‘ফেনীর রাজা’, ‘কালো মানিক’ নিয়ে বিপাকে খামারি

কোরবানির ঈদ উপলক্ষে ফেনীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী গরুর দাম না পাওয়ায় হতাশায় পড়েছেন খামারিরা। বিশেষ করে ‘কালো মানিক’, ‘ফেনীর রাজা’র মতো বড় আকারের গরু নিয়ে বিপাকে পড়ছেন তারা।

ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2022, 07:55 AM
Updated : 7 July 2022, 04:08 AM

বিভিন্ন খামারে মোটাতাজা হওয়া গরু কিনতে ক্রেতারা যে দাম বলছেন তা দিয়ে লালন-পালনের খরচই উঠবে না বলে জানান খামারিরা। ফলে শঙ্কায় পড়েছেন তারা। ঈদের আগে ভাল দামে গরুগুলোকে বিক্রি করতে না পারলে লোকসানে পড়তে হবে তাদের।

সদর উপজেলা পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের উত্তর কাশিমপুর গ্রামের মা এগ্রো ডেইরি ফার্মের মালিক জিয়াউল হক জানান, তার খামারের সবচেয়ে বড় গরুটির ওজন সাড়ে ৩০ মণ। উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুট ও দৈর্ঘ্য ১০ ফুট।

তিনি গরুটির দাম চাচ্ছেন ১৪ লাখ টাকা। কিন্তু স্থানীয় ক্রেতারা মূল্য অনেক কম বলছেন। তাই মঙ্গলবার বিকেলে তিনি গরুটি চট্টগ্রামের বাজারে নিয়ে গেছেন।

ছাগলনাইয়া উপজেলার পূর্ব দেবপুরের বিসমিল্লাহ এগ্রো অ্যান্ড ডেইরি ফার্মের সবচেয়ে বড় গরুটির নাম ‘কালো মানিক’। ২০ মণ ওজনের গরুটিকে উপজেলার সবচেয়ে বড় গরু হিসাবে দাবি করেন মালিক ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরী সোহেল।

তিনি জানান, ফ্রিজিয়ান জাতের এই গরুর উচ্চতা চার ফুট ও দৈর্ঘ্য ১০ ফুট। গত তিন বছর ধরে গরুটি লালন-পালন করছেন তিনি।

তিনি বলেন, “প্রাকৃতিক উপায়ে খৈল, ভুসি, ভুট্টা, কলা, ভাত, খড়-ঘাস খাইয়েছি। কোনো হরমোন বা স্টেরয়েড ব্যবহার করিনি।”

‘কালো মানিক’কে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, “এ মূল্যে উপজেলা শহরে ক্রেতা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। উপজেলায় বিক্রি করতে না পারলে গরুটি নিয়ে চট্টগ্রামের বাজারে যাব।”

দাগনভূঁঞায় কোরবানির পশুর হাটে এবার বড় তারকা হিসেবে আলোচনায় রয়েছে ব্রাহামা জাতের ‘ফেনীর রাজা’। গরুটির উচ্চতা পাঁচ ফুট ও দৈর্ঘ্য নয় ফুট। ওজন সাড়ে ১৮ মণ।

হক ডেইরি ফার্মের খামারি দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসী মামুনুল হক খোকন জানান, পাঁচ বছর ধরে তিনি গরুর খামার করছেন। এবার সাদা-কালো রঙের সুঠাম স্বাস্থ্যের গরু ‘ফেনীর রাজা’র দাম ধরা হয়েছে আট লাখ টাকা।

স্থানীয় বাজারে গরুটির সঠিক দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কা জানান তিনিও।

ফেনী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, ঈদে স্থানীয় পর্যায়ে লালন-পালন করা পশু দিয়ে জেলার শতভাগ চাহিদা মেটানো যাবে। এ বছর জেলায় কোরবানির পশুর চাহিদা ৭৫ হাজার থাকলেও ছোট-বড় দুই হাজার ৭০০টি বাণিজ্যিক খামারে লালন-পালন করা হচ্ছে ৮১ হাজার ৯৮০টি পশু। চাহিদার চেয়ে প্রায় সাত হাজার পশু অতিরিক্ত রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “ফেনীতে বড় জাতের গরু কেনার সৌখিন ক্রেতা না থাকায় অনেক সময় খামারিরা বড় গরুগুলো চট্টগ্রামে বিক্রি করেন। এবারও বেশ কয়েকজন বড় গরুর মালিক ফেনীতে বিক্রি করতে না পেরে তাদের গরু চট্টগ্রামের বাজারে নিয়ে গেছেন বলে জানতে পেরেছি।”

