ভোজ্যতেলের ভ্যাট আসলে কতটা কমছে?

ভোজ্যতেলের ভ্যাট তুলে দাম কমানোর সরকারি সিদ্ধান্তের ছয় দিন পরও একেক দপ্তরের একেক তথ্যে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা; তাতে বাজারে সুফল মিলছে না।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 March 2022, 03:31 PM
Updated : 15 March 2022, 03:41 PM

মোট কত ভ্যাট উঠছে তা সুষ্পষ্ট না হওয়ায় এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেল সরবরাহের স্তরগুলোতে দাম নির্ধারণে এর প্রভাব পড়েনি।

অথচ চড়তে থাকা সয়াবিন ও পাম তেলের বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে উচ্চ হারের ভ্যাট তুলে নেওয়ার আলোচনা উঠলে সরকারও ইতিবাচক সাড়া দেয়।

ভ্যাট তুলে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তের কথা গত বৃহস্পতিবার প্রথম ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল।

সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে তিনি বলেন, জিনিসের দাম যাতে সহনীয় থাকে সেজন্য যেসব আইটেমের ওপর ভ্যাট ছিল সেগুলো তুলে নিয়েছি। ভোজ্যতেল, চিনির ভ্যাট প্রত্যাহার করা হচ্ছে।

এরপর চার মন্ত্রীর অংশগ্রহণে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে ‘দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ সভা শেষে ভোজ্যতেল ও চিনি থেকে সম্পূর্ণ ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

এ ধারাবাহিকতায় সোমবার ভোজ্যতেলের উৎপাদন পর্যায়ে বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ও ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে এসআরও প্রকাশ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

একই দিন মন্ত্রিসভায় ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্তও নেয় সরকার। তবে এ বিষয়ে এখনও সরকারি আদেশ আসেনি।

মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তাওহীদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, আমদানি পর্যায়ে থাকা ১৫ শতাংশ ভ্যাট তুলে নিচ্ছে সরকার। তিনি বলেন, এনবিআর এ বিষয়ে আনুষ্ঠনিক পরিপত্র জারি করবে।

তবে কয়েক ঘণ্টা পর মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাটের পুরোটাই প্রত্যাহার করা হবে বলে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল সেটা সংশোধন করা হলো। ভ্যাট কিছুটা থাকবে।

এবিষয়ে এনবিআর সদস্য (শুল্ক নীতি) মো. মাসুদ সাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, “সোমবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আমরা এটার ওপর কাজ করছি। শিগগির এটা পরিপত্র আকারে জারি করা হবে।“

আর বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সোমবার জানিয়েছিলেন, “আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ রয়েছে, সেখান থেকে ১০ শতাংশ কমানো হবে। কী পরিমাণ কমানো হবে, সেটা এনবিআরের এসআরও প্রকাশের পর জানা যাবে।”

আমদানিতে ‘কিছু ভ্যাট’ থাকছে

ভোজ্যতেলের উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ের ভ্যাট পুরোপুরি তুলে নেওয়া হলেও তা বাজারে দাম কমাতে খুব সামান্য ভূমিকা রাখবে বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়ে দেন ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

তাদের কাছ থেকে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট তুলে দেওয়ার পরামর্শ আসে। দ্রুতই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআরকে চিঠিও দেওয়া হয়।

ফাইল ছবি

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে ভোজ্যতেলে তিন ধরনের ভ্যাট রয়েছে। এর মধ্যে দাম বাড়াতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে আমদানি পর্যায়ের ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

এছাড়া মিলে পরিশোধনের ফলে যে ভ্যালু এডিশন বা খরচ যোগ হয় তার ওপরে রয়েছে ১৫ শতাংশ। আর বাজারে বিপণনের সময় অতিরিক্ত ৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য রয়েছে, যা সাধারণত সুপার শপে কার্যকর রয়েছে। 

সিটি গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে তাতে মিল পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩ টাকা দাম কমতে পারে। “আমদানি পর্যায়ের ভ্যাট না কামলে তা মূল্যহ্রাসে ভূমিকা রাখবেনা। তবে আমরা শুনতে পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমদানি পর্যায়েও প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে।“

দুই স্তরের ভ্যাট প্রত্যাহারের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, যে প্রক্রিয়ায় ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে তা মূল্যহ্রাসে তেমন কোনো ভূমিকা রাখবে না। রাতেই ভোজ্যতেলের ওপর থেকে আমদানি, উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে সমুদয় ভ্যাট প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে এনবিআরকে আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, বার্ষিক ২০ লাখ টন চাহিদার ভোজ্যতেলের মধ্যে ১৮ লাখ টনই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করতে হয়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও সয়াবিন ও পাম তেলের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।

প্রতিমাসে দেড় লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকলেও রোজার মাসে তা বেড়ে আড়াই লাখ টন হয়ে যায়। আসন্ন রমজানে সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যমান মূল্যে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের পর বাজারজাত করলে আরও মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

 “এই অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোজ্যতেল, সয়াবিন তেল, পাম তেল ও পামওলিনের ওপর থেকে আমদানি, উপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে সমুদয় ভ্যাট প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো,” বলা হয় চিঠিতে।

চিঠির পর মঙ্গলবার ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে বিদ্যামান ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পুরোটাই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের কথা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হলেও কয়েক ঘণ্টার পর সেই বক্তব্য সংশোধন করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, পরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত সয়াবিন তেল, অপরিশোধিত পাম তেল ও পরিশোধিত পামতেলসহ অন্যান্য ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট পুরোপুরি তুলে নেওয়া হবে না, তবে কমানো হবে।