এক বেপারি বলেন, "আটটা গরু নিয়ে আসছি। তিনটা বিক্রি হয়েছে। এখানে আমার গরুগুলোই বড়, সবগুলোই সর্বনিন্ম সাড়ে তিন লাখ টাকা। এ বাজারে বড় গরুর বিক্রি কম।"