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় কোরবানির জন্য ২৬ হাজার ১৭৪টি ষাঁড়, ৩২ হাজার ৭৬৩টি বলদ, আট হাজার ৩১০টি গাভী, তিন হাজার ২৩০টি মহিষ, ১০ হাজার ৮৮৩টি ছাগল ও ৫৭৮টি ভেড়া লালন-পালন করা হয়েছে। এ ছাড়া অনেকে ব্যক্তিগতভাবে এক বা একাধিক পশু লালন-পালন করছেন।

এদিকে গবাদি পশুর খাবারের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় গরু পালনে খামারিদের খরচ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে এবার বড় আকারের গরু প্রত্যেক মণ মাংস ১৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরের তুলনায় প্রতি মণে পাঁচ হাজার টাকা কম। তাই বড় গরুর পাশাপাশি মাঝারি বা ছোট আকারের গরুর ন্যায্য মূল্যও পাওয়া নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

আমান এগ্রো কমপ্লেক্সের সত্ত্বাধিকারী নাছির উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ঈদে এবার বিক্রয়ের জন্য ৮৫টি গরু প্রস্তুত করেছি। গত বছরের চেয়ে প্রতি কেজি খাবারে প্রায় ৩০ টাকার মতো বাড়তি দিতে হচ্ছে। এ ছাড়া খামারের যাবতীয় খরচের যে ঊর্ধ্বগতি তাতে পুঁজি উঠবে কিনা তা নিয়ে চিন্তায় আছি।”

আজিজুল হক নামে আরেক খামারি বলেন, “দুই মাস ধরে আগের দামের চেয়ে বাড়তি দামে খাবার কিনতে হচ্ছে। সে তুলনায় গরুর দাম না পেলে বড় লোকসান গুণতে হবে।”

জামাল উদ্দিন নামে এক উদ্যোক্তা বলেন, “এবার প্রথমবারের মতো অল্পকিছু গরু নিয়ে খামার দিয়েছি। ঈদকে কেন্দ্র করে খাদ্য, ওষুধ ও শ্রমিকসহ অনেক টাকা পুঁজি বিনিয়োগ করেছি। বাজারে ভারত থেকে যদি গরু না আসে তাহলে ক্ষতির আশঙ্কা নেই।”

অপরদিকে ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম সীমান্ত দিয়ে প্রতি রাতে ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ করছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় গরুর খামারিরা। এসব গরু পরদিন স্থানীয় হাটগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে বলেও জানান তারা। এভাবে ভারতীয় গরু দেশের বাজারে ঢুকলে এবং নিজেদের গরু বিক্রি না হলে বিপুল অঙ্কের ক্ষতির শঙ্কা করছেন তারা।  

তবে সীমান্তে অবৈধভাবে ভারতীয় গরু প্রবেশ বন্ধে তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছে বিজিবি। এ প্রসঙ্গে বিজিবির ফেনী ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ কে এম আরিফুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে নিয়মিত টহলের সঙ্গে বাড়তি নজরদারি করা হচ্ছে।

“অবৈধভাবে গরু প্রবেশ বন্ধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদেরকে এ বিষয়ে কঠোর হতে বলা হয়েছে।”

ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান জানিয়েছেন, ফেনীতে কোরবানির পশুর হাটের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে প্রস্তুতিমূলক সভা করেছে জেলা প্রশাসন। হাটগুলোতে ইজারাদারসহ ক্রেতা-বিক্রেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এ ছাড়া শহরে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং উপজেলায় ও ইউনিয়ন পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা হাটগুলো তদারকি করছেন।

ফেনী জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এবার কোরবানির ঈদে ফেনীর ছয় উপজেলা ও পৌরসভায় স্থায়ী, অস্থায়ী মিলে ১২৯টি পশুর হাট ইজারা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ছয় উপজেলায় স্থায়ী ১২টি, অস্থায়ী ১০টি এবং পাঁচ পৌরসভায় স্থায়ী তিনটি এবং অস্থায়ী পাঁচটি হাট রয়েছে।

এর মধ্যে ফেনী সদর উপজেলায় ৩৯টি, ফেনী পৌরসভায় দুটি, ছাগলনাইয়া উপজেলায় ১৬টি, ছাগলনাইয়া পৌরসভায় দুটি, দাগনভূঞা উপজেলায় ১৯টি এবং পৌরসভায় একটি, পরশুরাম উপজেলায় সাতটি, ফুলগাজী উপজেলায় সাতটি ও সোনাগাজী উপজেলায় ২১টি পশুরহাট বসেছে।

ফেনী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, হাটে গরু বিক্রেতাদের টাকা বহনে পুলিশের সহায়তা প্রয়োজন হলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে। এ ছাড়া গরুর হাটে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে ইজারাদারদের বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।