ডিমের অস্বাভাবিক দর: সন্দেহ পোল্ট্রি ‘করপোরেটদের’ দিকে

পাইকারি আড়ৎ ও খামারে দৈনিক ডিমের দাম নির্ধারণে বড় কোম্পানিগুলোকেই অনুসরণ করা হয় বলে বৈঠকে দাবি আড়তদার নেতাদের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2022, 05:17 PM
Updated : 21 August 2022, 05:17 PM

বাজারে ডিম ও ব্রয়লার মুরগির অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ার পেছনে পোল্ট্রি খাতের বড় উৎপাদনকারী করপোরেট কোম্পানিগুলোর ভূমিকা রয়েছে বলে আড়তদাররা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ করেছেন।

রোববার ভোক্তা অধিকারের ঢাকা কার্যালয়ে ডিমের মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময়ে তারা এমন অভিযোগ করেন।

তবে সভায় করপোরেট পোলট্রি কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধি না থাকায় এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য বা ব্যাখ্যা জানা যায়নি। আর তাদের আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে।

খামারিদের অভিযোগ সম্প্রতি দর বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ডিম উৎপাদনকারী বড় কোম্পানিগুলোর দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দেওয়া। পাইকারি আড়ৎ ও খামার পর্যায়ে দৈনন্দিন দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলোকেই তারা অনুসরণ করে। এ কারণে বড় কোম্পানিগুলো দাম বাড়িয়ে দিলে অন্যরাও দাম বাড়িয়ে দেয়।

বাজারে কাজী ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ, প্যারাগন, আফতাব বহুমুখী ফার্মস, বাংলাদেশ হ্যাচারিসহ বেশ কয়েকটি বড় ডিম উৎপাদনকারী কোম্পানি রয়েছে যেগুলো নিজস্ব পরিবেশকদের মাধ্যমে ডিম সরবরাহ করে।

আর ঢাকার তেজগাঁও ও মিরপুর আড়ৎ এবং গুলিস্তানের মুরগি পট্টিসহ অন্যান্য পাইকারি বাজারে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত খামারিদের কাছে থেকে ডিম ও মুরগির সরবরাহ এসে থাকে।

গত ৫ অগাস্ট দেশে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পর খুচরা বাজারে ডিম ও মুরগির দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। প্রতিটি ডিমের দাম ৯ টাকা ৮০ পয়সা থেকে সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়ে সাড়ে ১২ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। একইভাবে ব্রয়লার মুরগির দামও প্রতিকেজি ১৩০ থেকে বেড়ে ২০০ টাকায় উঠে যায়।

তবে হঠাৎ করে এত দর বেড়ে যাওয়ার পেছেন এ খাত সংশ্লিষ্টরা যৌক্তিক কোনো কারণ দেখাতে পারেননি।

কয়েকদিনের ব্যবধানে অস্বাভাবিক এমন দর বেড়ে যাওয়ার পর গত বুধবার বাজারে বিশেষ অভিযানে নামে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বাণিজ্যমন্ত্রীও ডিম আমদানি করার কথা বলেন। অভিযানে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন অনিয়ম পেয়ে জরিমানা করার পর শুক্রবারের মধ্যে দাম অনেকটা কমে আসে।

রোববারের বৈঠকে খামারি ও বিক্রেতারা ডিম ও মুরগির উৎপাদন কমে যাওয়া, পরিবহন খরচ বাড়া, খাবারের মূল্য বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন কারণ উত্থাপন করলেও সেগুলোর সবকটিই নাকচ করেছে ভোক্তা অধিকার।

মূল্য বাড়ায় ‘করপোরেটরা’?

