অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ভুল বোঝাবুঝি ও সন্দেহের কারণে অনেক কথা হচ্ছে। আমি ব্যবসায়ীদের নিশ্চিত করতে পারি, আমাদের কোনো বাজে এজেন্ডা নেই।”
Published : 26 Jan 2025, 09:39 PM
আগামী বাজেটে শিল্প ও কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রস্তুত করা হবে বলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এক অনুষ্ঠানে আশ্বস্ত করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
রোববার ঢাকার গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে ‘পলিসি অ্যালাইনমেন্ট টু এনহেন্স ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট’ শীর্ষক এ সংলাপের আয়োজন করে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের সংগঠন অ্যামচেম।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ভুল বোঝাবুঝি ও সন্দেহের কারণে অনেক কথা হচ্ছে। আমি ব্যবসায়ীদের নিশ্চিত করতে পারি, আমাদের কোনো বাজে এজেন্ডা নেই।”
“আমরা ব্যবসায়ী, কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, নারী উদ্যোক্তাদের নিশ্চিয়তা দিতে চাই, আগামী বাজেটে আমরা রেগুলেটরি সংস্কারের দিক থেকে শিল্পের জন্য সর্বোচ্চটুকু করব। অর্থনীতি যদি ভালোভাবে চলে, তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রের লোকজনও ভালো একটা স্বস্তি পাবে।”
এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খানও অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন। বিনিয়োগকারীরা তাদের নিজ নিজ খাতের সমস্যা উপদেষ্টা ও এনবিআর চেয়ারম্যানের সামনে তুলে ধরেন।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অস্থিতিশীলতা। ব্যাংকিং খাত, পুঁজিবাজার সর্বত্র অস্থিতিশলীতা আছে। জ্বালানি খাতসহ বিভিন্ন খাতে প্রচুর বকেয়া পড়েছিল। আমরা প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়নের বকেয়া পরিশোধ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছি। মূল্যস্ফীতি এখনও আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে।”
গত ৫ অগাস্ট গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার আরেক ছাত্র আহসান এইচ মনসুরকে দেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব।
ছাত্র শিক্ষক মিলে ‘বিগত সরকারের সময়ে সংগঠিত ব্যাপক অনিয়মের ফল’ মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বড় বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পদ্যোক্তারা দেশের প্রচুর অর্থসম্পদ ‘লুট করে’ বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যবসার পরিবেশ। ব্যবসায়ীদের জন্য পরিবেশটা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল এ বিষয়ে আমি একমত। বড় বড় ব্যবসায়ীদের কেউ দেশে নেই। তারা সাথে করে অনেক টাকা নিয়ে দেশে ছেড়ে গেছেন। আজকে ব্যাংকগুলো ফাঁকা কেন? সাধারণ টাকা ব্যাংকে চলে যায়। কিন্তু এখানে যেটা হয়েছে, আমানতকারীদের টাকাগুলো নিয়ে তারা দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
“এসব কিছুর পরও আমাদেরকে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আমরা সেটা করার জন্য চেষ্টা করছি। সেজন্য আমরা এবার বাজেট আলোচনা একটু এগিয়ে নিয়ে আসব। বলতে গেলে বাজেট আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।”
দেশে ‘আগেকার অনিয়মের ধাক্কা’ মোকাবেলার পাশাপাশি আসন্ন এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের একটি প্রস্তুতিমূলক ব্যস্ততা রয়েছে বর্তমান সরকারের। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কিছু নীতি সংস্কারের কথাও বলেন উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সময় নির্ধারিত রয়েছে। সেজন্য আমরা বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছি। রাজস্ব সংস্কার, বন্দর ব্যবস্থাপনা সংস্কার, কাস্টমসের সংস্কার, রেগুলেটরি সংস্কার এবং পুঁজিবাজারে সংস্কারের মত কাজগুলো সরকার করছে। কিন্তু বেসরকারি খাতকেও কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। বেসরকারি খাতকে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা, দক্ষতা বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাতগুলো না করলে উত্তরণ করা সরকারের জন্য কঠিন হবে।”
আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠদের শিল্পকারখানাগুলোর ভঙ্গুর দশার উদাহরণ দিতে গিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “এক্ষেত্রে বেক্সিমকোর একটি ক্লাসিক উদাহারণ আমি আপনাদের দিতে পারি। গত পাঁচ মাস ধরে বেক্সিমকো কোনো টাকা পরিশোধ করেনি। অর্থমন্ত্রণালয় থেকে বেক্সিমকোর শ্রমিকদের বেতন বাবদ ৫২ কোটি টাকা দিতে হয়েছে।
“এটা তো আমাদের দায়িত্ব ছিল না! আমরা কেন দিলাম? কারণ শ্রমিকদের প্রতি আমাদের দরদ রয়েছে। আমরা তাদের পুনর্বাসন করতে চেয়েছি। বেক্সিমকো বা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানকে আমরা বাদ দিতে চাই না। এই ধরনের সমস্যা সঙ্কুল প্রতিষ্ঠানগুলো দেখভাল করতে সরকার একটি কমিটি করেছে।“
সরকার সম্প্রতি শতাধিক পণ্যে ভ্যাট বাড়িয়ে দিয়ে অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা উত্তলনের একটি প্রক্ষেপণ করেছে। মাঠ পর্যায়ে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে বেশ কিছু পণ্যের ওপর থেকে বাড়তি ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিতও করা হয়েছে। তবে এখনও বাড়তি ভ্যাট আরোপের পরিমাণ কম নয়।
সেই ভ্যাট নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের কথাবার্তার উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, “অনেকে আমাকে পরামর্শ দিচ্ছেন; যত পারেন ট্যাক্স বাড়ান, কিন্তু সেটা কতটুকু? ভ্যাট কমান, অন্য খাতগুলোতে হাত দেন, কিন্তু অন্য খাতগুলো কী? অনেকে বলছেন সবার জন্য সহনশীল (এফোর্ডেবল) কিছু করেন, এই সহনশীল ব্যপারটা কী?”
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) এর পরিচালক আল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ রেমিট্যান্স, রপ্তানিতে বেশ ভালো করছে; মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমছে। কিন্তু এর মাঝেও কিছু উদ্বেগের ব্যাপার রয়েছে।
“কিছু বিদেশি ২০২৫ সালে তাদের ব্যবসা পূর্ভাবাসে টার্গেট কিছুটা কমিয়ে আনছে। এর মানে হচ্ছে, উৎপাদন সক্ষমতা কমিয়ে আনা হবে, অনেকেই চাকরি হারাবেন। বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে তারা নিশ্চয় বিনিয়োগ নিয়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারে। এখনই আমাদেরকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, “এখন মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি, এই সময়ে ট্যাক্স রেটও যদি বাড়ানো হয়, তাহলে সেটা সমস্যা। ব্যবসা পরিস্থিতি আরও ভালো হওয়া প্রয়োজন। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালকার খাতে ভ্যাট-ট্যাক্স এখন অনেক বেশি। অনেক বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটা সমস্যা সৃষ্টি করবে।”
আগামী বাজেটে ভ্যাট-ট্যাক্সের বিষয়গুলো আরও যৌক্তিক ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বাস দেন অর্থ উপদেষ্টা।