সভায় তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ বলেন, “আড়তদাররা প্রতি ১০০ ডিম বিক্রিতে ২০ টাকা কমিশন পায়। দাম নির্ধারণ হয় বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায়। এক্ষেত্রে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা নিজস্ব ডিলারের মাধ্যমে বিপণন করে, তাদেরকে অনুসরণ করা হয়।”

উদহারণ দিয়ে তিনি বলেন, “গত ১২ অগাস্ট তেজগাঁও আড়তে একশত ডিমের দাম ছিল ১ হাজার ১৪০ টাকা, খামারি পর্যায়ে দাম দিয়েছি ১ হাজার ১২০ টাকা। ওই দিন কাজী গ্রুপ রেট দিয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা। তারা তাদের ডিস্ট্রিবিউটরদের মাধ্যমে বিপণন করে।

Also Read: ডিমের হালি ৫০ টাকার উপরে, খামারিরা বলছেন, মুরগি ‘কমেছে বলে’

“তেজগাঁওয়ের ডিমের এক আড়তদার কাজী ফার্মেরও ডিস্ট্রিবিউটর। তার কাছ থেকে আমরা এটা জানতে পেরেছি। অনেক কোম্পানি কাজী ফার্মের রেটকে ফলো করে।“

ওই দিন অন্য কয়েকটি বড় কোম্পানিও কাছাকাছি রেট দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ফলে জেলা পর্যায়ের খামারিরা আমাদের কাছে করপোরেটদের চেয়ে দামে পিছিয়ে থাকার কারণ জানতে চায়। তাহলে মূল কথা হচ্ছে, বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি বাড়ানোর কারণেই আমাদের বাড়াতে হয়েছে। ডিমের চাহিদা ও সরবরাহের গ্যাপের কারণে দামটা বেড়েছে।”

সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ মিয়ার অভিযোগ, “করপোরেট কোম্পানিগুলো আমাদের ডিস্টার্ব করে। বিভিন্ন জেলার খবর নিয়ে আমরা দামটা নির্ধারণ করি। বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি খাদ্য বিক্রি করে, ডিম বিক্রি করে, বাচ্চা বিক্রি করে। তারাই যদি সব ব্যবসা করে তাহলে আমরা কোথায় যাব?

“তারা নিজেদের খামারে সবল বাচ্চা রেখে আমরা যেসব প্রান্তিক খামার থেকে ডিম আনি সেখানে দুর্বল বাচ্চা দিচ্ছে।”

তিনি সম্প্রতি রাতারাতি দাম বাড়ার পেছনে কয়েকটি কোম্পানির রাত ও সকালের দামের ব্যবধান তুলে ধরে জানান, রাতে একশ ডিমের দামের রেট ৯০০ টাকা দেওয়া হলেও সকালে দুই বড় কোম্পানি ৪০ ও ৫০ টাকা বাড়িয়ে দেয়।

“খামারিরা আমাদের মেসেজ পাঠিয়ে বলে- ব্ড় খামারগুলো রেট বাড়িয়েছে, আপনারা আমাদের ঠকাচ্ছেন। এভাবেই ডিমের দামটা বাড়ছে,” যোগ করেন তিনি।

বৈঠকে মিরপুর ভাই ভাই ট্রেডার্সের হাবিবুর রহমান জানান, মিরপুর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির আওতায় বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হয়। প্রতিদিন কোম্পানিগুলো এসএমএসের মাধ্যমে ডিমের দাম ঘোষণা করে। সে অনুযায়ী সবাই বিক্রি করে থাকে।

আর যারা প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে ডিম আনে তারা এসব কোম্পানির রেটের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম ঠিক করেন বলে জানান তিনি।

ডিমের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আড়তদারদের আলোচনার বড় অংশ বড় কোম্পানিগুলোকে কেন্দ্র করে হওয়ার ক্ষেত্রে এ সভায় করপোরেট কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি না থাকার বিষয়টি সামনে আসে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠলে ভোক্তা অধিকারের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, “কোম্পানিকে আমরা ডাকব পরে। আমরা প্রসেসটা শুরু করেছি। আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমরা বলিনি যে কোম্পানির লোকদের ডাকব না। প্রয়োজনে আরেকবার আলোচনায় বসব। ডিমের বিষয়ে আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।”

সাভারে কাজী ফার্মের একজন ডিলার ফয়সাল বলেন, “কাজী ফার্ম আমাদের একটা অফার প্রাইস দেয়। ৭ অগাস্ট রেট ছিল ৯ টাকা ৭৫ পয়সা। ১০ অগাস্ট কোম্পানি রেট ছিল ১০ টাকা ৫০ পয়সা। ১১ অগাস্টে দাম ধরা হয় ১১ টাকা। সেদিন (১৩ অগাস্ট) প্যারাগনের রেট ছিল ১১ টাকা ৯০ পয়সা। ডায়মন্ড রেট ছিল ১১ টাকা ৯০ পয়সা। মোট কথা কাজী ফার্মের পলিসিটা হচ্ছে এরকম।”

এসব বিষয়ে ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ৬ অগাস্ট তেলের দাম বৃদ্ধির পর বেশ কয়েকদিন পণ্য পরিবহন সেবা বন্ধ ছিল। এই সময়ই ডিমের সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় বিভিন্ন এলাকায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ তখন তো আর চাহিদা কমেনি। এখন বিভিন্ন মহল এর জন্য কাজী ফার্মসকে দায়ী করছে যা সঠিক নয়। এ বিষয়ে আমরা সরকারি সংস্থাগুলোর কাছে ব্যাখ্যা দিচ্ছি।“

মতবিনিময় সভায় এফবিসিসিআই সহ সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করা যায় কি না আমাদের বুঝতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বিয়ষটি দেখতে হবে। সমবায় সমিতি, আড়তদাররা ইচ্ছা মত দাম উঠাচ্ছে, দাম নামাচ্ছে।

“আগামীকাল সব ডিম সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ডেকেছি। কাজী ফার্মস, প্যারাগন পল্ট্রি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস, বাংলাদেশ হ্যাচারি লিমিটেড, ফেরদৌসী পোল্ট্রি কমপ্লেক্স, মোল্লা পোল্ট্রি ফার্মস, আপন এগ্রো কমপ্লেক্স, নবীণ এগ্রো ফার্মস, খন্দকার পোল্ট্রি কমপ্লেক্স, ইউনাইটেড এগ্রো কমপ্লেক্সকে ডেকেছি।

“আমার মনে হয় না, সবাই আসবে। ভোক্তা অধিকার যেন তার সরকারি যন্ত্র দিয়ে তাদেরকে এফবিসিসিআইয়ের মিটিংয়ে উপস্থিত করে।”

মিটিংয়ে করপোরেটদের কেন ডাকা হয়নি- প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “খেলছে কারা এটা বাইর করা উচিত। সরকারকে আরও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। শুধু খুচরা ব্যবসায়ীরা জরিমানা দেবে তা হয় না। করপোরেটদের কন্ট্রোল করুন।

“সাভারের ফয়সাল আসল কথাটা বলতে পারছে না। আসল কথা বললে তার ডিলারশিপ থাকবে না। সত্য উদঘাটনের জন্য ভোক্তা অধিকারকে অনুরোধ করব। কোপটা কিন্তু খুচরা ব্যবসায়ীদের ওপর পড়ছে।”

করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিদের সভায় আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে ভোক্তার মহাপরিচালক বলেন, “শুক্র ও শনিবার অভিযানের পর আমরা ঠিক করেছি যে কাদের কাদের ডাকব। করপোরেটদের যে ডাকব না সেটা আমরা বলিনি।

“ডিমের বিষয়টা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন। আমার মনে হয়েছে যে আগে এদের সঙ্গে বসি। এরা যেই দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করবে, তখন তাদেরকে নিয়ে বসব। এখন মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে যে, কোন জায়গাটায় সমস্যা।”

তেজগাঁওয়ে ডিমের ব্যবসা

এখন প্রতিদিন তেজগাঁওয়ের আড়ৎ থেকে ২০ লাখ ডিম বিক্রি হয় বলে আলোচনায় উঠে আসে।

তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ জানান, “১৯৮৮ সালে গাজীপুর, মাওনা, শ্রীপুর, কাপাসিয়া এলাকায় ডিমের ফার্ম চালুর পর তেজগাঁও থেকে ব্যবসা পরিচালিত হয়ে আসছে।

“শুরুর দিকে ১২০ জন আড়তদার ছিল। তবে এখন সেখানে ৩৫ জন আড়তদার ও ২৫ জন খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছে। আগে খামারি ও আড়তদারদের সমন্বয়ে একটা দাম ঘোষণা করা হত। সেই থেকে এটা চলে আসছে। ডিম ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই।”

এখন ডিমের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্য নির্ধারণ প্রভাব বিস্তার করে বলেও জানান তিনি।